মানব সভ্যতা বার বার হোঁচট খায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে। ভূমিধসের মতো মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণ যায় মানুষের। ক্ষতি হয় সম্পদের। টানা বৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল, বন্যা এবং অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন ভূমিধসের অন্যতম প্রধান কারণ। আমাদের দেশেও পাহাড়ি অঞ্চলে সম্প্রতি ঘটে গেল স্মরণকালের ভয়াবহ ভূমিধস। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীজুড়ে এমন ভয়াবহ ভূমিধসের ঘটনা সবাইকে বেদনাহত করে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ঘটে যাওয়া তেমন কিছু ভয়াবহ ভূমিধসের ঘটনা নিয়ে লিখেছেন— তানিয়া তুষ্টি ও সাইফ ইমন
রাঙামাটি, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, বাংলাদেশ
১৩ জুন ২০১৭
অতিবৃষ্টির সঙ্গে পাহাড়ধসে ১৩ জুন ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলা চট্টগ্রাম, রাঙামাটি ও বান্দরবান। পাহাড়ধসের এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৪০ জন মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। নিহতদের মধ্যে চারজন সেনা সদস্যও রয়েছেন। আহত হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। পাহাড়ধসে মারা যাওয়া মানুষের মধ্যে রাঙামাটিতে রয়েছেন ১০৫ জন। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছে কয়েকশ মানুষ। বিপর্যয় কবলিত এলাকাগুলোতে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে উদ্ধার অভিযান চলছে। পাহাড়ধসে মানুষের মৃত্যুর পাশাপাশি অনেক বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে। রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে গেছে গাছপালা ভেঙে ও ছোট ছোট টিলাধসে। তবে দুর্গম এলাকা ও বিরূপ আবহাওয়ার কারণে ক্ষয়ক্ষতির পুরো চিত্র এখনো পাওয়া সম্ভব হয়নি। এসব মাটির স্তূপ সরিয়ে বের করে আনা হচ্ছে মানুষের লাশ। এবারের মতো এত ভয়ঙ্কর ধস ও মৃত্যু আগে আর কখনো ঘটেনি। এর আগে ২০০৭ সালে পাহাড়ধসে মারা যান ১২৭ জন।
মরক্কো, কলম্বিয়া
১ এপ্রিল ২০১৭
মরক্কোর পাহাড়ধস ছিল ভয়াবহ রকমের এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়। এটি সংঘটিত হয় ১ এপ্রিল ২০১৭ সালে। পাহাড়ধসের আগের দিন সন্ধ্যা থেকে ওই এলাকায় ভারি বর্ষণ শুরু হয়। আটলান্টিক মহাসাগরের ওপর দিয়ে ধেয়ে আসে আর্দ্র ঝড়ো বাতাস। বিকালের দিকে কয়েক ঘণ্টা ধরে ভারি বর্ষণ চলতে থাকে। তাতে আন্দেয় পর্বতমালার ৫০০ মিটার থেকে ৫০০০ মিটার পর্যন্ত উচ্চতায় ৫০-১০০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বৃষ্টি কবলিত হয়। পরদিন স্থানীয় সময় বেলা ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত তুমুল বৃষ্টিতে ঘটে পাহাড়ধসের মতো ভয়ঙ্কর ঘটনা। এতে প্রাণহানি ঘটে ৩১৬ জনের, গুরুতর আহত হন ৩৩২ জন এবং নিখোঁজ থাকেন ১০৩ জন। অসংখ্য ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ে। ছোট টিলাধসে মাটির নিচে চাপা পড়ে সেসব ঘরবাড়ি, গাছপালা, মানুষজন। মরক্কোর ১৭টি শহরে ৪৫ হাজার মানুষ এই ধ্বংসলীলায় প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। কিছু এলাকার সম্পূর্ণটায় গুঁড়িয়ে যায়। কলম্বোর ইতিহাসে এটি ছিল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সর্বোচ্চ ধ্বংসের ঘটনা।
ইআই কেমব্রে দোজ, গুয়েতেমালা
১ অক্টোবর ২০১৫
গুয়েতেমালা সিটি থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে ইআই কেমব্রে দোজ গ্রামে ভারি বর্ষণের ফলে ঘটে পাহাড়ধসের ঘটনা। ২০১৫ সালের ১ অক্টোবরের এ ঘটনায় ২৮০ জন মানুষ মারা যান এবং নিখোঁজ থাকেন অসংখ্য। গ্রামটি ছিল পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত। এলাকাটি অত্যন্ত ধস প্রবণ থাকায় সরকার বার বার গ্রামবাসীকে নিরাপদ এলাকায় সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। ২০০৮ সালের নভেম্বরে সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশ আসে বিপদ এড়াতে দ্রুত স্থান ত্যাগের। সে সময় কয়েক দিন ভারি বর্ষণ ও বন্যা চলছিল। এতে সে এলাকায় ধসের ঘটনা ঘটে এবং দুজন মারাও যান। তবে ২০১৫ সালের ঘটনায় ওই এলাকার মানুষ মৃত্যুফাঁদে আটকে যায়। কিছু কিছু এলাকা ১৫ মিটার পর্যন্ত মাটির নিচে তলিয়ে যায়। এ ঘটনায় ১২৫টি বাড়ি ধ্বংসের মুখে পড়ে। এতে প্রায় ৪৫০ জন মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হন। পাহাড়ধসের ঘটনায় উদ্ধারকাজ চালানো হয় ভারী মেশিনারি দিয়ে। এ সময় স্থানীয় সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের খাদ্য, বস্ত্র ও আশ্রয় দিয়ে সহায়তা করা হয়।
বাদাকসান, আফগানিস্তান
২৩ এপ্রিল ২০১৫
আরও একটি ভয়াবহ ভূমিধস ঘটে আফগানিস্তানে। ২০১৫ সালের ২৩ এপ্রিল এই ভূমিধস ঘটে বাদাকসানের খাওয়াহান জেলায়। ভয়াবহ এ ভূমিধসের দুই দিন পরই আরও একটি ভূমিধস ঘটে ২৬ এপ্রিল। এতে অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটে। প্রথমবারের ভূমিধসে ৫২ জন মানুষ মৃত্যুবরণ করেন এবং আরও প্রচুর আহত হন। এ ভূমিধসে ১০০টির মতো বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে যায়। ২৬ এপ্রিল আবারও ভূমিধস ঘটলে ১২০টি পরিবার স্থানচ্যুত হয় এবং বহু মানুষ আহত হন। আফগানিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলে প্রায়ই এ রকম ভূমিধস ঘটে থাকে। এটা সে অঞ্চলের বাসিন্দাদের জন্য নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে বাদাকসান ভূমিধসের মতো এমন ভয়াবহ আকারে এর আগে কখনো ঘটেনি। গাছপালা নিয়মিত হারে কমে যাওয়ার দরুন প্রতি বছর ভূমিধসের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছেই আফগানিস্তানে। সেই জোড়া ভূমিধসে কয়েকশ মানুষ মারা যান।
বেনজারনিগারা, ইন্দোনেশিয়া
[ ১৩ ডিসেম্বর ২০১৪ ]
২০১৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাসে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিধসের ঘটনাটি ঘটে। ইন্দোনেশিয়ার সেন্ট্রাল জাভার বেনজারনিগারায় এই ভূমিধস ঘটে। এতে ৯৩ জন মারা যান এবং আরও ২৩ জন মানুষ নিখোঁজ হন। বেনজারনিগারার জেমব্লাং গ্রামে শুক্রবার জুমার নামাজের পরপর এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় আরও বেশকিছু যানবাহনের ক্ষয়ক্ষতি হয়ে কয়েকটি সড়ক বন্ধ হয়ে যায়। এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওটিতে দেখা যায়, একটি বড় পাহাড়ের বিশাল অংশ পুরো গ্রামে আছড়ে পড়ে। এতে ৩০০টি বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে যায়। প্রায় ২০০ মানুষ এই ভয়াবহ ভূমিধস থেকে কোনো রকমে প্রাণে বেঁচে যান। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, এ সময় ভয় পেয়ে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে আরও প্রায় ১০০ মানুষ মারা যান। ২০০৬ সালের পর এত বেশি ক্ষয়ক্ষতি আর কোনো ভূমিধসে ঘটেনি ইন্দোনেশিয়ায়।
মাউন্টেন হেলেন, যুক্তরাষ্ট্র
[ ১৮ মে ১৯৮০ ]
ধারণা করা হয় পৃথিবীর ইতিহাসে এটিই সবচেয়ে বড় ভূমিধস। ১৯৮০ সালের ১৮ মে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের স্কেমানিয়ায় মাউন্টেন হেলেনে একটি ভলকানোর প্রভাবে এই ভয়াবহ ভূমিধসটি ঘটে। এর ফলে প্রায় ৫৭ জন মানুষ মারা যান। ১.১ বিলিয়ন ডলারের ক্ষয়ক্ষতি হয়। কানাডার পাঁচটি প্রদেশসহ আরও ১১টি রাজ্য ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়।