নিষিদ্ধ পলিথিন শপিং ব্যাগকে ‘আবারও নিষিদ্ধ’ করে নভেম্বরের শুরু থেকে বাজারে অভিযান চালাচ্ছে সরকার। তবে মাসব্যাপী অভিযানেও বিন্দুমাত্র কমেনি পলিথিন আগ্রাসন। এখনো কাঁচাবাজার, মাছবাজার, মাংসের দোকান, মুদি দোকান- সর্বত্র পলিথিন ব্যাগেই দেওয়া হচ্ছে পণ্য। বন্ধ হয়নি পলিথিনের পাইকারি দোকান বা উৎপাদন। সরকারের তথ্যানুযায়ী, ৩ নভেম্বর থেকে গতকাল পর্যন্ত পলিথিন শপিং ব্যাগের বিপণন ও ব্যবহার থামাতে ১৬৬টি অভিযান চালানো হয়েছে। এতে ৩৪৯টি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়েছে। জব্দ করা হয়েছে ৪ টন পলিথিন। আর পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, দেশে বছরে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক উৎপন্ন হয় প্রায় ৮৭ হাজার টন। অর্থাৎ মাসে ৭ হাজার টনের বেশি, যার মধ্যে পলিথিন ব্যাগের পাশাপাশি ওয়ানটাইম কাপ, গ্লাস, বিস্কুট-চিপসের প্যাকেট ইত্যাদি রয়েছে। আর বছরে মোট প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয় ৮ লাখ ২১ হাজার ২৫০ টনের বেশি।
গবেষণার তথ্যানুযায়ী, উৎপন্ন প্লাস্টিক বর্জ্যরে ৪০ ভাগ পুনঃব্যবহার হলেও বাকিটা পড়ে থাকে পরিবেশে। আর একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক বা পলিথিন ব্যাগের প্রায় পুরোটাই জায়গা করে নেয় মাটি, ড্রেন, স্যুয়ারেজ, খাল, বিল, নদী ও সমুদ্রে। এগুলো গুঁড়ো হয়ে মাইক্রোপ্লাস্টিকে রূপান্তরিত হয়ে মিশে যায় খাদ্যচক্রে, যা ক্যান্সারসহ নানা প্রাণঘাতী রোগের জন্ম দেয়। ২০২১ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের এক গবেষণায় প্রতি কেজি লবণে গড়ে প্রায় ২ হাজার ৬৭৬টি মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। জার্মানির বার্লিন ভিত্তিক গবেষকদের নেটওয়ার্ক রিসার্চগেটে প্রকাশিত এক গবেষণা বলছে, পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদী হয়ে প্রতিবছর প্রায় ১-৩ বিলিয়ন মাইক্রোপ্লাস্টিক মিশছে বঙ্গোপসাগরে।
এদিকে পলিথিনের আগ্রাসন ঠেকাতে অধিকাংশ অভিযান চলেছে বাজারকেন্দ্রিক। হাতে গোনা কয়েকটি কারখানা সিলগালা করা হলেও বিভিন্ন সূত্রমতে দেশে দেড় হাজারের বেশি কারখানায় উৎপাদন হয় পলিথিন ব্যাগ। পুরান ঢাকার কয়েকটি পলিথিন কারখানার কর্মীদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, সরকারের কড়াকড়ির পর এসব কারখানায় দিনের বেলায় অন্যান্য প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন হয়। পলিথিনের শপিং ব্যাগ তৈরি হয় রাতে। রাতেই সেগুলো সরিয়ে ফেলা হয়। আর অভিযান চলে দিনে। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে উৎপাদন ধরা পড়ে না। তবে প্লাস্টিক কারখানার এক কর্মী বলেন, প্লাস্টিকের প্রতিটি পণ্য তৈরির ডাইস আলাদা। যারা অভিযান চালান, তারা অভিজ্ঞ হলে কারখানার যন্ত্রপাতি দেখলেই বুঝতে পারবেন সেখানে পলিথিনের শপিং ব্যাগ তৈরি হয় কি না।
ভাটারা এলাকার মাংস ব্যবসায়ী হারুন বলেন, আমার প্রতিদিন দেড়-দুই কেজি পলিথিন লাগে। আগে যেখান থেকে কিনতাম, এখনো সেখান থেকেই কিনি। বড় দোকানগুলো একসঙ্গে এক-দেড় মণ কিনে আমাদের কাছে খুচরা বিক্রি করে। তারা কোথা থেকে আনে সেটা প্রশ্ন করলে তো উৎস বেরিয়ে যায়। কারখানা বের করার জন্য তো গোয়েন্দা সংস্থা নিয়োগ করার দরকার পড়ে না। খিলক্ষেতের মুদি দোকানদার আলমগীর বলেন, পলিথিন বন্ধ করতে চাইলে প্রথমে উৎপাদন বন্ধ করতে হবে, একই সঙ্গে বিকল্প ব্যাগের ব্যবস্থা করতে হবে। কোনোটাই হচ্ছে না। চাল-ডাল দেওয়ার জন্য কাগজের ঠোঙ্গাই পাওয়া যায় না। শুধু খুচরা দোকানে অভিযান চালিয়ে লাভ কী? এদিকে পলিথিন ব্যাগের বিরুদ্ধে অভিযান প্রসঙ্গে গতকাল পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের এ-সংক্রান্ত মনিটরিং কমিটির সভাপতি ও অতিরিক্ত সচিব তপন কুমার বিশ্বাস বলেন, পলিথিন শপিং ব্যাগের নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে সরকার বদ্ধপরিকর। সরকারের নির্দেশনা না মানলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গত ৩ নভেম্বর থেকে ১৬৬টি অভিযানে ৩৪৯টি প্রতিষ্ঠানকে ১৯ লাখ ২৯ হাজার ৯০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ৪০ হাজার কেজি পলিথিন জব্দ করা হয়েছে। সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক বন্ধেও কাজ চলছে। সচেতনতা বৃদ্ধি, বিকল্প সরবরাহ এবং নিয়ম বাস্তবায়ন একসঙ্গে চালানো হচ্ছে।