বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে যাওয়া করোনা মহামারীর কালো ছায়া গত মার্চ মাসে প্রবেশ করে বাংলাদেশে। নিরাপত্তার স্বার্থে বন্ধ হয়ে যায় দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। থেমে যায় বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক সংস্কৃতি চর্চা। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর কর্মকান্ডও স্থবির হয়ে যায় করোনা আতংকে। তবে নতুন পরিবর্তমান জগতের সাথে মানিয়ে নেয়ার অদ্ভুত সক্ষমতা প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের মাঝে রয়েছে। সেই প্রেক্ষিতে নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ভিন্ন রূপে আবারও সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করেছে সংগঠনগুলো।
শাবিপ্রবির অন্যতম সাংস্কৃতিক সংগঠন আজ মুক্তমে র সভাপতি সুমাইয়া আলম চৌধুরী করোনার প্রথম দিকের পরিস্থিতি তুলে ধরে বলেন, করোনাকালীন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর কাজ স্থগিত হয়ে যায়। দিনের ক্লাস-ল্যাব শেষে সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ সংগঠনগুলোর বিভিন্ন অনুশীলন অথবা গান-আড্ডায় মুখরিত হতো। সেই সময়গুলো এখন শুধুই স্মৃতি।
প্রথম দিকের করোনা আতংক ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যাওয়ায় সংগঠনগুলো কর্মকাণ্ডে নতুন সূচনা দেখা দিচ্ছে। সাস্ট ক্যারিয়ার ক্লাবের সভাপতি ইমরান হোসেন নিজের সংগঠনের কর্মকাণ্ড নিয়ে বলেন, সার্বক্ষণিক অনিশ্চয়তার মধ্যে থেকে এসময় আমাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে নিয়ে যাওয়া চ্যালেঞ্জ ছিলো বটে। তবে সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে কয়েকটি অনলাইন ভিত্তিক ক্যারিয়ার ডেভোলপমেন্ট ইভেন্ট সফলভাবে পরিচালনা করি।
প্রাথমিক প্রতিবন্ধকতা: অনলাইনের মাধ্যমে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার নানা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে বলে মনে করেন চোখ ফিল্ম সোসাইটির সভাপতি ফাহিম আল হৃদয়। তিনি বলেন, আমাদের দেশ সর্ব পরিসরে এখনো তথ্য প্রযুক্তিতে সনিভর্র হয়ে উঠেনি। সেই সাথে দুর্বল ও ও ব্যায় বহুল ইন্টারনেট বা ওয়াই-ফাই কানেকশনের মাধ্যমে অনলাইন প্রোগ্রাম ম্যানেজমেন্ট অনেক কঠিন। অনেক সময় অনলাইন প্রোগ্রামে দর্শকও কম হয়। তবে অনলাইন স্ট্রিমিং প্লাটফর্ম ও সরকারের সহায়তার মাধ্যমে এ থেকে উত্তরণ সম্ভব।
একই মত প্রকাশ করেছেন সাস্ট সাহিত্য সংসদের সভাপতি শাহ্নীল জুলকারনাইন। তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ উচ্চগতির ইন্টারনেট সুবিধার আওতায় না থাকায় অনেকক্ষেত্রেই অনলাইনে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের পরিমাণ কম দেখা যায়।
বদলে যাচ্ছে সাংগঠনিক কার্যক্রমের ধরণ: নানা প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও ফেসবুক, জুমসহ বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্মগুলোই সাংগঠনিক চর্চার নতুন মাধ্যম হিসেবে আর্ভিভূত হচ্ছে। অনলাইন সাংগঠনিক কার্যক্রম ও ভবিষ্যতে সংগঠনগুলো কি ধরনের চ্যালেঞ্জ এবং পরিবর্তনের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে তা নিয়ে কথা বলেন শাবিপ্রবির বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
মাভৈঃ আবৃত্তি সংসদ সভাপতি অংকিতা দাশগুপ্তা বলেন, আমাদের কাজগুলো ক্যাম্পাসে না থেকে পরিচালনা করা অনেকটাই কঠিন ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে বর্তমান পরিস্থিতি মেনে নিয়েই অনলাইনে আমরা বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে যাই। গত কয়েকমাসে আমরা অনলাইনে ঈদ আড্ডা, আবৃত্তি কর্মশালা, মাসিক ম্যাগাজিন প্রকাশ, দুইটি আবৃত্তি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ও অসহায়দের মাঝে আর্থিক সহায়তা প্রদান করি।
মহামারীর মাঝে সংগঠনের মিটিং ও বিভিন্ন সেবামূলক কাজ অনলাইনে সারলেও ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় ক্যাম্পাস কেন্দ্রীক প্রধান কার্যক্রমগুলো নিয়ে বিপাকে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম দুইটি মিউজিক্যাল ক্লাব নোঙর ও রিম। তবে ক্যাম্পাস খুললে সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে ও নিরাপত্তা সামগ্রীর ব্যবস্থা গ্রহণ করে নিজেদের স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু করতে পারবে বলে আশা করছেন রিমের সাধারণ সম্পাদক শামিউল ইসলাম নাহিন ও নোঙরের সাংগঠনিক সম্পাদক এস.এম.ইশতিয়াক।
সাস্ট সায়েন্স অ্যারেনার সভাপতি আমেনা বেগম বলেন, বিভিন্ন সময় নেটওয়ার্ক জনিত সমস্যার সম্মুখীন হলেও আমরা অনলাইনে বিজ্ঞানভিত্তিক বিভিন্ন আলোচনা অনুষ্ঠান, প্রবলেম সলভিং প্রতিযোগিতা ও গবেষণা সংক্রান্ত অনলাইন কোর্সের আয়োজন করি।
অনলাইনে ফটো আড্ডা ও ভার্চুয়াল গ্যালারিতে ফটো এক্সিবিশনের আয়োজন করা হয়েছে বলে জানান শাহজালাল ইউনিভার্সিটি ফটোগ্রাফারস এসোসিয়েশন সাধারণ সম্পাদক প্রেমরাজ সাহা।
ট্যুরিস্ট ক্লাব সাস্টের সভাপতি মো. দিদারুল ইসলাম বলেন, করোনা ঝুঁকির কারণে ট্যুর বন্ধ থাকায় লকডাইনের পূর্বে এবং পরে কীভাবে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখবে পর্যটন খাত, তদুপরি প্রকৃতি পর্যটকদের বাড়তি চাপ সামাল দিতে পারবে কিনা তা নিয়ে বর্তমানে আমরা কাজ করছি।
করোনার মধ্যেই শিকড় "চিত্রচর্যা- অন্তর্জাল আলেখ্য প্রদর্শনী" নামক চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন করেছে যেখানে ৫৭টি ছবি প্রদর্শনীর জন্য বিবেচিত হয় বলে জানান সাধারণ সম্পাদক ইশরাক গালিব।
এদিকে ভবিষ্যতে নতুন রূপে সাংগঠনিক কাজের চর্চা শুরু হবে বলে মনে করেন কার্টুন ফ্যাক্টরির সাধারণ সম্পাদক মাইশা আনান প্রভা। তিনি বলেন, ক্যাম্পাস খুললেও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই আমরা সকল ইভেন্ট পরিচালনা করবো। ক্যাম্পাসে প্রদর্শনীর ক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব অবশ্যই বজায় থাকবে এমন টেন্টের নকশা করার ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত আমাদের। পাশাপাশি অনলাইন প্রদর্শনীও থাকবে।
মহামারি কালে বিভিন্ন অনলাইন কার্যক্রমের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র খেলাধুলা বিষয়ক সংগঠন স্পোর্টস সাস্ট শিক্ষার্থীদের শারিরীক ও মানসিক উৎকর্ষতা উন্নয়নের চেষ্টা করে যাচ্ছে। সংগঠনটির সভাপতি জিল্লুর রহমান দিদার জানান, বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর প্রশাসনের সহায়তা পেলে আমরা যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে মাঠ কেন্দ্রিক খেলাধুলা কার্যক্রম চালিয়ে যাবে। তবে এক্ষেত্রে খেলোয়ার ও দর্শক সকলকেই সচেতন থাকতে হবে।
দিক থিয়েটারের সভাপতি অনিক সাহা বলেন, করোনার কারণে নাট্যকর্মীদের নিয়মিত মহড়ায় বাঁধা একটি অন্যতম সমস্যা। স্বাস্থ্যবিধি মেনে ভবিষ্যতে নাটকে দর্শক উপস্থিতি বৃদ্ধি করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিবে।
অনলাইনভিত্তিক বির্তকের নতুন ভবিষ্যত : শাবিপ্রবির বির্তক জগতের দুইটি সংগঠন হচ্ছে শাহজালাল ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটি (এসইউডিএস) ও সাস্ট স্কুল অব ডিবেট (সাস্ট এসডি)। করোনা সংকটের প্রথমদিকে কোন কার্যক্রম না চললেও বর্তমানে অনলাইনে বির্তক চর্চা ও বিভিন্ন প্রতিযোগীতায় নিয়মিত অংশগ্রহণ করছে সংগঠন দুইটির সদস্যরা। পাশাপাশি আর্থিক ও মানসিকভাবে অসহায় মানুষদের সাহায্যও করে যাচ্ছেন তরুণ বিতার্কিকরা। এ ব্যাপারে সাস্ট এসডি’র সভাপতি ত্রিদিপ সেন বলেন, সারা দেশেই গত দুই তিন মাস ধরে অনলাইনে প্রচুর বিতর্ক প্রতিযোগিতা ও চর্চা হচ্ছে। এর মধ্যে বেশীরভাগই করোনার কারণে আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের সহায়তার জন্য ফান্ড রাইজিং টুর্নামেন্ট।
অন্যদিকে অনলাইন বির্তকের ভবিষ্যত নিয়ে এসইউডিএস’র সভাপতি মাসফিক আহসান হৃদয় বলেন, পূর্বে বিভিন্ন বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য আমাদের দেশের বিভিন্ন জেলায় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হত। বর্তমানে অনলাইনের মাধ্যমে ঘরে বসেই দূর-দূরান্তের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ সম্ভব হচ্ছে। ভবিষ্যতে স্পন্সর ভিত্তিক সমস্য ও সামাজিক দূরত্বের জন্য অফলাইন টুর্নামেন্ট আয়োজন করা দুষ্কর হলে অনলাইন টুর্নামেন্টগুলোই ভরসা হিসেবে থাকবে।
মানবতার জয়গান: করোনা সংকটে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব সংগঠনই দুঃস্থ মানুষদের সহায়তা প্রদান করেছে। তবে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই সুবিধাবি ত মানুষের পাশে দাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কিন ও স্বপ্নোত্থান। করোনার এই দুঃসময়ে সেই লক্ষ্য তাদের কার্যক্রমের মধ্য দিয়েই আরও দীপ্যমান হয়ে উঠেছে।
কিনের সভাপতি সাব্বির আহমেদ বলেন, করোনাকালীন অসহায় মানুষদের খাদ্য সামগ্রী দেয়ার পাশাপাশি ৪৯৯টি বন্যার্ত পরিবারকে সহায়তা করেছে কিন। এদিকে স্বপ্নোত্থান ক্যাম্পাসের টং দোকানের মালিক, কর্মজীবী ছাত্রদের পরিবার, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে খাদ্য সহায়তা ও ৫০ টি চা শ্রমিক পরিবারের মাঝে ঈদ উপহার পৌঁছে দিয়েছে বলে জানান সংগঠনটির সভাপতি মোছাদ্দেক হোসেন।
সংস্কৃতি চর্চার স্বাভাবিক পরিবেশ কবে ফিরে আসবে সে প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহ্বায়ক অরূপ সরকার বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলেও সেই পূর্বের অবস্থায় ফিরে যেতে আমাদের অনেকটা সময় লাগবে। সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোই মূলত একটা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাণবন্ত করে রাখে। তাই আমাদের প্রতিবন্ধকতাগুলো কাটিয়ে উঠার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সরকারের সহায়তা এবং দিকনির্দেশনা জরুরি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালক অধ্যাপক ড. রাশেদ তালুকদার বলেন, করোনাকালীন সংকটেও আমাদের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর অনবদ্য কার্যক্রম প্রশংসার যোগ্য। ভবিষ্যতে নানা প্রতিকূলতা কাটিয়ে শাবিপ্রবি ক্যাম্পাসে শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চা চলমান থাকবে বলে তিনি আশা রাখেন।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন