রাত তখন সবেমাত্র বারোটার কাঁটা পেরিয়েছে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মাইকে বেজে উঠলো করুণ সুর, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’। আজ থেকে সত্তর বছর আগে মাতৃভাষার মর্যাদার রক্ষার লড়াইয়ে আত্মোৎসর্গকারীদের কী করে ভোলা যায়! তাই সোমবার অমর একুশের প্রথম প্রহরে বাংলা মায়ের অকুতোভয় সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শহরের সব রাস্তা যেন গিয়ে মিশেছিলো কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। ভাষা শহীদদের শোকেই যেন এদিন বিকেল থেকে আকাশও হয়েছিলো ভার, গড়িয়ে পড়েছিলো অশ্রুও।
অমর একুশে ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ফুলেল ভালোবাসা আর অকৃত্রিম শ্রদ্ধায় সিক্ত হলেন রফিক-সালাম-জব্বারসহ নাম না জানা ভাষা শহীদেরা। ১২টা ০১ মিনিটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়স্থ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের শহীদ বেদীতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের পক্ষে তাঁর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল এস এম সালাহউদ্দিন ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে তাঁর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল নকিব আহমদ চৌধুরী। এরপর তারা কিছুক্ষণ নিরবে দাঁড়িয়ে থাকেন।
জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর পক্ষে শ্রদ্ধা জানান সংসদ সচিবালয়ের সার্জেন্ট আ্যট আর্মস কমোডর মিয়া মোহাম্মদ নাইম রহমান। একে একে মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, বিভিন্ন বাহিনীর প্রধান, ঢাকাস্থ বিভিন্ন দূতাবাসের কূটনীতিকবৃন্দসহ শহীদ বেদীতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
ডেপুটি স্পিকারের পক্ষে গোলাম শাহরিয়ার তালুকদার, অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ আমিনউদ্দীন, শিক্ষা মন্ত্রলায়ের পক্ষে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান হাসান চৌধুরী নওফেল শ্রদ্ধা জানান।
আওয়ামী লীগের পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, শাজাহান খান, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক দীপু মনি, হাছান মাহমুদ, বন ও পরিবেশ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, উপদপ্তর সম্পাদক সায়েম খান প্রমূখ।
প্রথম প্রহরেই পুলিশের পক্ষে আইজিপি বেনজীর আহমেদ, র্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসেন শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ঢাকা সিটি করপোরেশনের দুই মেয়রের পক্ষে তাদের প্রতিনিধিবৃন্দ শ্রদ্ধা জানান। বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদের পক্ষে জাতীয় পার্টির নেতা মুজিবুল হক চুন্নু ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
একুশের প্রথম প্রহরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের পক্ষে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান শহিদ বেদীতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এসময় উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন। ঢাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. রহমত উল্লাহ, সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো. নিজামুল হক ভূইয়ার নেতৃত্বে শ্রদ্ধা জানায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। সভাপতি একে আজাদের নেতৃত্বে শ্রদ্ধা জানায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই এসোসিয়েশন।
সময় বাড়ার সাথে সাথে ভিড় বাড়তে থাকতে শহীদ মিনার এলাকায়। পরে শহীদ মিনারের বেদি জনসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। একে একে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সর্বস্তরের জনগণ শহীদ বেদীতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করতে থাকে।
কেন্দ্রীয় ১৪ দলের পক্ষে দীপু মনি ও হাসানুল হক ইনু ও ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, গণসংহতি আন্দোলন, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় পার্টির পক্ষে জাতীয় পার্টির নেতা এজাজ আহমেদ ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ শ্রদ্ধা জানান। সকালে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে দলীয় নেতাকর্মীরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ও আজিমপুর কবরস্থানে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরে তারা আজিমপুর কবরস্থানে গিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এছাড়া ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের হলশাখাসমূহ, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রমৈত্রী, ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্র ফেডারেশন, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, মুজিববর্ষ উদযাপন কমিটির সমন্বয়ক কামাল উদ্দিন নাসের, বাংলাদেশ টেলিভিশন, গণপূর্ত অধিদপ্তর, বাম ঐক্যফ্রন্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি, ও অন্যান্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনসূহ শহীদ বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানায়। সকাল নাগাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল প্রশাসনের পক্ষে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
এদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসূচির অংশ হিসেবে সোমবার সকাল সাড়ে ৬টায় উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান-এর নেতৃত্বে সীমিত পরিসরে একটি প্রভাতফেরি অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ থেকে শুরু হয়। প্রভাতফেরি সহকারে তাঁরা আজিমপুর কবরস্থানে গমন করেন এবং ভাষা শহীদদের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর ভাষা শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে ফাতেহা পাঠ করা হয়। পরে প্রভাতফেরি সহকারে তাঁরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গমন করেন এবং পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। বাদ জোহর মসজিদুল জামিয়াসহ সকল হলের মসজিদ এবং বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকার মসজিদে ভাষা শহিদদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। এছাড়া, অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়ে শহিদদের আত্মার শান্তি কামনা করে বিশেষ প্রার্থনা করা হয় ।
অমর একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে রবিবার সন্ধ্যা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। ডিএমপি’র পক্ষ থেকে নেওয়া হয় ছয় স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ইউনিফর্ম পুলিশের পাশাপাশি কাজ করেছে সাদা পোষাকের গোয়েন্দা পুলিশ। বসানো হয়, আর্চওয়ে ও ওয়াচ টাওয়ার। পলাশী মোড় হয়ে কয়েক ধাপের নিরাপত্তা বেষ্টনী পেরিয়ে ফুল দিতে যেতে হয় মানুষকে। তবে ব্যক্তি পর্যায়ে সর্বোচ্চ দুই জন ও সংগঠন পর্যায়ে সর্বোচ্চ পাঁচজন একসঙ্গে শ্রদ্ধা জানাতে পারবে-এমন কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত তার কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। এমনকি শ্রদ্ধা জানাতে এসে হাতাহাতিতেও জড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন