সোমবার, ৭ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা
চলচ্চিত্রকারদের উদ্বেগ

জাতীয় বাজেটে উপেক্ষিত চলচ্চিত্রশিল্প

জাতীয় বাজেটে উপেক্ষিত চলচ্চিত্রশিল্প

২০১২ সালের ৩ এপ্রিল সরকার চলচ্চিত্রকে শিল্প ঘোষণা করে। এতে ভঙ্গুরপ্রায় চলচ্চিত্রের মানুষ আশা করেছিলেন এবার বুঝি শিল্পটি ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু না, চলচ্চিত্রকারদের ক্ষোভ এখন পর্যন্ত শিল্পের কোনো সুযোগ-সুবিধা তো পায়নি এমন কি জাতীয় বাজেটেও উপেক্ষিত চলচ্চিত্রশিল্প। এ নিয়ে চলচ্চিত্রকারদের উদ্বেগের কথা তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

বাজেটে বরাদ্দ চাই

কাজী হায়াৎ

২০১২ সালে সরকার চলচ্চিত্রকে শিল্প ঘোষণা করলে চলচ্চিত্রের মানুষের মধ্যে এই আশার সঞ্চার হয়েছিল যে, এবার বুঝি শিল্পটি ধ্বংসস্তুপ থেকে সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে। কিন্তু না, তা আর হয়নি। কোনো ক্ষেত্রেই আজ পর্যন্ত চলচ্চিত্রশিল্পের কোনো সুবিধা পায়নি। এমন কি জাতীয় বাজেটেও এর জন্য কোনো সুযোগ-সুবিধা কখনো রাখা হয় না। একটি শিল্প দুস্থ হয়ে পড়লে একে সরকার প্রণোদনা, আর্থিক সহযোগিতা, বাণিজ্যিক ঋণসহ সব ধরনের সহায়তা দিয়ে থাকে। যা চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত করা হয়নি। এভাবে বাংলাদেশের এই প্রধান গণমাধ্যমটি বরাবরই সরকারি শিল্প সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। এ দেশের ১৭-১৮ কোটি মানুষের বিনোদন হচ্ছে চলচ্চিত্র। আমি প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ রাখব, চলতি অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট সংশোধন করে এতে চলচ্চিত্রশিল্পের উন্নয়নে যেন একটি বরাদ্দ অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

 

সর্বক্ষেত্রেই শিল্প সুবিধাবঞ্চিত

সুদীপ কুমার দাস

চলচ্চিত্রকে শিল্প ঘোষণা করার দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও শিল্পের সুবিধার ছোঁয়া এখনো পায়নি এটি। সিনেমা হলের বিদ্যুৎ বিল বাণিজ্যিক হারের পরিবর্তে শিল্প হারে নেওয়া, নতুন করে সিনেমা হল ও সিনেপ্লেক্স নির্মাণে যন্ত্রপাতি আমদানিতে উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ প্রত্যাহার করে শিল্প খাতের সুবিধায় শুল্ক নির্ধারণসহ একাধিক বিষয়ে  বছরদুয়েক আগে চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি তথ্য মন্ত্রণালয়ে একটি আবেদন করে। এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তথ্য মন্ত্রণালয় বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়কে সিনেমা হলের বিদ্যুৎ বিল বাণিজ্যিক হারের পরিবর্তে শিল্প হারে নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনার জন্য অনুরোধ জানায়। কিন্তু দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের কোনো সাড়া না পেয়ে দ্বিতীয়বার তথ্যমন্ত্রী বিদ্যুৎমন্ত্রীকে গত বছর এ ব্যাপারে আবার তাগাদা দিলে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী জানান, এটি রেগুলারিটি কমিশনের কাছে পাঠানো   হয়েছে। সেখান থেকে অনুমোদন পেলে  আমরা বিষয়টি ইস্যু করে দেব। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি প্রায় এক বছর  পেরিয়ে গেলেও এর আর কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি।

অন্যদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এইচএস কোডে মূলধন যন্ত্রপাতি আমদানি এবং আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি আমদানিতে শিল্প হারে বিরাট ছাড় দেওয়া হয়। কিন্তু সিনেমা হলের ক্ষেত্রে এই ছাড় কার্যকর হচ্ছে না মূলত জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে কার্যকর সমন্বয়ের অভাবে। সিনেমা হল যদি শিল্প সুবিধা পায় তাহলে একটি সিনেমা হল বা সিনেপ্লেক্স আধুনিকায়নে কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকার রেয়াতি সুবিধা পাওয়া যাবে।

এদিকে, চলচ্চিত্রকে শিল্প ঘোষণার কারণে ন্যূনতম মজুরি বোর্ড গঠন করে সিনেমা হল শিল্প শ্রমিকদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রের জন্য নির্ধারিত হার ধার্য করে গেজেট জারি করার কারণে সিনেমা হল মালিকদের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এতে চলচ্চিত্রকে শিল্প ঘোষণায় খুশির বদলে প্রদর্শকরা উল্টো বিরক্ত হয়েছেন।

 

শিল্প ঘোষণার পরও অবহেলা কেন                           

আবু মুসা দেবু

চলচ্চিত্রকে ২০১২ সালে শিল্প ঘোষণা করা হয়। এটি ছিল আশার কথা। কিন্তু বাস্তবে এত বছর ধরে কি দেখছি? জাতীয় বাজেটসহ সর্বক্ষেত্রে চলচ্চিত্র উপেক্ষিত, সুবিধাবঞ্চিত। জাতীয় বাজেটে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যে বরাদ্দ রাখা হয় তার সবটাই পায় ফিল্ম আর্কাইভ, টেলিভিশন ও রেডিও। এফডিসি প্রতিষ্ঠালগ্নে বঙ্গবন্ধু চলচ্চিত্রের মানুষকে বলেছিলেন তোমরা এই মাধ্যমটিকে দাঁড় করাতে পারবে তো?  আমরা পেরেছি।

কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া এই প্রধান গণমাধ্যম এবং এর সঙ্গে যুক্তরা আজ অবহেলিত কেন। যাঁরা শিল্পী তৈরি করেন সরকারের কাছে তাঁদেরও কোনো মূল্যায়ন নেই। প্রায় ৬০ বছর ধরে একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সম্পাদক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু জীবনের শেষ বেলায় এসে আজ কতটা মূল্যায়ন পেলাম।

এফডিসির প্রশাসনে অযোগ্য লোকদের বসানো হয়। এখানে অডিট হয় না। কাজ বা আয়- ব্যয়ের কোনো জবাবদিহিতাও নেই। ফলে চলচ্চিত্রের অবনতি ঠেকানো যাচ্ছে না।

সরকার যদি চলচ্চিত্রকে সম্পূর্ণরূপে শিল্পের সুবিধা দেয় তাহলে এখনো সময় আছে এই শিল্পটির ঘুরে দাঁড়ানোর।

 

চলচ্চিত্র সব শিল্প সুবিধাবঞ্চিত

খোরশেদ আলম খসরু

২০১২ সালের ৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী চলচ্চিত্রকে শিল্প ঘোষণা করেন। একই দিন জাতীয় চলচ্চিত্র দিবসও ঘোষণা করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী তথ্য মন্ত্রণালয়ে সারপ্রাইজ ভিজিট করেন এবং সেখানে শিল্প ঘোষণার অগ্রগতি জানতে চান। সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালে শিল্পের নীতিমালা নিয়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ে একটি মিটিং হয়। ব্যস ওই পর্যন্তই। এর আর কোনো অগ্রগতির খবর আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। গত বছর থেকে করোনায় চলচ্চিত্রশিল্প বিধ্বস্ত। গত বছরের জাতীয় বাজেটে ৫৭৯ কোটি টাকা পায় তথ্য সম্প্রচার কেন্দ্র। এবার পেয়েছে ৫৮৭ কোটি টাকা। গতবারের চেয়ে এবার ৮ কোটি টাকা বেশি হলেও এই অর্থ কিন্তু চলচ্চিত্রশিল্প পায় না। তা দেওয়া হয় ফিল্ম আর্কাইভ, জাতীয় বেতার ও টেলিভিশনকে। শিল্প হিসেবে চলচ্চিত্রকে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণও দেওয়া হয় না। মানে শিল্প হয়ে শিল্পের সুবিধাবঞ্চিত রয়েছে চলচ্চিত্র, যা সত্যিই অত্যন্ত দুঃখজনক।

 

আমরা খুবই হতাশ

কাজী শোয়েব রশিদ

চলচ্চিত্র একটি শিল্প হলেও এখন পর্যন্ত শিল্প সুবিধাবঞ্চিত রয়েছে এই শিল্পটি। এতে আমরা চলচ্চিত্রের মানুষ খুবই হতাশ। চলচ্চিত্র হচ্ছে এ দেশের প্রধান গণমাধ্যম। একসময় ১ হাজার ২০০রও বেশি সিনেমা হল ছিল। প্রদর্শকরা ভ্যাট, ট্যাক্স সবই দিয়ে আসছি। এটিতে শিল্প সুবিধা না থাকায় চলচ্চিত্র এখন রুগ্ন শিল্পে পরিণত হয়েছে। আমরা আশাবাদী ছিলাম চলচ্চিত্রশিল্পের সুবিধায় আবার ঘুরে দাঁড়াবে, প্রাণবন্ত হবে। কিন্তু তার কোনো লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এটি বাধাগ্রস্ত হয়ে আসছে। চলচ্চিত্রের উন্নয়নে জাতীয় বাজেটে সব ধরনের শিল্পসুবিধা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের কাছে  আবেদন জানাচ্ছি।

সর্বশেষ খবর