মঙ্গলবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

জৌলুস হারাচ্ছে সুন্দরবন

সুন্দরবন দিবস আজ

মোস্তফা কাজল

জৌলুস হারাচ্ছে সুন্দরবন। ফলে পর্যটক টানতে পারছে না বিশ্ব ঐতিহ্যের নিদর্শন দেশের এই বনটি। বনের প্রধান আকর্ষণ রয়েল বেঙ্গল টাইগারের অস্তিত্ব এখন সংকটে। কয়েক বছরের ব্যবধানে বাঘের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১০৬-এ। চোরা শিকারিদের কারণে কমছে বাঘ ও হরিণ। লবণাক্ততা ও গাছ চোরের তৎপরতায় কমছে গাছগাছালির সংখ্যাও।

এ বন নানা কারণে ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে। বাংলার অহংকার সুন্দরবনের বাংলাদেশ ও ভারত এ দুই দেশের অংশেই ভূখণ্ড কমছে, আর জলাভূমি বাড়ছে। বাইরে থেকে বা পাখির চোখে উপর থেকে দেখলে সুন্দরবনের দৃশ্য এখনো নয়নাভিরাম। এর ভিতর দিয়ে বহমান নদী থেকে সুন্দরবনের দিকে তাকালে মনে হবে যেন সুসজ্জিত এক বাগান। কিন্তু এর ভিতরটায় প্রতিনিয়ত সৌন্দর্য ও সম্পদহানি ঘটছে।

আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রতি বছরের মতো এবারও পালিত হচ্ছে সুন্দরবন দিবস। ভালোবাসা দিবসে সুন্দরবনকেও ভালোবাসার আহ্বান জানিয়েছে দিবসটি পালনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো। প্রতি বছর কয়েক হাজার দেশি-বিদেশি পর্যটক এ বন পরিদর্শনে যান। এ বনে রয়েছে হরিণ, বানর, কুমির, ঘড়িয়ালসহ শতাধিক প্রাণীর বাস। আরও রয়েছে আড়াই শতাধিক প্রজাতির পাখির বসবাস। এবারের দিবসের প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘জীববৈচিত্র্যের সুন্দরবন, করব মোরা সংরক্ষণ’। এ বনের সুন্দরীসহ সব ধরনের গাছের সংখ্যাও কমতে থাকায় নেওয়া হয়েছে গাছ লাগানোর উদ্যোগ। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) জানায়, মূলত সুন্দরবনে নদীতীরবর্তী এলাকায় ভাঙনের কারণে আয়তন কমছে। সিইজিআইএসের সুন্দরবন জয়েন্ট ল্যান্ডস্কেপ ন্যারেটিভ-২০১৬ গবেষণায় বলা হয়, গত ২৪০ বছরে সুন্দরবনের আয়তন প্রায় ৬ হাজার বর্গকিলোমিটার কমেছে।

রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘সুন্দরবন দিবস’ উদযাপনের দাবি : রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘সুন্দরবন দিবস’ উদযাপনের দাবি জানিয়েছে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগ ও খুলনার বেসরকারি সংগঠন সুন্দরবন একাডেমি।

গতকাল সকালে সুন্দরবন দিবস-২০১৭ উপলক্ষে খুলনা প্রেস ক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানানো হয়। অনুষ্ঠানে বন সংরক্ষক, খুলনা সার্কেল জহির উদ্দিন আহমেদ, বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মুহাম্মদ সাঈদ আলী ও সুন্দরবন একাডেমির ফারুক আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।

২০০১ সালে খুলনায় প্রথমবারের মতো ‘জাতীয় সুন্দরবন সম্মেলন’ অনুুষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে প্রতিবছর খুলনাসহ সুন্দরবন সন্নিহিত জেলাগুলোতে ১৪ ফেব্রুয়ারি সুন্দরবন দিবস পালিত হচ্ছে। দিবসটি উপলক্ষে আজ বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, চিত্রাঙ্কন ও বক্তৃতা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে।

১৭৭৬ সালে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন ছিল ১১ হাজার ২৫৮ বর্গকিলোমিটার। ২০১৬ সালে তা কমে প্রায় ৬ হাজার কিলোমিটারে নেমে এসেছে।

সিইজিআইএসের সুন্দরবনবিষয়ক গবেষণার প্রধান ফিদা এ খান বলেন, ‘আমরা সুন্দরবনের মানচিত্র, স্যাটেলাইট ইমেজ ও সরেজমিনে অনুসন্ধানের মাধ্যমে গবেষণাটি করেছি। সুন্দরবনের জন্য হুমকিগুলো আমরা চিহ্নিত করেছি। যাতে এ বন রক্ষায় যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া যায়।’ অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক আবদুল আজিজ এবং বন বিভাগের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বন সংরক্ষক অসিত রঞ্জন পাল তার গবেষণা ‘বাংলাদেশ সুন্দরবন : পরিবেশ ও জৈব সম্পদের বর্তমান অবস্থা’য় আরও অনেক কিছু উল্লেখ করেছেন। সুন্দরবনে ১৯৫৯ সালে প্রতি হেক্টরে ২৯৬টি গাছ ছিল। গাছের সংখ্যা নিয়মিতভাবে কমে ১৯৮৩ সালে হেক্টরপ্রতি দাঁড়ায় ১৮০টিতে। ১৯৯৬ সালে তা আরও কমে হয় ১৪৪। এভাবে চলতে থাকলে ২০২০ সালের মধ্যে গাছের সংখ্যা নেমে আসবে ১০৯টিতে।

গবেষণায় আরও বলা হয়, ভারতীয় অংশে সুন্দরবনের আয়তনও ৫ হাজার ১২৪ বর্গকিলোমিটার কমেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ অংশের বনের মোট আয়তন ৫ হাজার ৩২০ বর্গকিলোমিটার। আর ভারতীয় অংশের আয়তন ৩ হাজার ৯৪ বর্গকিলোমিটার। তবে দুই দেশের সরকারি নথি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার হিসাবে সুন্দরবনের আয়তন বলা হচ্ছে ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার।

সুন্দরবন ঘিরে নানা ধরনের বাঁধ, পোল্ডারসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের কারণেও বনের আয়তন কমে আসছে। একই অবস্থা ভারতীয় অংশেও। উদ্ভিদ নিয়ে এক গবেষণায় বলা হয়, সুন্দরবনে গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া এবং বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়ার জন্য অন্যান্য কারণের সঙ্গে লবণাক্ততাও দায়ী। ১৯৭৫ সালে ফারাক্কা বাঁধ চালুর পর শুষ্ক মৌসুমে সুন্দরবন প্রতি সেকেন্ডে শূন্য থেকে ১৭০ ঘনমিটার পলিযুক্ত মিঠা পানি গ্রহণ করেছে। সেখানে লবণাক্ততার পরিমাণ ঠিক রাখার জন্য কমপক্ষে ১৯৪ দশমিক ৪ ঘনমিটার পানিপ্রবাহ প্রয়োজন। ফারাক্কা বাঁধের পর পানিপ্রবাহ কমে গেছে। ফলে মিঠা পানির প্রবাহ কম থাকায় লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়ছে বনের মধ্যে। এ কারণে ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ বেঁচে থাকতে পারছে না। এর সঙ্গে সাইক্লোন ও বিভিন্ন কারণে বনভূমি ভেঙে ছোট ছোট নদী তৈরি হয়েছে।

সুন্দরবন দিবস : আজ সুন্দরবন দিবস। এবারের স্লোগান ‘জীববৈচিত্র্যের সুন্দরবন, করব মোরা সংরক্ষণ’। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ২০০১ সাল থেকেই প্রতি বছর এ দিবসটি পালিত হয়। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের আওতায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনার স্বেচ্ছাসেবী বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে এবং দেশের আরও ৭০টি পরিবেশবাদী সংগঠনের অংশগ্রহণে দিবসটিতে নানা কর্মসূচি থাকে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর