বার্লিন লিটারেচার ফেস্টিভেলে এসেছিলাম। ওখান থেকে গেলাম স্টকহোমে, স্টকহোম থেকে এখন প্যারিসে। ইউরোপের এই তিনটি শহরে আমি বাস করেছিলাম এক সময়। আমার নির্বাসন জীবনের অনেকটাই এই শহরগুলোয় কেটেছে। শহরগুলো অনেক পাল্টেছে, আবার পাল্টায়ওনি খুব। অনেক নতুন কিছু চোখে পড়ছে, অনেকবার চমকাচ্ছি, অনেকবার হোঁচট খাচ্ছি। তবে যে নতুন ঘটনা আমাকে ভাবাচ্ছে, সে হলো ইউরোপের রাজনীতির মোড় ঘুরে যাওয়া, সাধারণ মানুষের মনে ঢুকে যাওয়া ঘৃণা আর তিক্ততা। জার্মানি, সুইডেন, ফ্রান্স— এই তিনটি দেশেই চরম ডানপন্থিরা জনপ্রিয় হচ্ছে, এই তিনটি দেশেই নতুন নািস দল ক্ষমতায় আসছে আসছে করছে। ভাবা যায়, হিটলার আবার আসছে ইউরোপে? তবে নতুন হিটলারের লক্ষ আর ইহুদি নয়, নতুন হিটলার ইউরোপে মুসলমান চায় না। হয়তো বাদামি রঙের হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানে আপত্তি নেই, কিন্তু মুসলমানে আপত্তি। কারণ মুসলমানরা টেরোরিস্ট, ওরা ওদের ঈশ্বরের নামে মানুষ হত্যা করে। মুসলমানের সন্ত্রাস এখন আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরাক, ইয়েমেনের ব্যাপার নয়, এখন ইউরোপ-আমেরিকাও জানে মুসলমানের সন্ত্রাস ঠিক কী রকম। তারাও ভুক্তভোগী। মুসলমানদের প্রতি যত ঘৃণা জন্মাচ্ছে এদের, তত বেশি মুসলমান আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে এদের দেশে। আমার এক জার্মান মানববাদী বন্ধুও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এত রিফুজির প্রবেশ নিয়ে। সুইডেনে আমার এক সাহিত্যিক বন্ধুও নিরাপদবোধ করছে না আফগানিস্তানি রিফুজিদের সামনে। ফ্রান্সের নারীবাদীরা চরম ডানপন্থিদের শাসক হিসেবে দেখতে চায় না, কিন্তু তাদেরও ডানপন্থি অথবা চরম ডানপন্থি—এই দুই দলের মধ্যে যে কোনও একটিকে বেছে নিতে হবে, এতে খুব আফশোস নেই কারো। দুই দলই মুসলমানদের অনুপ্রবেশ বন্ধ করবে, এ ব্যাপারে প্রায় নিশ্চিত সবাই। ডোনাল্ড ট্রাম্প মুসলমানদের ঢুকতে দেবে না আমেরিকায়, এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে জিতে যাওয়ার পাঁয়তারা করছে। ইউরোপেও তাই।
স্টকহোম শহরেই নিজ চোখে দেখলাম বাংলাদেশের এক বাদামি ছেলে কোনো একটা ঠিকানায় কোন রাস্তায় যেতে হবে জিজ্ঞেস করলো কিছু সুইডিশ পথচারীর কাছে, প্রায় কেউই থামলো না, উত্তরও দিলো না। ছেলেটিকে নিশ্চয়ই মুসলমান ভেবেছে সবাই। ছেলেটি হিন্দু ছিল, কিন্তু অসহযোগিতা করেছে মানুষ ওকে মুসলমান ভেবেই।
লিবেরাল ইউরোপের পরিণতি দেখে মন খারাপ হয়ে যায়। এরাই নািস হটিয়েছিল, এরাই মানবাধিকার, নারীর অধিকারের বাণী শুনিয়েছিল, এরাই বিজ্ঞানের পথে প্রথম হেঁটেছিল, উদারতা, ইউটপিয়ার কথা এরাই বলেছিল। মন্দ কাজ এরাও কম করেনি। ইতিহাসজুড়ে আছে এদের বর্বরতার কাহিনী। আবার ইতিহাসজুড়ে আছে এদের উদারতার কাহিনীও। তবে নিজেরাই নিজেদের বর্বরতা শুধরে নিয়েছিল। আমেরিকা বা ইউরোপের সরকার যুদ্ধে নামলে আমেরিকা আর ইউরোপের মানুষই সবচেয়ে বেশি পথে নামে যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই স্লোগান নিয়ে। যুদ্ধ নয় শান্তি চাই-এর মিছিলের অনেকেই এখন বলছে মুসলমান চাই না। জার্মানির যারা লক্ষ রিফুজিকে স্বাগত জানিয়েছিল, তারাই মুসলমানদের পরপর কয়েকটি সন্ত্রাসী হামলার পর চুপ হয়ে গেছে। কিছু সন্ত্রাসী আর জঙ্গির কারণে গোটা মুসলিম সমাজকে ভুগতে হচ্ছে, মানুষের অবিশ্বাস, সন্দেহ, আতঙ্কের শিকার হতে হচ্ছে তাদের। মুসলমানদের কেউ আর বিশ্বাস করতে চাইছে না, কাকে বিশ্বাস করবে কে, কী করে জানবে কে সন্ত্রাসী, কে নয়? কারো গায়ে তো লেখা নেই যে সে সন্ত্রাসী। তাই অবিশ্বাস সবার প্রতি। মুসলমানদের মধ্যে অনেকে আছে বিশাল বাড়িঘর ধনসম্পদ পেছনে ফেলে এসেছে, ইরাকে সিরিয়ায়, এখানে ক্যাম্পে ক্যাম্পে মানুষের অনুকম্পা নিয়ে বাঁচতে হচ্ছে। ওদের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করলে আমার গা কাঁপে। ধরা যাক আমি সিরিয়ার এক শিয়া। সুন্নি সন্ত্রাসীদের হাত থেকে বাঁচতে আমি আমার মা-বাবা, ভাইবোন নিয়ে ইউরোপে এলাম, এখানে আমাদের নাম দেওয়া হলো রিফুজি। আমার দিকে, আমার পরিবারের সবার দিকে মানুষ ঘৃণা ছুড়ে দিচ্ছে। শুনেছি ইউরোপ উদার, উদারতা কোথায় তবে? আমি শিক্ষিত, কিন্তু আমার শিক্ষার কোনও মূল্য নেই এখানে, আমি রিফুজি, আমি দয়া দাক্ষিণ্য চাই, এটাই আমার পরিচয়। জাতিসংঘের রিফুজি কনভেনশন তো তা বলে না, রাজনৈতিক রিফুজিদের সম্মান করার কথা, তাদের সব রকম সুবিধে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি প্রতিটি দেশের দেওয়ার কথা। আমাকে, আমার মা-বাবাকে, ভাইবোনকে কুণ্ঠিত হয়ে, অপরাধী হয়ে, লজ্জিত হয়ে বাঁচতে হবে বাকি জীবন? এত বড় মূল্য দিয়ে নিরাপত্তা কিনতে হচ্ছে? সম্মান সম্ভ্রম সব বিকিয়ে দিয়ে সামান্য বেঁচে থাকা। বেঁচে থাকার জন্য আমাদের মানব প্রজাতি বেরিয়েছিল আফ্রিকা থেকে ইউরোপ আর এশিয়ার দিকে। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গেছে। বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধ করা আমাদের রক্তে। আজো, এই একবিংশ শতাব্দীতেও আমাদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম করতে হচ্ছে। আমার মা যদি জন্ম নিত ইউরোপে, তাহলে তার খ্রিস্টান হওয়ার সম্ভাবনা ছিল বেশি, আমার মা সিরিয়ায় জন্ম নিয়েছে বলে সে মুসলমান। আমার মা অসম্ভব উদার, ভালোবেসে মানুষকে আলিঙ্গন করে, সবাইকে, সব ধর্মের সব জাতির মানুষকে। তাকে কি এখন ঘৃৃণা করবে ইউরোপ? কারণ মাথায় তার হিজাব বলে?
রিফুজিদের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করলে ইউরোপীয়দের ওপর বড় রাগ হয়। আবার নিজেকে জার্মান, সুইড, ফরাসি হিসেবে কল্পনা করলে বুঝি আতঙ্ক জমা হচ্ছে ভেতরে। যেভাবে জঙ্গিরা আক্রমণ করছে একের পর এক, ভয় হয় কখন না আবার কোন বোমা হামলার শিকার হই। রাস্তায় বাদামি কাউকে দেখলেই মনে হয় জঙ্গি, মানুষ মারার মতলব আঁটছে। নিরাপদবোধ করি না আগের মতো আর। এরা না এলেই ভালো ছিল, এরা শরিয়া আইন চায়, এরা মেয়েদের অধিকারের বিরুদ্ধে, এরা মানবাধিকারে বাগড়া দিচ্ছে, এরা আমাদের সমাজটাকেও পেছনে ঠেলতে চায়। আমরা আমাদের নারীবিরোধীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে ক্লান্ত। আর কত নারীবিরোধীদের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে হবে! তার ওপর আছে সন্ত্রাসীদের উপদ্রুব। এরা না এলেই ভালো।
উদারতা তারপরও ইউরোপেই দেখি। রিফুজিদের সেবা করছে ইউরোপের মানুষই। রিফুজিদের অধিকারের দাবিতে সোচ্চার ইউরোপের নারী-পুরুষই। এখন মানুষ মানুষকে ভালোবাসে, কে কোথাকার, কার গায়ের রঙ কী বিবেচ্য নয়। এখনো পৃথিবীটা সুন্দর এ কারণেই। ইউরোপ যতটা উদার আজ, তার একবিন্দুও যদি এশিয়া হতো, অনেক সমস্যার সমাধান এশিয়াতেই হয়ে যেত।
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।