সাহেব এবং মোসাহেব শব্দগুলোর শানে নুজুল আমার জানা নেই। অর্থাৎ কোন ঘটনার প্রেক্ষাপটে সাহেব শব্দটি আমাদের ভাষায় সংযুক্ত হলো এবং কোন প্রেক্ষাপটে বাঙালি সাহেবের সামনে ও পেছনে ধামাধরা মোসাহেবকে খুঁজে পেয়েছিল সেই ইতিহাস আমি জানি না। তবে আদিকাল থেকে বাঙালি গৌরবর্ণের নারী-পুরুষ দেখলে তাদের সম্মান করত। যখন আরব, তুর্কি, আফগান প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা আমাদের ভূখন্ডে এসেছিলেন তখন তাদের উজ্জ্বল গায়ের রং, সুঠাম দেহ এবং সৌম্যকান্তি মুখাবয়বের জন্য আমরা কোনো প্রশ্ন ছাড়াই তাদের নেতা মেনেছি এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের হাতে তলোয়ার ছিল তাদের প্রতিরোধ না করেই সিংহাসন দিয়ে দিয়েছি। পরে শশাঙ্কের পর আমরা আর কোনো বাঙালি নেতৃত্ব পাইনি, যেভাবে পেয়েছি ১৯৭১ সালের পর।
সাদা চামড়ার প্রতি বাঙালির দুর্নিবার আকর্ষণের জন্যই সম্ভবত ইংরেজ আমলে আমরা আদর করে তাদের সাহেব বলে ডাকতাম। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের আগে বিশেষ করে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর দিল্লির কেন্দ্রীয় শাসন ক্রমে দুর্বল হতে থাকে। ফলে পুরো ভারতবর্ষে স্থানীয় অনেক রাজা-বাদশাহ সুলতানের অভ্যুদয় ঘটে। দক্ষিণ ও উত্তর ভারতের অনেক স্থানে দেশীয় রাজা-রানির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলেও বাংলা, বিহার, ওড়িশা সবটাই বিদেশি শাসক কর্তৃক শাসিত হয়েছে। বাংলার প্রথম স্বাধীন নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ গুজরাটের অধিবাসী ছিলেন। পরবর্তীকালে সুজাউদ্দৌলা-সরফরাজ খান-আলিবর্দী খাঁ এবং নবাব সিরাজদ্দৌলার বংশক্রম পারস্য-তুর্কম্যান জাতিগোষ্ঠী থেকে শুরু হলেও বাংলার আবহাওয়ার কারণে তাদের গাত্র বর্ণ কিছুটা অনুজ্জ্বল হয়ে পড়েছিল। ফলে ইংরেজ-ফরাসি-পর্তুগিজ ওলন্দাজদের মতো ধবধবে সাদা লোক যখন আমাদের দেশে এলো তখন আমরা যার যার অবস্থান থেকে অবাক বিস্ময়ে প্রায় শত বছর ধরে তাদের দেখলাম এবং তাদের ভালোবেসে সবকিছু উজাড় করে দেওয়ার জন্য পাগলামো শুরু করলাম।
আপনারা অনেকেই জানেন, ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে সর্বপ্রথম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তাদের দেখাদেখি অন্যান্য ইউরোপীয় দেশেও একই নামে কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। মূলত ভাস্কো দা গামার ভারত আবিষ্কারের পর ইউরোপীয়রা দলে দলে ভারতমুখী হয়। প্রথম দিকে তারা ডাকাতি করত এবং এদেশীয় লোকজনকে ধরে নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় দাস হিসেবে বিক্রি করত। তাদের দমন করার জন্য মুঘলরা যখন শক্তিশালী নৌবহর গঠন করলেন তখন তারা বাণিজ্য করার ছলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নামে ভারতে আসতে আরম্ভ করল। ইউরোপে যেমন ইংরেজ-ফরাসি-ওলন্দাজ-পর্তুগিজ প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে শত শত বছরের যুদ্ধবিগ্রহ চলছিল তা ভারতবর্ষে এসেও চলতে থাকে। বাণিজ্য করতে এসেও ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং ফরাসি-পর্তুগিজ-ওলন্দাজ-ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিগুলো পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ শুরু করে দেয়।
উল্লিখিত অবস্থায় ইংরেজরা মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারের আনুকূল্য লাভের জন্য রানি প্রথম এলিজাবেথের শরণাপন্ন হয় এবং ব্যবসায়ী নেতাদের অনুরোধে রানি স্যার টমাস রো নামক একজন অত্যন্ত দক্ষ কূটনীতিবিদকে রাষ্ট্রদূতরূপে মুঘল সম্রাটের কাছে প্রেরণ করেন। স্যার টমাস রো যেদিন রাজদরবারে প্রবেশ করলেন সেদিন তার ধবধবে গায়ের রং ভারতের রাজকীয় ভাষা ফারসিতে অনর্গল ও নির্ভুল উপস্থাপনা এবং ইউরোপীয় পোশাক-আশাক ও উপহারের ধরন দেখে স্বয়ং সম্রাট অভিভূত হয়ে পড়লেন এবং ইংরেজদের সারা ভারতবর্ষে বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার অনুমতি দিলেন।
মুঘল সম্রাটের বিশেষ কোটা প্রাপ্তির পর ইংরেজরা একচেটিয়া ব্যবসা শুরু করল। ফলে ধীরে ধীরে অন্য সব ইউরোপীয় কোম্পানি দেউলিয়া হতে থাকল এবং তাদের লোকজন বিভিন্ন স্থানীয় রাজদরবারে বংশপরম্পরায় চাকরি করতে থাকল। মহীশূরের হায়দার আলী-টিপু সুলতান এবং বাংলার আলীবর্দী খাঁ ও নবাব সিরাজদ্দৌলার বাহিনীতে ফ্রান্সের লোকজন সৈনিক হিসেবে চাকরি করত বিধায় ইংরেজরা প্রায় ৫০ বছর ধরে এই দুটি দেশীয় রাজ্য ধ্বংস করার জন্য মাস্টারপ্ল্যান নিয়ে এগোতে থাকে। ফলে এ দেশের জনগণের মনে ভয়-আতঙ্ক এবং সম্ভ্রম জাগানোর জন্য তারা সর্প হয়ে দংশন ও ওঝা হয়ে ঝাড়ার নীতিতে এগোতে থাকে। ফলে বাঙালি ইংরেজদের নিজেদের অজান্তে সাহেব বানিয়ে ফেলে।
আদিকালের সাহেব সুবা যেমন ইংরেজদের কেন্দ্র করে আবর্তিত হতো তা হাল আমলে বাঙালি-অবাঙালি-ইউরোপীয়-আমেরিকান-পাকিস্তানি হিন্দুস্তানি সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সাহেব বলতে আমরা সাধারণত নিজেদের চেয়ে সুন্দর-শক্তিশালী ধনাঢ্য লোকজনকেই বুঝি। কাউকে সাহেব সম্বোধনের মাধ্যমে আমরা নিজেকে দুর্বল, অসহায়, সাহায্য প্রার্থী এবং হীনমন্য মনুষ্য হিসেবেই নিজেদের অজান্তে নিজেকে ছোট বানিয়ে ফেলি। ইংরেজকে আমরা সাহেব বলতাম, যা পাকিস্তানি জমানায় এসে উর্দু অপভ্রংসে সাহাব হয়ে যায়। আবার দিল্লির দাসত্বের কারণে আমরা দাদা-দাদাবাবু ওমুকজি-তমুকজি ইত্যাদিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি। আমাদের শত শত বছরের পুরনো সেই অপসংস্কৃতি হাল আমলে কতটা ভয়ংকর হয়ে পড়েছে তা আলোচনার জন্যই আজকের শিরোনাম নির্ধারণ করেছি।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে নিয়ে আওয়ামী লীগের আদিখ্যেতা এবং শেখ হাসিনার হীনমন্যতার কথা নিশ্চয়ই আমরা ভুলে যাইনি। জো বাইডেনের সঙ্গে শেখ হাসিনা এবং তার কন্যা পুতুলের একখানা সেলফি নিয়ে আওয়ামী লীগ যেভাবে বেশরমের মতো লাফিয়েছে তা আমরা বাংলার ইতিহাসে কোনোকালে দেখিনি। বাইডেনের সঙ্গে শেখ হাসিনা এবং পুতুলের সেই ছবি দেখে কিছু লোক মনে করেছিল বাইডেনের দয়ায় কেউ আওয়ামী লীগের একটি পশমও স্পর্শ করতে পারবে না। বেশির ভাগ আওয়ামী প্রপাগান্ডা মেশিন এ কথা বলেছিল, শেখ হাসিনার মতো যোগ্য নেত্রী, দক্ষ শাসক এবং সৎ প্রধানমন্ত্রী দুনিয়ায় দ্বিতীয়টি নেই। ফলে শেখ হাসিনা যেখানে যান সেখানে তিনি রাতারাতি তারকা বনে যান। তাকে দেখার জন্য বিশ্বনেতারা ভিড় করেন। তাকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী, কানাডার প্রধানমন্ত্রীর মতো প্রভাবশালী বিশ্ব নেতৃবৃন্দ হাঁটু গেড়ে দেশরত্ন বিশ্বনেত্রীর সোফার পাশে বসে কথা বলে নিজেকে ধন্য মনে করেন। তারা আরও বলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নিজে থেকে এগিয়ে এসে শেখ হাসিনা এবং তার কন্যার সঙ্গে ছবি তুলে নিজেকে ধন্য মনে করেন।
শেখ হাসিনাকে যারা সাহেব বানিয়েছিলেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ শেখ হাসিনার সামনে দাঁড়িয়ে কান্না বিজড়িত কণ্ঠে আফসোস করে বললেন, আমরা সম্ভবত নেত্রীকে হারাতে বসেছি। কারণ তিনি এখন কেবল বাংলাদেশের নেত্রী নন-বিশ্বনেত্রী। কাজেই বিশ্বের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তিনি কখন আমাদের ছেড়ে চলে যান, আমরা এখন সেই আতঙ্কের মধ্যে রয়েছি। মোসাহেবদের সম্মান রক্ষার্থে শেখ হাসিনা যখন বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতবর্ষের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য দিল্লিতে অবস্থান করছেন তখন তার সেই মোসাহেবরা বাস্তবে কতটা আতঙ্কের মধ্যে আছেন তা আমরা কমবেশি সবাই জানি। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনকালে যারা মোসাহেবি করতেন তারা নিজ নিজ কর্মে যথেষ্ট দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন এবং মোসাহেবিকে ততটা ঈর্ষণীয় উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন যার কারণে নির্ঘাত মৃত্যু জেনেও অনেকের মনে মাত্র এক রাতের জন্য মোসাহেব হওয়ার লোভের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলত।
শেখ হাসিনার জমানার মোসাহেবরা যেমন হঠাৎ করে তৈরি হয়নি আবার রাতারাতি মোসাহেবমুক্ত সমাজ রাষ্ট্র হঠাৎ করে তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। প্রতিটি শ্রেণি-পেশার যেমন বংশগতি রয়েছে, তদ্রুপ মোসাহেবদেরও বংশগতির বিবর্তন রয়েছে। শেখ হাসিনার পলায়ন এবং আওয়ামী সরকারের পতনের পর লোভনীয় পদ-পদবির সুযোগ-সুবিধা এবং অন্যায়-অপকর্ম, চাঁদাবাজির দখল নিয়ে যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে তার ফলে লোকজন যারপরনাই বিরক্ত-বিভক্ত ও হতাশ। কারণ আগের অপকর্মকারীরা ছিল দক্ষ-অভিজ্ঞ এবং তাদের পেট ছিল ক্ষুধামুক্ত। ফলে তাদের অপকর্ম কতটা শিল্পের মর্যাদায় পৌঁছেছিল তা সাবেক ভূমিমন্ত্রী জাবেদের ৯ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি নিয়ে আলজাজিরার প্রতিবেদন দেখলেই বোঝা যায়। অন্যদিকে জাবেদ এবং গংয়ের স্থান পূরণের জন্য ক্ষুধার্ত-বুভুক্ষু এবং আহাম্মকদের যে দৌড় শুরু হয়েছে তা কতটা শিল্পবর্জিত তা হাল আমলের ভুক্তভোগীদের আহাজারি শুনলেই অনুমান করা যায়। জাবেদরা যে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন ঠিক একই রূপ সিন্ডিকেট গড়েছিল মোসাহেবরা। তাদের অবর্তমানে মোসাহেব সমাজে যে বিশাল শূন্যতা বিরাজ করছে তা পূর্ণ করার জন্য বুভুক্ষু-ক্ষুধার্ত এবং আহাম্মক প্রকৃতির মোসাহেবদের তৎপরতা দেশবাসীকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে। ইদানীংকালে বাইডেনকে নিয়ে যেসব কথাবার্তা হচ্ছে, তার সঙ্গে ছবি তোলা কিংবা সাদা চামড়ার অন্য সাহেবদের সঙ্গে ছবি তোলা ইত্যাদি নিয়ে যেসব মোসাহেবির অর্থাৎ অখাদ্য-পথ্য নিয়ে একশ্রেণির লোক হাজির হচ্ছেন তাদের বাণী শোনার পর মনে হচ্ছে- মোসাহেবি প্রশিক্ষণের জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন রয়েছে। কীভাবে মোসাহেবি করতে হয়, কী পরিমাণ ক্ষুধা নিয়ে কতটুকু হাঁ করে মোসাহেবির কথামালা উচ্চারণ করতে হয় তা যদি হাতে-কলমে শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকে তবে নয়া সাহেব সুবাদের বিপদ অতীতের চেয়ে ভয়ংকর এবং জটিল আকার ধারণ করবে।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক