মঙ্গলবার, ১১ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

রমজানে ডায়াবেটিস রোগীর করণীয়

চৌধুরী তাসনিম হাসিন, পুষ্টিবিদ

রমজানে ডায়াবেটিস রোগীর করণীয়

রমজানের সিয়াম সাধনার সময় ডায়াবেটিস রোগ নিয়ন্ত্রণ করা চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। একইভাবে রোজা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য বিভিন্ন স্বাস্থ্য উপকারিতা বৃদ্ধি করতে পারে যেমন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা, মস্তিষ্কের স্ট্রেস হরমোন নিয়ন্ত্রণ করা, কার্ডিয়াক ফাংশন বৃদ্ধি করা। শরীরের ওপর প্রভাব ছাড়াও এ সময়ে একটি তীব্র আধ্যাত্মিক, সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিক সংযোগ রয়েছে। আধুনিক গবেষণাগুলো ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিংয়ের সঙ্গে ওজন হ্রাস এবং ডায়াবেটিসের উপকারিতা সম্পর্কে তথ্যের ওপর জোর দিয়েছে। আমরা রমজান মাসে নিরাপদে রোজা রাখতে সক্ষম হতে পারি যদি আমরা ঝুঁঁকিগুলো বুঝতে পারি, আমাদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করি এবং সাবধানে আমাদের ডাক্তার এবং ডায়েটিশিয়ানের সুপারিশ অনুসরণ করি। নিম্নলিখিতগুলোর একটি বা একাধিক সমস্যা থাকলে রমজান মাসে রোজা রাখলে বিভিন্ন জটিলতার উচ্চ ঝুঁকি থাকতে পারে, দুর্বল রক্তে শর্করার নিয়ন্ত্রণসহ টাইপ ১ ডায়াবেটিস এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিস লো ব্লাড সুগার বা ডায়াবেটিক কেটোঅ্যাসিডোসিসের মেডিকেল হিস্টোরি লো ব্লাড সুগার থাকলে এবং এ ব্যাপারে ব্যক্তির আগে জানা না থাকলে। গুরুতর কিডনি রোগ বা রক্তনালির জটিলতা থাকলে গর্ভবতী মায়েরা বিশেষত যাদের ডায়াবেটিস আছে।

অন্যদিকে, টাইপ ২ ডায়াবেটিসের রোগী যারা শুধু খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাত্রার মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করেন অথবা যারা ডায়াবেটিসের ওষুধ খান যা তাদের হাইপোগ্লাইসেমিয়ার ঝুঁকি বাড়ায় না; তাদের রোজার সময় ঝুঁকি কম থাকে। যদিও রমজান মাসে রোজা রাখার আগে টাইপ ২ ডায়াবেটিসের জন্য কিছু অত্যাবশ্যক নিয়ম রয়েছে, যাতে তারা তাদের ডায়াবেটিসের প্রভাব সম্পর্কে চিন্তা না করে রোজা রাখতে, উদযাপন করতে এবং নিজস্ব সংস্কৃতি অনুযায়ী খাবার উপভোগ করতে পারেন।

নিয়মগুলো হলো : রক্তে শর্করার নিবিড় পর্যবেক্ষণ, ওষুধের ডোজ সামঞ্জস্য করা, লো ব্লাড সুগারের লক্ষণগুলো জানা খাদ্য, পানীয় এবং ব্যায়াম সম্পর্কে পুষ্টিবিদদের পরামর্শ অনুসরণ করা যদি রক্তে শর্করার পরিমাণ কম বা বেশি থাকে তবে কী করতে হবে সে বিষয়ে প্রস্তুত থাকা সব সময় সঙ্গে গ্লুকোজ সাপ্লিমেন্ট রাখা রোগী যদি অস্বস্তি, দিশাহারা বা বিভ্রান্ত বোধ করতে শুরু করে বা অজ্ঞান হয়ে যায় তাহলে রোজা বন্ধ করা এবং পানি বা অন্যান্য তরল পান করা এবং দ্রুত রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা পরীক্ষা করা। ইনসুলিন ব্যবহারকারীদের কখনোই ইনসুলিন বন্ধ করা উচিত নয়, তবে আপনার ইনসুলিন ইনজেকশনের ডোজ এবং সময় পরিবর্তন করতে অবশ্যই ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে হবে। রমজানে ডায়াবেটিস ব্যবস্থাপনায় ডায়েট ও নিউট্রিশন থেরাপি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাহরির খাবার খাওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। সাহরির খাবারগুলো স্বাস্থ্যকর হওয়া উচিত, কারণ দীর্ঘ সময়ের জন্য এ খাবার পর্যাপ্ত শক্তি সরবরাহ করে। এ খাবার পরিপূর্ণ, উচ্চ ফাইবারযুক্ত হওয়া উচিত। যেমন উচ্চ আশযুক্ত সিরিয়াল বা ওটস, বাদামি চাল ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করা উচিত যা আরও ধীরে ধীরে শোষিত হয় এবং এসব খাবারের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম। মসুর ডাল, ছোলা এবং মটরশুঁটি প্রোটিনের ভালো উৎস, এ ছাড়াও এদের ফাইবার বেশি। ফল এবং সবজির সঙ্গে সঙ্গে এগুলো খেলে এসব খাবার কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করতে এবং হার্টকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করবে। রোজা শুরু করার আগে, দিনের বেলা ডিহাইড্রেশন এড়াতে পর্যাপ্ত চিনিমুক্ত এবং ডিক্যাফিনেটেড তরল পান করা উচিত। চা এবং কফির মতো ক্যাফেইন রয়েছে এমন পানীয় এড়িয়ে চলুন, কারণ Diuretic, যার ফলে ব্যক্তি আরও বেশি পানি হারাতে পারেন। ঐতিহ্যগতভাবে রোজার সমাপ্তি হয় কয়েকটি খেজুর খাওয়ার পর অন্যান্য খাবারের মাধ্যমে। ইফতার  হলো সেই সময় যখন ব্যক্তি দিনের শক্তির চাহিদা পূরণ করেন, তাই সমস্ত প্রধান খাদ্য গ্রুপ থেকে খাবার খাওয়ার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করা উচিত। ইফতারে প্রচুর পানি পান করা উচিত। ইফতার এবং সাহরির মধ্যে কমপক্ষে আট থেকে ১০ কাপ পানি পান করার পরামর্শ দেওয়া হয়, যাতে শরীর পরের দিনের জন্য সময়মতো লিকুইডের মাত্রা সামঞ্জস্য করতে পারে। চিনিযুক্ত পানীয়, ফিজি বা কার্বনেটেড পানীয় এড়িয়ে চলুন। যে খাবারগুলো এড়ানো উচিত তা হলো ভারী-প্রক্রিয়াজাত, ভাজা-পোড়া খাবার যাতে রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট থাকে, সেই সঙ্গে চর্বিযুক্ত খাবার। প্রক্রিয়াজাত খাবারগুলো সুবিধাজনক বলে মনে হতে পারে, তবে সেগুলো সাধারণত উচ্চ-ফ্র্রুক্টোজ কর্ন সিরাপ, এমএসজি (ফ্লেভার বাড়ানোর জন্য), প্রচুর সোডিয়াম এবং হার্ট-ক্লগিং অতিরিক্ত তেলের মতো অস্বাস্থ্যকর জিনিস দিয়ে ভরা থাকে। ভাজা এবং তৈলাক্ত খাবার পরিমিত পরিমাণে খাওয়ার চেষ্টা করুন, কারণ এগুলো বেশি ঘন ঘন খেলে রমজানে অনিচ্ছাকৃত ওজন বেড়ে যেতে পারে। রমজান মাসে ডুবো তেলে ভাজা খাবার এড়িয়ে চলুন। রান্নার জন্য তেল ব্যবহার করার সময় তেল মেপে ব্যবহার করার চেষ্টা করুন। বারবার একই তেলে ভাজলে, তেল পুনরায় গরম করলে ট্রান্স-ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমাণ বেড়ে যায়, যা হার্টের জন্য খারাপ। আমাদের উচিত ধীরে ধীরে খাওয়া এবং খাবার ভালোভাবে চিবিয়ে খাওয়া। কারণ আমরা সারা দিন না খেয়ে থাকায় দ্রুত প্রচুর পরিমাণে খাবার খাওয়ার প্রবণতা থাকে। মনে রাখা উচিত যে, আমাদের পেট যে ভরে গিয়েছে বা আমরা যে পরিপূর্ণ সেটা আমাদের পাকস্থলী আমাদের মস্তিষ্ককে জানাতে ২০ মিনিট সময় নেয়। খেজুরে গ্লুকোজ এবং ফ্রুক্টোজের একটি বিশেষ মিশ্রণ রয়েছে, যা স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পুষ্টির জোগান দেয়। এ ছাড়া খেজুরে বিটা-ডি-গ্লুকান নামক একটি উপাদান রয়েছে যা পানিতে দ্রবণীয় ফাইবার। এর স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে এবং তা খাদ্যের পরিতৃপ্তি বাড়াতে পারে। তাই মূলত আমরা যখন ইফতারের জন্য খেজুর এবং পানি পান করি তখন আমাদের শরীর শুধু পানি পানের থেকে অনেক দ্রুত হাইড্রেটেড হয়। যেসব খাবার বেশি গ্রহণ করতে হবে তার মধ্যে রয়েছে- সালাদ, ফল, বাটারমিল্ক, ডিমের সাদা অংশ, স্প্রাউটস, বাদাম, আখরোট, মাল্টিগ্রেন চাপাতি, পুরো গমের রুটি, ওটস, সবুজ শাকসবজি, চর্বিহীন মাংস, মুরগির মাংস এবং মাছ। রমজানের সময় ব্যায়াম সবচেয়ে কম করা হয়। টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিরা রমজান মাসে ব্যায়াম এবং তাদের দৈনন্দিন রুটিন চালিয়ে যেতে পারেন, বিশেষ করে সকালের দিকে, তবে তাদের ইফতারের এক বা দুই ঘণ্টা আগে অতিরিক্ত ব্যায়াম করা উচিত নয়। যদিও হাইপোগ্লাইসেমিয়া এবং ডিহাইড্রেশনের ঝুঁকি বৃদ্ধির কারণে এ সময় জোরালো ব্যায়াম করার পরামর্শ দেওয়া হয় না। তাই এসব বিষয়ে সচেতন হতে হবে।

লেখক : চিফ ক্লিনিক্যাল ডায়েটিশিয়ান

ইউনাইটেড হসপিটাল।

সর্বশেষ খবর