রবিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৪ ০০:০০ টা

বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেরে বাংলা

এ কে ফাইয়াজুল হক রাজু

বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেরে বাংলা

শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক একটি অবিস্মরণীয় নাম, বাংলার ইতিহাসের এক অসাধারণ ব্যক্তি। বাংলার মুসলিম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হিসেবে শেরেবাংলা আমাদের কাছে চিরস্মরণীয়। জাতি হিসেবে আমরা যে সবাই বাঙালি- এই ঐতিহাসিক সত্যের মূল ভিত্তি তিনিই রচনা করেছেন। শেরেবাংলা কে ছিলেন তার পরিচয় দিতে গিয়ে বাংলার বিজ্ঞানী, মানবদরদী ডা. প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বলেছেন, বাঙালি জাতির ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব নির্ভর করে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের ওপর। ফজলুল হক এই ঐক্যের প্রতীক। আমি কংগ্রেসিদের ভারতীয় জাতীয়তা বুঝি না। আমি বুঝি বাঙালি জাতীয়তা। এ জাতীয়তা প্রতিষ্ঠা করতে পারেন একমাত্র ফজলুল হক। ফজলুল হক মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত খাঁটি বাঙালি। সেই সঙ্গে ফজলুল হক মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত খাঁটি মুসলমান। খাঁটি বাঙালিত্বের সঙ্গে খাঁটি মুসলমানত্বের এমন অপূর্ব সমন্বয় আমি আর দেখিনি। খাঁটি বাঙালিত্ব ও খাঁটি মুসলমানত্বের সমন্বয়ই ভবিষ্যৎ বাঙালির জাতীয়তা। ফজলুল হক এই বিরল সমন্বয়ের একমাত্র প্রতীক। বাংলার মুসলমানদের ইতিহাসের এক যুগসন্ধিক্ষণে ১৮৭৩ সালে জন্ম নিয়েছিলেন ইতিহাসের ক্ষণজন্মা পুরুষ আবুল কাশেম ফজলুল হক। ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও প্রতিভার অধিকারী। কিন্তু চারদিকে তাকিয়ে তিনি দেখলেন স্কুল-কলেজে বাঙালি মুসলমান ছাত্রদের সংখ্যা অতি নগণ্য। তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করতেন তাদের স্কুল-কলেজে না আসার কারণ। আর তাই সেই ছাত্রজীবনেই তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন বাঙালি মুসলমানদের অশিক্ষার অন্ধকার থেকে মুক্ত করে আলোর পথে এগিয়ে আনার। এ স্বপ্নের বাস্তবায়ন রূপই পরবর্তী জীবনে তিনি বাংলা অনগ্রসর মুসলিম সমাজের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের জন্য স্থাপন করেছিলেন অগণিত স্কুল-কলেজ। শেরেবাংলা সেই সময় বিভিন্ন সরকারি স্কুল-কলেজ, মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে বাঙালি মুসলমান ছাত্রছাত্রীদের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। তার এই ভূমিকা ছিল বাঙালির এগিয়ে যাওয়ার পথে এক যুগান্তকারী ঘটনা। তিনিই আমাদের জন্য প্রাথমিক ও অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করেছিলেন। সারা বাংলায় সেই সময়ে শেরেবাংলার স্থাপিত অগণিত স্কুল-কলেজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ, কেন্দ্রীয় মুসলিম শিক্ষা সমিতি কলকাতার ঐতিহাসিক বেকার হোস্টেল, কারমাইকেল হোস্টেল, লেডি ব্রাবোর্ন কলেজ, আদিনা ফজলুল হক কলেজ রাজশাহী, ইলিয়ট হোস্টেল, টেইলর হোস্টেল, মেডিকেল কলেজ হোস্টেল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হোস্টেল, মুসলিম ইনস্টিটিউট ভবন, ঢাকা ইডেন গার্লস কলেজ ভবন, ঐতিহাসিক চাখার ফজলুল হক কলেজ, ফজলুল হক হল (ঢাবি), তেজগাঁও কৃষি কলেজ, বুলবুল ললিতকলা একাডেমি এবং সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজ।

আমাদের জাতীয় জীবনের অন্যতম অহঙ্কার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় মহান নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের অনন্য অবদান ছিল। ১৯৫৪ সালের ঐতিহাসিক যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পর তার নেতৃত্বে যে মন্ত্রিসভা গঠিত হয় সে সময়ই আমাদের গর্ব বাংলা ভাষা তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে স্বীকৃতি লাভ করে। শেরেবাংলার প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়ই বর্তমান বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি শ্রেষ্ঠতম প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠা হয়। বাঙালির অন্যতম অহঙ্কার বাংলা নববর্ষের দিন পহেলা বৈশাখ। এ দিনটি সরকারি ছুটির দিন হিসেবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলাই ঘোষণা করেন ১৯৫৪ সালে। তখন থেকেই আমাদের সংস্কৃতির অন্যতম ধারক হিসেবে পহেলা বৈশাখ পালিত হয়ে আসছে। এসব দিক দিয়ে বিবেচনা করলে দেখতে পাই, শেরেবাংলার অমর অবদান আমাদের শুধু রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে নয়, সর্বোপরি আমাদের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক গণ্ডি পেরিয়ে জাতীয় জীবনে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে ছেয়ে আছে। এ কে ফজলুল হক তার রাজনৈতিক জীবনের প্রথমেই বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন, নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নতি ব্যতীত দরিদ্র মুসলমান সম্প্রদায়ের অবস্থার উন্নতির কোনো আশা নেই। বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন ছিল তখন প্রজাদের উৎপীড়ন ও নিপীড়নের একটি হাতিয়ার বিশেষ। অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক ১৯৩৭ সালে এই আইনের আমূল সংশোধন করলেন। আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে এতদিন জমিতে প্রজার যে স্বত্ব অস্বীকৃতি হয়ে আসছিল, তিনি তার স্বীকৃতি দিলেন। শেরেবাংলা ছিলেন শোষিত ও বঞ্চিত জনগণের অতি আপনজন। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, শিক্ষা ছাড়া বাঙালির উন্নতির আর কোনো পথ নেই। তাই শেরেবাংলা তার ওকালতির আমলে দরিদ্র বাঙালি ছাত্রদের অকাতরে দান করেছেন। নিজের কাছে অর্থ না থাকলে তিনি সেই সময়ের কাবুলী কুশিদজীবীদের কাছ থেকে টাকা ধার করে দান করেছেন।

তার এই বেপরোয়া দানের ফলে তাকে প্রায় দেউলিয়া হতে হয়েছিল। একটু বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, আধুনিক শিক্ষিত বাংলা, বাংলার মধ্যবিত্ত সমাজ ও বাঙালি জাতি তারই পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ সৃষ্টি। বাংলা ও বাঙালির জন্য স্বাধীনতা অর্জন ছিল শেরেবাংলার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের প্রধান লক্ষ্য। তৎকালীন অবিভক্ত বাংলায় তিনি যখন প্রথম 'দৈনিক নবযুগ' পত্রিকা প্রকাশ করেন ১৯২০ সালে, তখন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও কমরেড মোজাফফর আহমেদকে তিনি এই জনপ্রিয় পত্রিকার সম্পাদক ও সহ-সম্পাদক নিযুক্ত করেন। কবি নজরুল ইসলামের সম্পাদনায় এবং কমরেড মোজাফফর আহমেদের সহযোগিতায় প্রকাশিত পত্রিকাটির পাতায় পাতায় বাংলার দুর্দশাগ্রস্ত জনগণের সমস্যাপীড়িত জীবনের চিত্র এবং তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন ঘটত। তার রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই এ ধরনের একটি প্রগতিশীল পত্রিকা প্রকাশ করে ফজলুল হক তার অসাম্প্রদায়িক এবং প্রগতিশীল মনোভাবেরই পরিচয় দিয়েছিলেন। বাংলার অবহেলিত দরিদ্র মানুষের মুক্তির ইতিহাস শেরে বাংলার মহান অবদান ছিল ঋণ সালিশি বোর্ড গঠন। বাংলার কৃষক সাধারণকে মহাজনদের নাগপাশ থেকে উদ্ধারের জন্য তিনি সারা বাংলায় গঠন করেছিলেন প্রায় এগারো হাজার ঋণ সালিশি বোর্ড। ফলে বাংলার কোটি কোটি ঋণগ্রস্ত চাষি ফেরত পেল তাদের জমাজমি। এমনকি তার রচিত আইনের সাহায্যের ঋণের দায়ে চলি্লশ বছর আগে যাদের ভিটেমাটি হস্তান্তর হয়েছিল তারা তাও ফিরে পেল। বাংলার দরিদ্র দোকান কর্মচারীদের দুরবস্থাও তার তীক্ষ্ন দৃষ্টি এড়ায়নি। তাই বঙ্গীয় দোকান কর্মচারী আইন পাসের মাধ্যমে তিনি তাদের দিয়েছিলেন ন্যায্য অধিকার। তিনি স্বীকৃতি দিয়েছিলেন তাদের উন্নত চাকরির শর্ত ও ছুটির অধিকারের। শেরে বাংলা এমন এক সময় এ দেশের রাজনৈতিক গগনে আবির্ভূত হয়েছিলেন, যখন অতি অল্পসংখ্যক মুসলমানই রাজনীতি কী তা জানত। একমাত্র রাষ্ট্রপতির পদটি ছাড়া সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদ ছিল না, যা তিনি কোনো না কোনো সময় অলঙ্কৃত করেননি। ১৯১৮ সালে তিনি যখন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক, তখন ভারতের মহান নেতা পণ্ডিত মতিলাল নেহরু ছিলেন কংগ্রেসের জয়েন্ট সেক্রেটারি। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকই প্রথম বাঙালি হিসেবে অবিভক্ত বাংলার প্রথম বাঙালি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিশাল রাজনৈতিক গৌরব অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন।

১৯১৩ সালে সক্রিয় রাজনীতিতে প্রবেশ করে যুক্ত বাংলাসহ ভারতবর্ষে তিনি তার বিশাল ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে বিশাল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। শেরে বাংলা ফজলুল হকের কাছে সম্প্রদায়ের মূল্য ছিল ক্ষীণ। তিনি মানুষকে মানুষ বলে জানতেন। এ দেশের রাজনীতিতে তিনি প্রথম উচ্চারণ করেন 'লাঙ্গল যার জমি তার'। নিজের রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেছিলেন, 'বাংলার সাধারণ মানুষকে আমি ভালোবেসেছি, এ আমার অপরাধ। সবই করেছি আমার বাংলার শোষিত, অত্যাচারিত, নিগৃহীত, লাঞ্ছিত মানুষের ব্যথাতুর মুখের দিকে চেয়ে। আমি তাদের কোনো দিন রাজপ্রাসাদের স্বপ্ন দেখাইনি বা পরলোকের বেহেশত বানাতে চাইনি। বাংলার নরম পলিমাটির সাধারণ মানুষকে চিরদিন নিশ্চিন্তে নিজস্ব কুঁড়েঘরে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মেহনতের বদৌলতে দুবেলা দুমুঠো ডাল-ভাতের সংস্থান করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, আমার রাজনীতি এই ডাল-ভাতের রাজনীতি। তাই লাঙ্গল যার জমি তার, ঘাম যার দাম তার- এই দৃঢ় শপথ নিয়ে আমি দেশসেবায় ব্রত হয়েছি।' শেরেবাংলা আজ আমাদের মধ্যে নেই। ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল তিনি ইন্তেকাল করেছেন। তবে আমাদের জাতীয় জীবনের ক্রান্তিলগ্নে এই মহান নেতার স্বপ্ন ও সাধনা আজও আমাদের জাতীয় মুক্তির পথ দেখাতে পারে।...

লেখক : এ কে ফাইয়াজুল হক রাজু, শেরেবাংলার দৌহিত্র।

ই-মেইল : [email protected]

 

সর্বশেষ খবর