মঙ্গলবার, ৭ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

বদলাচ্ছে সিনেমার গল্প, বাড়ছে দর্শক আগ্রহ

আলাউদ্দীন মাজিদ

বদলাচ্ছে সিনেমার গল্প, বাড়ছে দর্শক আগ্রহ

চলচ্চিত্রকার আর দর্শকদের একটিই কথা- ‘ভালো গল্প আর মানসম্মত ছবি পেলে দর্শক তা সাদরে গ্রহণ করে।’ সম্প্রতি আবারও এই কথার প্রমাণ মিলেছে। বিশেষ করে ঈদে মুক্তি পাওয়া ‘গলুই’ ও ‘শান’ ছবি দুটি বেশি পরিমাণে দর্শক দেখেছে। দর্শকরা দেখে তাদের প্রতিক্রিয়ায় বলেছে দুটি গল্পেই জীবন বোধের ছায়া ছিল। গলুইতে ওঠে এসেছে গ্রামবাংলার চিরন্তন রূপ আর সংস্কৃতি। আর শানের গল্পে ফুটে ওঠেছে মানব পাচারের মতো বিবেকবোধহীন অর্থলিপ্সুদের অপতৎপরতার চিত্র ও এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহসিকতা। ঈদে মুক্তি পাওয়ার প্রায় ১ মাস পরও ছবিগুলো প্রদর্শিত হচ্ছে এবং দর্শক দেখছে। এ দুই ছবির পর মুক্তি পায় আরও দুটি ছবি। এগুলো হলো ‘পাপ-পুণ্য’ এবং ‘আগামীকাল’। পাপ-পুণ্য একশ্রেণির দর্শকের বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে। ছবিটি দেখে রমিজ নামে এক দর্শক তার ফেসবুক পেজে লিখেছেন- ‘পাপ-পুণ্য দেখলাম। অনেক দিন পর কোন বাংলা ছবি সত্যিকারার্থে ভালো লেগেছে। সেলিমের সহজ-সরল গল্প, চিত্রনাট্য আর স্লো গতি তো প্রত্যাশিতই ছিল, তবে ছবির মেকিং, অভিনয়, চরিত্রগুলো, লোকেশন উপভোগ করেছি আমি। যারা অফট্র্যাকের ছবি উপভোগ করেন তাদের সবার দেখা উচিত এ ছবি। এরকম পরিচ্ছন্ন ছবি বাংলা সিনেমায় রোজ রোজ মেলে না।’ এদিকে ‘আগামীকাল’ ছবিটিও দর্শক মন কেড়েছে বলে এই ছবির নির্মাতা অঞ্জন আইচ বলেন, ত্রিভুজ প্রেমের রোমাঞ্চকর গল্পে নির্মিত এই ছবিটিতে শুধু প্রেম নয়, যাপিত জীবনের মনস্তাত্ত্বিক কিছু দ্বন্দ্ব যা প্রায় পরিবারেই দেখা যায় তা মর্মস্পর্শীভাবে ছবিটিতে তুলে ধরতে পেরেছি বলেই আজ দর্শকদের আমি সন্তুষ্ট করতে পেরেছি। আমার মনে হয়েছে আমি যা বলতে চেয়েছি দর্শক তাতে তাদের পারিপার্শ্বিকতার চিত্র খুঁজে পেয়েছে, আর এখানেই একজন নির্মাতার সফলতা।

সম্প্রতি কয়েকটি ছবিতে জীবন বোধের ছবি ওঠে আসা এবং দর্শক তা সাদরে গ্রহণ করায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র নির্মাতা সৈয়দ অহিদুজ্জামান ডায়মন্ড বলেন, বদলে যাচ্ছে ঢাকাই সিনেমার গল্প। সময়ের পথে হেঁটে নতুনত্বের কাঁধে ভর করে এ বদলের হাওয়া লেগেছে। উদ্ভট ও অবাস্তব গল্পের পরিবর্তে জীবনের গল্প নিয়ে যেসব ছবি নির্মাণ হচ্ছে সেগুলো নির্দ্বিধায় দর্শকগ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। আসলে আমাদের দেশে মৌলিক ও জীবনধর্মী গল্পের অভাব নেই। দর্শক চলচ্চিত্রে নিজের পারিপার্শ্বিকতাকে দেখতে চায়। আয়নায় আপন চেহারা দেখার মতো যখন ছবিতে নিজেদের চিরচেনা জীবনচিত্র খুঁজে পায় তখনই তারা সেই ছবি দেখতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। আর তখনই ছবিটি সফল হয়, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মাননায় ভূষিত হয়। এসব ছবিতে থাকে নিজ দেশের কৃষ্টি ও কালচারের জয়গান। আর এমন গল্পের ছবি বদলে দেবে দেশীয় চলচ্চিত্রকে।

কিছুদিন আগে কয়েকটি বিদেশি পত্রিকা বাংলাদেশের তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতা ও তাঁদের নির্মিত চলচ্চিত্রের প্রশংসা করে প্রতিবেদন ছেপেছিল। সেই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘বলিউড বা হলিউড কিংবা অন্য কোনো দেশের চলচ্চিত্রকে অনুকরণ না করে বাংলাদেশের তরুণ নির্মাতারা গল্প বলার ক্ষেত্রে নিজস্ব ভঙ্গি তৈরি করেছেন। পত্রিকাগুলোর মধ্যে ‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল ডেইলি স্ক্রিন’ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এর শিরোনাম ছিল ‘বাংলা চলচ্চিত্রের পালে নতুন হাওয়া লেগেছে।’ প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের নির্মাতারা এখন ভিন্ন আঙ্গিকে গল্প বলছে। এটা ওই দেশের সিনেমার জন্য শুভ লক্ষণ। পত্রিকাগুলোর প্রতিবেদনে তরুণ চলচ্চিত্রকারদেরও প্রশংসা করে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের দিনবদলের হাতিয়ার এখন তাঁদেরই হাতে।’

দীর্ঘদিন পর ভালো গল্পের ছবি পেয়ে সিনেমা হলে ভিড় জমিয়েছে দর্শক। আসলে কেমন গল্পে সিনেমা হলে ফিরবে দর্শক? এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন কয়েকজন চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র গবেষক ও সাংবাদিক অনুপম হায়াতের কথায় চলচ্চিত্র মানে জীবনের ছায়া। চলচ্চিত্রে ফুটে উঠবে যাপিত জীবনের পারিপার্শি^কতা। যা দেখে দর্শক তার আশপাশের চিত্র খুঁজে পেয়ে মুগ্ধ, আবেগপ্রবণ বা আনন্দিত হবেন। এ জন্য সমসাময়িক জীবনের গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে। এখন গল্পকারের আকাল চলছে। খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা ও গীতিকবি গাজী মাজহারুল আনোয়ার আক্ষেপ করে বলেন, আশির দশকের মধ্যভাগের পর দেশীয় চলচ্চিত্র থেকে গল্প উধাও হয়ে গেছে। এর কারণ তখন এ দেশে ভিসিআরে হিন্দি ছবি দেখা শুরু হয়। কতিপয় নির্মাতা মৌলিক গল্পবিবর্জিত হিন্দি ছবির অনুকরণ আর নকল করতে গিয়ে গাঁজাখোড়ি ছবি নির্মাণ করে দর্শকদের মনে বাংলা ছবির প্রতি বিরক্তি উৎপাদন করে ছাড়েন। এরপর শুরু হয় অশ্লীলতার দাপট। মাঝে মধ্যে দুই-একটি পারিবারিক গল্পের জীবনঘনিষ্ঠ ছবি নির্মাণ হলেও পরিমাণে তা খুবই স্বল্প। আর এই ভালো ছবিগুলোই খরার মাঝে স্বস্তির বৃষ্টি বয়ে আনে। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সুচন্দা বলেন, আমাদের চলচ্চিত্রের সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে। এই সমৃদ্ধতা গড়ে ওঠেছে নিজস্ব গল্প, সংস্কৃতির ছাপ আর পারিপার্শ্বিক ছায়ার ওপর ভর করে।  এ কারণেই এ দেশের ছবি একসময় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসায় ভাসত, দেশের দর্শক আনন্দ-উচ্ছ্বাস নিয়ে ছবিঘরে ছুটে গিয়ে নিজের জীবনকে রুপালি পর্দায় খুঁজে পেয়ে তৃপ্ত হতো। সেই অবস্থা ফেরানো কঠিন নয়, বিবেক আর মেধাই এর জন্য যথেষ্ট। সঙ্গে দেশপ্রেম যুক্ত হলে একজন নির্মাতা অবশ্যই একটি মানসম্মত দেশি ছবি নির্মাণ করতে পারবেন আর দর্শক সেই ছবি পেয়ে নির্র্দ্বিধায় সিনেমা হলে ফিরবে।

সর্বশেষ খবর