উপমহাদেশের অন্যতম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীর রাউজান অংশের পশ্চিম গুজরা ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডের আজিমের ঘাট এলাকায় গত ২১ মার্চ একটি মৃত ডলফিন পাওয়া যায়। গত ৮ মে উরকিরচর ইউনিয়নের জিয়া বাজার এলাকার ছায়ারচর স্থান থেকে কাটা অবস্থায় উদ্ধার করা হয় প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে ডলফিন।
সর্বশেষ গত মঙ্গলবার হালদা নদীর রাউজান আজিমের ঘাট এলাকা থেকে ২৭তম মৃত ডলফিন উদ্ধার করা হয়। ডলফিনটির দেহের মাঝ বরাবর এবং লেজের অংশে কাটা ও আঘাতের চিহ্ন আছে। এটির দেহের দৈর্ঘ্য ৪৬ ইঞ্চি। এটির ওজন প্রায় ৩০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে।
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পরিচালিত এক জরিপ মতে, হালদা নদীতে ডলফিন ছিল ১৭০টি। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত ২৭টি মৃত ডলফিন উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে অধিকাংশের শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
এভাবে একের পর এক ডলফিন হত্যা করা হচ্ছে। কমছে ডলফিনের সংখ্যা। হুমকিতে আছে বেঁচে থাকা ডলফিনগুলো। শঙ্কায় পড়েছে জীববৈচিত্র।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, মঙ্গলবার উদ্ধারকৃত ডলফিনটিকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। উদ্ধারের তিনদিন আগেই এটি মারা যেতে পারে। পরে উদ্ধারকৃত ডলফিনটি রাতেই উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তর ও বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের কর্মকর্তারা মাটি চাপা দেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, ‘এমনিতেই ডলফিনের সংখ্যা কমছে। তার ওপর প্রায় সময় হালদা নদীতে মৃত ডলফিন ভেসে ওঠার ঘটনাটি আমাদের জন্য একটি চরম অসনি সংকেত। উদ্ধারকৃত প্রায় প্রতিটি ডলফিনের শরীরেই থাকে আঘাতের দাগ।’
হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রুহুল আমিন বলেন, ‘গত দুই বছরে গভীর রাত ও দিনে ১৩৫টি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। অভিযানে ধ্বংস করা হয় বালু উত্তোলনে ব্যবহৃত ৯টি ড্রেজার ও ২৭টি ইঞ্জিন চালিত নৌকা, কারাদণ্ড দেওয়া হয় ৩ জনকে। তবুও লোভাতুর কিছু অসাধু মানুষের শকুনি দৃষ্টি থামছেই না। প্রাকৃতিক জীববৈচিত্রের আধার ডলফিনকে হত্যা করা হচ্ছে। জানি না কখন তাদের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে।’
রাউজান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জোনায়েদ কবির সোহাগ বলেন, ‘প্রাকৃতিক জীবচৈত্রের অন্যতম অনুষঙ্গ ডলফিন এবং হালদা নদীকে রক্ষায় প্রতি সপ্তাহে অন্তত তিনবার অভিযান পরিচালিত হয়। তাছাড়া বন্ধ করা হয়েছে বালি উত্তোলন ও ইঞ্জিনচালিত বোট চলাচল। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টার মাধ্যমে হালদা নদী ও ডলফিন রক্ষায় বদ্ধপরিকর।’
জানা যায়, হালদা নদীতে যে ডলফিনের দেখা মেলে, তা গাঙ্গেয় ডলফিন প্রজাতির। ইংরেজিতে একে বলা হয় গেঞ্জেস রিভার ডলফিন, বৈজ্ঞানিক নাম ‘প্লাটানিস্টা গেনজেটিকা’। স্থানীয়ভাবে একে বলা হয় হুতুম বা শুশুক। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) গাঙ্গেয় ডলফিনকে বিপন্ন হিসেবে লাল তালিকায় রেখেছে। ২০১২ সালের বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের তফসিল-১ অনুসারে এই প্রজাতিটি সংরক্ষিত। এই প্রজাতির ডলফিন বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের নদীতে দেখা যায়। এর মধ্যে ভারতের গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র, বাংলাদেশের পদ্মা, সুন্দরবনের আশেপাশের নদী এবং চট্টগ্রামের হালদা ও কর্ণফুলী এর বিচরণ ক্ষেত্র। চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত হালদা নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৮০ কিলোমিটার। হালদার সঙ্গে সংযুক্ত আছে ১৭টি খাল।
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন