মঙ্গলবার, ৫ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

জেলখানায় চার জাতীয় নেতাকে হত্যা কেন?

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

জেলখানায় চার জাতীয় নেতাকে হত্যা কেন?

লিখতে চেয়েছিলাম ক্রিকেট নিয়ে, ক্রিকেট পরিচালনায় বাংলাদেশের প্রাণপুরুষ নাজমুল হাসান পাপন এমপিকে নিয়ে। পাপনের বাবা আমাদের নেতা জিল্লুর রহমান খুবই কাছের মানুষ। ’৬০-৬৫ থেকে তার সঙ্গে সম্পর্ক। সখিপুরে গিয়ে এক সময় তিনি মুক্তকণ্ঠে বলেছিলেন, ‘কাদের সিদ্দিকী ৭ মন্ত্রীর সমান।’ সে যাই হোক জিল্লুর ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক সুগভীর। সেদিক থেকে পাপনকে বহুবার বহুভাবে দেখেছি। কিন্তু সব ক্রিকেটার যেদিন প্রতিবাদ করল পাপন খেলোয়াড়দের সব দাবি প্রত্যাখ্যান করল সেদিন পাপনের অঙ্গভঙ্গি দেশবাসীর ভালো লাগেনি, আমারও যে লেগেছে তা বলতে পারি না। তার এক দিন না দুই দিন পর আইসিসি ক্রিকেট বোর্ড সাকিব আল হাসানকে দুই বছরের জন্য বহিষ্কার বড় অবাক লেগেছে। কে তার কাছে ২-৩ বার ফোন করেছে খবরা খবরের জন্য তাই নিয়ে তাকে দুই বছরের জন্য খেলা স্থগিত করা হয়েছে। সেই বাঘের ঝরনাতে পানি খাওয়ার মতো। এক হরিণ ভাটিতে পানি খাচ্ছিল। তাকে বাঘ বলে বসে, তুই আমার পানি ঘোলা করছিস কেন? হরিণ বলল, কী আবার করলাম। আমি তো ভাটিতে পানি খাচ্ছি। বাঘ বলল, তুই ঘোলা না করলে কী হবে তোর বাবা ঘোলা করেছে। তাই তোর ঘাড় মটকাব। মূল কথা পানি ঘোলা নয়। মূল কথা ঘাড় মটকানো। এই তো কিছুদিন আগে পদ্মা সেতু নিয়ে অমন ঘটনা ঘটেছে। টাকা ছাড় করার আগেই দুর্নীতির দায়ে আবুল হোসেন মন্ত্রী থেকে বরখাস্ত। যেখানে টাকা বরাদ্দই হয়নি, এক পয়সা খরচ করা হয়নি সেখানে দুর্নীতি হয় কীভাবে? বিশ্বব্যাংক থেকে বলা হয়েছিল, এখন দুর্নীতি না হলে কী হবে, দুর্নীতির কথা মনে মনে ভাবা হয়েছে। লিখতে চেয়েছিলাম এসব কথা। কিন্তু ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতাকে নিয়ে লিখতে বড় তাগিদবোধ করছি। এর আগে একবার ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের জয়কে ছলনা করে ঠেকানো হয়েছিল। সেই জয় আমরা গতকাল পেয়েছি। ধন্যবাদ জানাই ক্রিকেট দলকে। এই বিজয়কে অভিনন্দন জানাই।

দেখতে দেখতে কতদিন পেরিয়ে গেল, ৩ নভেম্বর ছিল জেলহত্যা দিবস। ’৭৫-এর ৩ নভেম্বর ছিলাম প্রতিরোধ সংগ্রামে তুরার হাতীপাগার সীমান্তে। সীমান্তে একজন ক্যাপ্টেনসহ দুজন জেসিও ছদ্মবেশে আমাদের এলাকায় ঢুকেছিল। আমাদের সীমানায় ৩০০-৪০০ গজ ঢুকতেই তারা জাতীয় মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। আমাদের একজন গুপ্তচরের সঙ্গে যোগাযোগ করেই ৮ অথবা ৯ নভেম্বর এসেছিল। আমার কাছে যখন আনা হয় তখন তারা তাদের পরিচয়পত্র দেখায়। তখন ফটোকপি এবং ক্যামেরা ছিল না বলে সেদিনের ছবি রাখতে পারিনি। তাদের কথা ছিল, এখন আর প্রতিরোধের দরকার কী? খন্দকার মোস্তাকের সরকারের পতন হয়েছে, জিয়াউর রহমান এখন রাষ্ট্রের মূল চালক। আপনি সীমান্তে না থেকে ঢাকায় ফিরে গিয়ে যা করার করুন। আমি সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের আদেশেই আপনার কাছে এসেছি। ব্যাপারটা আমার ভালো লাগেনি। তবু তারা সাহস করে এসেছিল বলে তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে কথাবার্তা বলে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। সে আজ কতদিন! সে ছিল ’৭৫-এর নভেম্বর আর আজ ২০১৯ সালের নভেম্বর। কত কথা মনে পড়ে। বঙ্গবন্ধুকে যেমন আকস্মিকভাবে হারিয়ে ছিলাম, জাতীয় চার নেতাকেও তেমনি অভাবনীয় আকস্মিকভাবেই হারিয়েছি। ষড়যন্ত্রকারীরা ঠিকই চিন্তা করেছিল জাতীয় চার নেতা বেঁচে থাকলে দেশকে ইচ্ছেমতো যে কোনো দিকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। আর যা কিছুই হোক পাকিস্তান-ভারতের সেবাদাস করা যাবে না। বাংলাদেশ তার চিরাচরিত সত্তা নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। তাই বঙ্গবন্ধুর পর যারা ছিলেন জাতির ভরসা আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক তাদের জেলখানার ভিতরে অমন নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। জেলের ভিতরে ওভাবে হত্যার নজির আমাদের জানা ছিল না। পাকিস্তানের জন্মের পরপর মুসলিম লীগ সরকারের আমলে রাজশাহী জেলে গুলি চলেছিল, এক সময় খুলনায় গুলিতে বেশ কিছু কয়েদি নিহত হয়। সে ছিল দাঙ্গা হাঙ্গামার কারণে। কিন্তু পরিকল্পিতভাবে জাতীয় নেতাদের জেলের ভিতরে ওভাবে আর কখনো হত্যা করা হয়নি। জাতীয় এই চার নেতা কমবেশি সবাই আমার পরিবারের সঙ্গে পরিচিত।

এক. সৈয়দ নজরুল ইসলাম আমাদের বৃহত্তর ময়মনসিংহের মানুষ। ’৫০-৫২ সালের পর থেকেই তার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক। দিন যত গেছে সম্পর্ক তত গভীর হয়েছে। ষাটের কাছাকাছি এসে তা প্রায় আত্মীয়তায় রূপ নেয়। বাবা মা হারিয়ে ছিলেন তিন সাড়ে তিন বছর বয়সে। বাবার দাদি আমাদের মাওই মা তাকে কোলে পিঠে মানুষ করেছিলেন। মায়ের আদরযত্ন কখনো পাননি। তাই মায়ের আদর কী তা তিনি খুব একটা বুঝতেন বলে মনে হয় না। তিনি সৈয়দ নজরুল ইসলামের স্ত্রী, আশরাফের মাকে মা ডাকতেন। সেই সুবাদে আমরা সবাই দাদি ডাকতাম। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর ৪০ দিন বয়সে আমার দাদু আলাউদ্দিন সিদ্দিকী ইন্তেকাল করেন। তাই আমরা দাদু দেখিনি। বড় ভাইও দেখেননি। ৪০ দিনে দেখার বোঝার কোনো অবস্থা থাকে না। ’৫৮ সালের ২০ অক্টোবর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি করে সব রাজনৈতিক দল এবং রাজনৈতিক কর্মকা- নিষিদ্ধ করে। মাত্র ৭ দিন পর জেনারেল আইয়ুব খান জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জাকে লন্ডনে এক হোটেলের ম্যানেজারের চাকরি দিয়ে দেশ থেকে বিতাড়িত করে। শুরু হয় সামরিক শাসন। সকাল বিকাল মন্ত্রিসভা রদবদল হতে থাকে। এক সময় আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট হয়ে বসে। করাচির আরব সাগর থেকে সোনাদানা উঠতে থাকে। অনেক বড় বড় মানুষ জেলে যায়। আজকাল পিয়াজ হয়েছে সোনার চেয়ে দামি। কিন্তু সে সময় পিয়াজের দাম ছিল দু’আনা-দশ পয়সা, ডিম এক আনা হালি, খাঁটি দুধ দু’আনা সের। সেই সময় সামারি মার্শাল কোর্টে দুধ বিক্রেতা ক্যাশম্যামো দেয় নাই, বেগুন-মরিচ-পিয়াজ বিক্রির ক্যাশম্যামো নেই, মুরগিআলা পাঁচ শিকায় মোরগ বিক্রি করেছে কিন্তু ক্যাশম্যামো দেয় নাই- ৬ মাসের জেল, দুইশ টাকা জরিমানা এ হলো মিলিটারি সামারি কোর্টের বিচার। সেসব বলার মতো নয়। এ সময় আবার নতুন সৃষ্টি বুনিয়াদি গণতন্ত্র। পাকিস্তানের মানুষ ভোট দিতে জানে না, তাই পূর্ব পাকিস্তানে ৪০, পশ্চিম পাকিস্তানে ৪০- মোট ৮০ হাজার হবে বুনিয়াদি গণতন্ত্রী। এদের পাবলিক ভোট দিয়ে বানাবে। এরা হবে ইলেকট্ররাল কলেজ। এরা সব পর্বে ভোট দেবে। এই ছিল মোদ্দা কথা। এখন কী হয় অতটা বলতে পারব না, তখনো সারা বিশ্বে কিছুটা ন্যায়নীতি ছিল। আইয়ুব খান ডিটেক্টর হিসেবে বাইরে গিয়ে খুব সম্মান পাচ্ছিলেন না বলে তার মনে হচ্ছিল একটা ভোটাভুটির দরকার। বুনিয়াদি গণতন্ত্রী তো আগেই বানিয়েছিলেন। তাদের দিয়ে না হয় একটা ভোট হয়ে যাক। সামরিক শাসন জারির চার বছর পর ’৬২ সালে সেই ভোট হলো। ৮০ হাজার ভোটারের ভোট। সেই সময় সম্মিলিত বিরোধী দল একজন প্রার্থী নিয়ে জেনারেল আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে নির্বাচনী যুদ্ধে নেমেছিল। পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বোন মাদারে মিল্লাত মাহতেরামা ফাতেমা জিন্নাহ সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রার্থী। এক নতুন জাগরণের সৃষ্টি হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সবাই মাদারে মিল্লাত মাহতেরামা ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। রাস্তাঘাটে আইয়ুব খানের কোনো পাত্তা ছিল না। আইয়ুব খানের মিটিংয়ে পাঁচ হাজার, বিরোধী দলের মিটিংয়ে ৫০ হাজার বা লাখ জনতার ঢল। ইত্তেফাকে প্রথম পাতায় বিশাল ছবি দিয়ে লেখা হয়েছিল ‘উহাকে চিনিল কেমনে?’ অর্থাৎ এক বিডি মেম্বারকে ষাঁড় গরু ধাওয়া করেছিল। এ ছিল ছবির মূল প্রতিপাদ্য। এখনকার মতো তখন তেমন রাস্তাঘাট ছিল না। গ্রামীণ খেয়াই ছিল ভরসা। কোনো জায়গায় কোনো বিডি মেম্বারকে আইয়ুব খানের সমর্থক মনে হলে ফেরি নৌকার মাথা কাঠে ফেলে ইট বা অন্য কিছু দিয়ে আঘাতের পর আঘাত করে অনেককে পানিতে ভাসিয়ে দিত। যার অধিকাংশরাই মারা যেত। এরকম সময় একদিন হঠাৎই টাঙ্গাইল আওয়ামী লীগ অফিস থেকে বলা হলো ময়মনসিংহ থেকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবকে আনতে হবে। জননেতা আবদুল মান্নান তখন একটা বক্সওয়াগন গাড়ি চালাতেন। আর হাতেম আলী তালুকদারের প্রিন্স-এ দুটোই হলো টাঙ্গাইল আওয়ামী লীগের নেতাদের যান্ত্রিক যান। আমাদের সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তাই আমাকে পাঠানো হলো। এক ঘণ্টা দশ মিনিটে আমরা ময়মনসিংহ পৌঁছে গেলাম। রাস্তাঘাট একেবারে ফাঁকা। সামনের দিক থেকে ৫-৬টা গাড়ি এসেছিল কিনা বলতে পারব না। ২-৩টা গাড়ির বেশি অতিক্রম করিনি। তখনো রিকশার প্রচলন হয়নি। জেলা শহরে ২-১টা দেখা গেলেও কোনো ভ্যান-ভুন, স্কুটার কিংবা সিএনজি ছিল না। মোষের আর গরুর গাড়ি সম্বল। পাকা সড়কে মোষ এবং গরুর গাড়ি তেমন একটা দেখা যেত না। আবার গাড়ির আওয়াজ পেলে এক কিলোমিটার দূর থেকে রাস্তা ছেড়ে দিত। রাস্তায় ১-২ বারের বেশি হর্ন দিতে হতো না। ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল ছিল ৬০ মাইল। অবলীলায় কার-জিপ ৫০-৬০ মাইল গতিতে চালানো যেত। কখনো সখনো ৬০-৭০ মাইল চালালেও অসুবিধা হতো না। মনে হয় ৮-সাড়ে ৮টায় পৌঁছে ছিলাম। আমাকে দেখে দাদি ভীষণ খুশি। সঙ্গে সঙ্গে নাস্তা খাইয়ে নজরুল ইসলাম সাহেবকে তৈরি করে দিয়েছিলেন। সাড়ে ৯টায় রওনা হয়ে পৌনে ১১টায় টাঙ্গাইল পৌঁছেছিলাম। দারুণ ভালো এক সভা হয়েছিল। এরপর কিছু হলে ময়মনসিংহ গেলে সৈয়দ নজরুল ইসলামের কলেজ রোডের বাড়িতে না গিয়ে পারতাম না। ’৬০-৬২ আমাদের জন্য ছিল জুলুমের বছর। সেই ’৬০ সাল থেকে ’৬৯-এ আগরতলা মামলা থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি পর্যন্ত আইয়ুব-মোনায়েমের আমরা ছিলাম প্রধান শত্রু। কখনো বাবা জেলে বড় ভাই বাইরে আবার বড় ভাই জেলে বাবা বাইরে। মাসে একবার আমাদের বাড়ি পুলিশ তছনছ না করলে মনে হতো বাড়িটা বড় অগোছালো হয়ে আছে। ঠিক সেই সময় ’৬২ সালে গ্রেফতার হয়ে বাবা কিছুদিন নেত্রকোনা জেলে ছিলেন। হঠাৎ এক গভীর রাতে নেত্রকোনা জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ময়মনসিংহ সৈয়দ নজরুল ইসলামের বাড়ির বারান্দায় কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়েছিলেন। কাউকে বিরক্ত করবেন না এটাই ছিল বাবার ইচ্ছে। সকালে আশরাফের মা দরজা খুলে বাইরে বেরোতে গিয়ে বারান্দায় কাউকে শুয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে ডাকাডাকি করে বাবাকে তুলেন। বাবাকে দেখেই দিদা চমকে উঠে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি এখানে?’ বাবার উত্তর, অনেক রাতে এসেছি। তাই কাউকে বিরক্ত না করে বারান্দাতেই শুয়েছিলাম। বাবাকে তুলে তাড়াতাড়ি গোসলের পানি গরম করে দেন। গোসল করে নাস্তা খেয়ে দুপুর পর্যন্ত ঘুমিয়ে টাঙ্গাইলের গাড়ি ধরেন। এ ছিল আমাদের সম্পর্ক। সৈয়দ নজরুল ইসলামের চার ছেলে- সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম, সৈয়দ শরিফুল ইসলাম ও সৈয়দ সাফায়েতুল ইসলাম, দুই মেয়ে- সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপি ও সৈয়দা রাফিয়া নূর রূপা। ’৬৭-র পর তাদের আর আমরা পর ভাবতাম না। ঢাকা-ময়মনসিংহ রাস্তা তখন টাঙ্গাইলের ওপর দিয়ে। কতবার আমাদের বাড়ি এসেছেন, খেয়েছেন, থেকেছেন হিসাব নেই। মুক্তিযুদ্ধেও সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন আমাদের ত্রাণকর্তা। শুরুর দিকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম আমাকে এক অভাবনীয় ঝামেলা থেকে বাঁচিয়ে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে টাঙ্গাইলে এক অভাবনীয় প্রতিরোধের সূচনা হয়। বদিউজ্জামান খান এমপি চেয়ারম্যান এবং লতিফ সিদ্দিকী এমপিকে আহ্বায়ক করে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। টাঙ্গাইল জেলা গণমুক্তি পরিষদ পাকিস্তানিদের প্রতিরোধ করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল। তারই একপর্যায়ে ৩ এপ্রিল সাটিয়াচরা পাকিস্তান হানাদারদের সঙ্গে আমাদের প্রবল যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানিরা এরকম জায়গায় আক্রান্ত হবে না ভাবার কারণে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছিল। আমাদেরও ১৪-১৫ জন শহীদ হয়। পরে সাটিয়াচরা গ্রামের এবং ঢাকার দিক থেকে আসা আশ্রয় নেওয়া প্রায় ২০০ সাধারণ মানুষকে পাকিস্তানি হানাদাররা বেয়োনেটে খুঁচিয়ে এবং ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। সকালের দিকে সাটিয়াচরা ডিফেন্স ভেঙে গেলে টাঙ্গাইল পুলিশ কোথা থেকে কিছু অস্ত্র নিয়ে পাহাড়ের দিকে গিয়েছিল। সেখানে কমান্ডার ইদ্রিস, খোরশেদ আলম এবং মোক্তারের কাছে অস্ত্র রেখে সীমান্তে যাই। প্রথম দিন সীমান্তে সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। অন্য সময়ের মতো সাধারণ কিছু কথাবার্তা বলে ফুলপুরে ফিরে এসেছিলাম। সেখানে মাসুদের দুলাভাইয়ের বাড়ি রাত কাটিয়ে পরদিন আবার গিয়েছিলাম হালুয়াঘাটে কুদরত উল্যাহ ম-ল এমপির সঙ্গে আলাপ করতে যে সেখান থেকে কিছু সাহায্য পাওয়া গেলে টাঙ্গাইল মুক্ত রাখা না গেলেও মধুপুর পর্যন্ত মুক্ত রাখা গেলে ময়মনসিংহ-ফুলপুর-হালুয়াঘাট নিরাপদ থাকবে। তিনি কত অস্ত্র কত লোক দিয়ে সাহায্য করতে পারবেন এসবের একটা ধারণা দিলে আমি অনেকটা হতাশা হয়ে ফিরে আসছিলাম। তখন ফুলপুরের ওসি মমতাজ উদ্দিন আমাদের পশ্চিম পাকিস্তানি বিহারি আখ্যা দিয়ে ফুলপুর থানায় নিয়ে যায়। খুব সম্ভবত ১৩ জন যোদ্ধা, কয়েক হাজার গুলি ও ১৮টা বন্দুক ছিল আমার গাড়িতে। টাঙ্গাইল ক-৩ একটা টয়োটা জিপ। মমতাজ উদ্দিনকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম। টাঙ্গাইল কোর্ট ইন্সপেক্টর থাকার সময় সে আমাদের বাড়িতে বহুবার ভূরিভোজ করে তৃপ্ত হয়েছে। আমাদের পশ্চিমা মনে হওয়ায় আমি খুবই বিস্মিত ও বিরক্ত হয়েছিলাম। আমার সমান উঁচু লম্বা আমার দলে আর কেউ ছিল না। সিলেটের ফারুক তো ছিল ৫ ফুট।

চারদিকে যুদ্ধবিগ্রহ। পুলিশদের কোনো কাজকর্ম ছিল না। কিছু অবাঙালি ধরেছে। ওসব নেতাকে দেখিয়ে বাহবা কুড়াত। মমতাজ আটক করেছিল সত্য, কিন্তু কোনো উল্টাপাল্টা করেননি। একটু পরে এলেন ময়মনসিংহের নেতা রফিক উদ্দিন ভূইয়া ও মেডিকেল কলেজের ভিপি ডা. হাফিজ। রফিক ভাই বললেন, হাতীপাগার সীমান্তে নেতা নজরুল ইসলাম সাহেব এসেছেন। চলুন সেখানে যাই। ওসিকে নিয়ে আমরা সেখানে গেলাম। আমাকে অবাঙালি বলে গ্রেফতারের কথা শুনে সৈয়দ নজরুল ইসলাম দাদু এমন ক্ষিপ্ত হলেন যে বলার মতো না। তিনি মমতাজকে বললেন, ‘পাকিস্তানের ঘোষখোর, এতদিন পাকিস্তানের দালালি করেছো। এখন আমাদের পশ্চিম পাকিস্তানিদের মতো মনে হয়েছে। সুযোগ পেলে আমাকেও ধরে দিয়ে পাকিস্তানের কাছে প্রশংসা নিবে। যাও এক্ষুনি আমার দাদুভাইয়ের লোকজনকে সসম্মানে ছেড়ে দাও।’ তখন মমতাজের সে কী রূপ, আমাকে পিছনে ফেলে ফুলপুরে ফিরে আমার লোকজনকে সে কী জামাই আদর। আমি ফিরলাম রাত ৮-সাড়ে ৮টায়। সেখান থেকে সোজা ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে। এসে দেখি ডা. মাহমুদ। আমাকে দেখেই, কাদের ভাই, লতিফ ভাই আপনাকে খুঁজছে। লতিফ ভাই কোথায় বলতেই বললেন জামালপুর পিপিআই স্কুলে।

লেখক : রাজনীতিক।

www.ksjleague.com

সর্বশেষ খবর