আজ অবধি অসংখ্য বাঙালি অভিনেতা, অভিনেত্রী, পরিচালক, টেকনিশিয়ান বলিউডে তাঁদের অসাধারণ কাজের চিহ্ন রেখেছেন। কিন্তু আজ কথা বলব শুধু সংগীতাঙ্গনের কথা। নিজেদের কণ্ঠ ও সুর দিয়ে বলিউডে তাঁরা কেবল সুনামই কুড়াননি, রীতিমতো ইতিহাস গড়েছেন।
♦ শচীন দেব বর্মণ
কুমিল্লার ছেলে শচীন দেব বর্মণ। কলকাতায় রেডিওতে শিল্পী হিসেবে কাজ শুরু করেন। প্রথমে বাংলা ছবিতে সংগীত পরিচালক হিসেবে যাত্রা শুরু, পরে বলিউড সংগীতে ১৯৪৬ থেকে ১৯৭৫ অবধি একাধারে শিল্পী ও সুরকার হিসেবে তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করেন। সেরাদের সেরা একজন সংগীতজ্ঞ তিনি। বলিউড সংগীতে তাঁর অবদান অপরিসীম।
গীতা দত্ত
♦ গীতা দত্ত
ফরিদপুরে এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে জন্ম। পরে কলকাতা হয়ে মুম্বাই স্থায়ী হয়ে ১৯৪৬ থেকে ক্যারিয়ার শুরু করেন। অসম্ভব মিষ্টি কণ্ঠের অধিকারী, সমসাময়িক অন্যদের থেকে ছিলেন অধিক গুণসম্পন্ন। কিন্তু ব্যক্তিজীবন বারবার আঘাত হেনেছে তাঁর ক্যারিয়ারে এবং মাত্র ৪১ বছর বয়সে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে পরলোকগমন করেন।
মান্না দে
♦ মান্না দে
বাংলার আরেক রত্ন প্রবোধ চন্দ্র দে, যাকে আমরা চিনি মান্না দে নামে। জন্ম কলকাতায়। কাকা সংগীতজ্ঞ কৃষ্ণ চন্দ্র দের অনুপ্রেরণায় গানের ভুবনে প্রবেশ এবং মুম্বাই যাত্রা। ১৯৪২ থেকে শুরু করেন প্লেব্যাক, ক্ল্যাসিকাল মিউজিকে ছিলেন খুব দক্ষ, সঙ্গে ফিল্ম মিউজিকেও অসাধারণ। ১৯৭৬ অবধি ছিলেন নিয়মিত, পরবর্তীতে টুকটাক ফিল্ম, অ্যালবাম, ভজন, গজল গাইতেন।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়
♦ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়
অসম্ভব সুন্দর পুরুষ কণ্ঠের তালিকা করতে গেলে হেমন্ত কুমার আসবেন প্রথম দিকেই। রবীন্দ্রসংগীতে এক অন্য মাত্রা দিয়েছেন তিনি। জন্ম বারানসি মামার বাড়ি, পিতৃঘর কলকাতায়। রেডিওতে কাজ শুরু করেন প্রথমে, পরে বাংলা ফিল্মে শিল্পী ও সংগীত পরিচালক হিসেবে তুমুল জনপ্রিয় হন। বলিউডে শুরু ১৯৪৪ সালে, পরে মুম্বাইয়ের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে প্রচুর কাজ করেন। ফিল্ম প্রযোজনাও করা হয়েছিল।
আর ডি বর্মণ
♦ আর ডি বর্মণ
বাবার যোগ্য উত্তরসূরি। জন্ম কলকাতায়। ৯ বছর বয়সেই প্রথম গানের জন্য সুর বানিয়ে ফেলেন। বাবার সঙ্গে সহকারী হয়ে কাজ শুরু। পরবর্তীতে ১৯৬১ থেকে পুরোদমে সংগীত পরিচালক হিসেবে যাত্রা শুরু। বলিউড সংগীতে অনেক নতুনত্ব এনেছেন তিনি। তাঁর কম্পোজিশনে ছিল অনেক বৈচিত্র্য। যেমন করেছেন ক্ল্যাসিকাল, রোমান্টিক তেমনই করেছেন রক, পপ মিউজিকের প্রচলন বলিউডে। শেষের দিকে এই গুণী যথাযোগ্য কদর পাননি, যা তাঁর প্রাপ্য ছিল।
♦ সলিল চৌধুরী
সংগীত জগতের আরেক নক্ষত্র সলিল চৌধুরী। একাধারে সংগীতজ্ঞ, কবি, গল্প লেখক। জন্ম কলকাতায়। বাংলা ফিল্মে শুরুর পর ১৯৫৩ থেকে হিন্দি ফিল্মে সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু। কাজ করেছেন অনেক হিন্দি, বাংলা, মালায়ালাম ছবিতে। তাঁর বিশেষত্ব ছিল- তাঁর তৈরি সুর যেমন সমৃদ্ধ তেমনই ছিল শ্রুতিমধুর। তা কখনো পুরনো হওয়ার নয়। লতা মঙ্গেশকরকে অসাধারণ সব গান উপহার দিয়েছেন তিনি।
কিশোর কুমার
♦ কিশোর কুমার
আভাস কুমার গাঙ্গুলী ওরফে কিশোর কুমার। বাংলার দেওয়া বলিউডকে সর্বোত্তম উপহার। জন্ম খান্ডবা মধ্যপ্রদেশে। কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াও সংগীতে তিনি ছিলেন দক্ষ এবং অভিনয়েও। প্রথম হিন্দি গান ১৯৪৮-এ গাওয়া হলেও তখন তিনি অভিনয়ে নিয়মিত হয়ে পড়লেন ভাইয়ের ইচ্ছায়। তাঁর বড় ভাই অশোক কুমার তখন খুব জনপ্রিয় নায়ক। পরবর্তীতে এস ডি বর্মণ তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হন এবং প্রয়োজনীয় তালিম ও উৎসাহ দেন। যা তাঁর সংগীতজীবনকে করে ধাবমান এবং আমরা পাই মহান এক গায়ক।
♦ কুমার শানু
কিশোর কুমারের জন্ম কলকাতায়। পরে মুম্বাইয়ে আগমন। সেখানে সংগীত পরিচালক কল্যাণজি-আনন্দজির সঙ্গে পরিচয় হয়। তাঁদের পরামর্শেই নাম পরিবর্তন। কিশোর কুমারের সঙ্গে কণ্ঠ এবং গানের ধরনে মিল থাকায় মিলিয়ে রাখা হয় কুমার শানু। কিছু গান আগে করলেও ১৯৯০ সালের আশিকি ছবিতে গান গেয়ে হয়ে যান রাতারাতি সুপারস্টার। সংগীত পরিচালকদের প্রথম পছন্দই তখন তিনি। পেয়েছেন প্রচুর সাফল্য। গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডেও নাম লেখান এক দিনে সর্বোচ্চ ২৮ গান গেয়ে।
বাপ্পী লাহিড়ী
♦ বাপ্পি লাহিড়ী
বলিউডের ডিসকো কিং আরেক বাঙালি অলোকেশ লাহিড়ী ওরফে বাপ্পি লাহিড়ী। বলিউডে ডিসকো গানের জনপ্রিয়তায় তাঁর ভূমিকা অনেক। জন্ম জলপাইগুড়িতে, এক সংগীত সমৃদ্ধ পরিবারে। পিতা-মাতার কাছ থেকেই সংগীতের দীক্ষা নেন। ১৯৭৩ থেকে সংগীত পরিচালক ও শিল্পী হিসেবে বলিউডে আত্মপ্রকাশ করেন। ডিসকোর সঙ্গে সঙ্গে রোমান্টিক, ক্ল্যাসিকালেও তিনি সমান পারদর্শী ছিলেন এবং জনপ্রিয়তার চরমে পৌঁছে ছিলেন।
♦ অভিজিৎ ভট্টাচার্য
নব্বইয়ের দশকে আরেক বাঙালি বলিউডকে তাঁর সুরে মূর্ছিত করে। তিনি হলেন অভিজিৎ ভট্টাচার্য। জন্ম কানপুর, উত্তর প্রদেশে। আর ডি বর্মণের সুরে শুরু বলিউডে, কিন্তু সফলতা পান ১৯৯১-এর বাঘি ফিল্মে গান গেয়ে। প্রতিযোগিতা ছিল অনেক, তবুও তিনি আলাদা একটা স্থান করে নিয়েছেন বলিউডে। প্রচুর গান করেছেন। অনেক হিট অ্যালবামেও কাজ করেছেন।
♦ প্রীতম চক্রবর্তী
২০০০-এর পরবর্তী সময়ে বলিউডের খুব সফল এক সুরকার বাঙালি প্রীতম চক্রবর্তী। জন্ম কলকাতায়, বিজ্ঞাপন এবং টিভি সিরিয়ালে সুর দেওয়ার মধ্য দিয়ে কাজ শুরু। আরেক বাঙালি সফল সুরকার জিৎ গাঙ্গুলীর সঙ্গে জুটি হয়ে ২০০১ থেকে বলিউডে কাজ শুরু। পরে অবশ্য তাঁরা আলাদা হয়ে যান। ২০০৪-এর ধুম ছবির গান তাঁকে বিশাল সাফল্য এনে দেয়, এরপর শুধুই সফলতা, যা এখনো বিদ্যমান।
♦ শান
শান্তনু মুখার্জি ওরফে শান। ২০০০-এর পরবর্তী সময়ের রোমান্টিক এক বাঙালি গায়ক। জন্ম কলকাতায়, বাবা মানস মুখার্জিও ছিলেন সুরকার। মাত্র ১৩ বছর বয়সে বাবাকে হারান। বিজ্ঞাপনে কণ্ঠ দেওয়ার মাধ্যমে অল্প বয়সেই কাজ শুরু। বোন সাগরিকার সঙ্গে মিলে কিছু হিট অ্যালবামেও কাজ করেছেন। ১৯৮৯-এ যখন বয়স ১৭, পারিন্দা ফিল্মের একটি গানে কয়েকটি লাইন গাওয়া হয়। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে বলিউড ক্যারিয়ার শুরু ১৯৯৯ থেকে। এরপর রোমান্টিক গায়ক হিসেবে ব্যাপক সুনাম অর্জন।
♦ শ্রেয়া ঘোষাল
বর্তমান সময়ে বলিউডসহ পুরো ভারতের সব ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি যার অমৃতসম কণ্ঠে মোহিত, তিনি বলিউডের সবচেয়ে সফল বাঙালি গায়িকা শ্রেয়া ঘোষাল। জন্ম মুর্শিদাবাদে, পূর্বপুরুষদের ভিটা আমাদের বিক্রমপুরে। সারে গা মা পা মিউজিক কন্টেস্টে জয়ী হওয়ার পর সঞ্জয় লীলা বানসালি ২০০২-এ সুযোগ দেন দেবদাস ছবিতে গান গাওয়ার। আসলে তার মা লীলা বানসালির নজরে আসেন ঘোষাল প্রথমে, পরে সঞ্জয় লীলা বানসালি খুঁজে বের করেন ঘোষালকে এবং দেবদাসের পর শুধুই সফলতার ইতিহাস।