আমাদের নতুন প্রজন্মকে প্রযুক্তিনির্ভর হতে হবে— এতে কোনো দ্বিমত নেই। প্রযুক্তি আমাদের জীবন অনেক সহজ করে দিয়েছে। প্রযুক্তির কল্যাণে বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়। মুঠোফোন বিলাসিতা নয়, জীবনের জন্য অত্যাবশ্যক। কাজের ফাঁকে ফাঁকে, বিরতিতে আর অবসরে স্মার্টফোন নিয়ে নাড়াচাড়া করা আমাদের নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন বাস্তবতা।
ইন্টারনেট : ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে শেখার অনেক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। স্মার্টফোনের পর্দায় আঙুলের স্পর্শে খুলে যায় দুনিয়ার তাবৎ তথ্যভাণ্ডার। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, সব তথ্যই কিন্তু নির্ভরযোগ্য নয়। গুগলে সার্চ দিলে অনেক জঞ্জাল (গার্বেজ) পর্দায় ভেসে ওঠে। এ ক্ষেত্রে যা বিবেচ্য, তা হচ্ছে তথ্যের উত্স। ইন্টারনেটের ভালো-মন্দ দুটি দিকই আছে। তবে এ দুইয়ের মধ্যে মাত্রাগত কিছু পার্থক্য আছে। পাল্লা কোন দিকে ভারী? এটাই আজকের আলোচনার বিষয়। ইন্টারনেটের ভালো-মন্দ নিয়ে আলোচনায় সেই পুরনো উদাহরণটাই সামনে চলে আসে। উদাহরণটা পুরনো হলেও প্রাসঙ্গিক ও যথাযথ। ইন্টারনেট একটা ধারালো ছুরির মতো যা ব্যবহার করে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে রোগীকে বাঁচিয়ে তোলা যায়, আবার মানুষ খুন করা যায়। ভালো-মন্দ নির্ভর করছে কে কীভাবে ব্যবহার করছেন তার ওপর। ইন্টারনেট আমাদের বন্ধু হয়ে উঠেছে ঠিকই, কিন্তু এর অপব্যবহার ডেকে আনছে সর্বনাশ। স্মার্টফোনের মাধ্যমে যৌন হয়রানি ও প্রতারণার ঘটনা অহরহ ঘটছে। একই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। সংবাদমাধ্যমগুলোয় এ-সংক্রান্ত খবর প্রায় প্রতিদিনই চোখে পড়ে। সব ঘটনাই যে পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তা নয়। সামাজিক মর্যাদা ও লোকলজ্জার ভয়ে অনেকে ঘটনা চেপে যান। সচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা সত্ত্বেও পরিস্থিতির এতটুকু পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। এসব ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। আঙ্গুলের ছোঁয়াতেই পরিচ্ছন্ন নয়, এমন সব ওয়েব পেজ খুলে যায়। পত্রিকায় পড়লাম, প্রতিবেশী দেশ ভারতে স্কুল পড়ুয়াদের মধ্যে নীল ছবি (পর্নো) দেখার আসক্তি বাড়ছে। হাতে হাতে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের সংযোগ আসক্তি বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমাদের দেশের চিত্র একই। পর্নোগ্রাফি উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের নৈতিক স্খলনের বড় কারণ হতে পারে বলে অনেকেই মনে করছেন। প্রাকবিবাহ যৌনতা, এলোমেলো যৌনাচার, প্রকাশ্যে যৌনতা, যৌন বিকৃতি অতিসাধারণ ও স্বাভাবিক বলে এদের কাছে প্রতিভাত হচ্ছে। অপরিণত বয়সের ছেলেমেয়েদের হাতে স্মার্টফোন তুলে দেওয়া সংগত হচ্ছে কিনা, তা একবার গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখা উচিত।
ফেসবুক : অধুনা সব বয়সী মানুষের কাছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ফেসবুক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। দেশ-বিদেশের খবর আদান-প্রদান, মতামত প্রকাশ, শুভেচ্ছা বার্তা পাঠানো, অনলাইনে কেনাকাটা ও বিনোদনের জন্য অনেকেই এখন নির্ভর করছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর। শুধু কিশোর-কিশোরী বা তরুণ-তরুণী নয়, মধ্যবয়সী, এমনকি প্রবীণরাও ফেসবুকে ভালোই মজেছেন জীবনের এই গোধূলিবেলায়। কিছুটা সময় কাটে পত্রিকা পড়ে আর টিভির পর্দায় চোখ রেখে। ফেসবুক ঘাঁটাঘাঁটি করে কেটে যায় দিনের অনেকটা সময়। বিশ্বে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২০০ কোটি ছাড়িয়েছে। ফেসবুকে কোনো পোস্ট দিলে মুহূর্তের মধ্যে তা গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। অন্যায়-অবিচার-অত্যাচার-বঞ্চনার বিরুদ্ধে ফেসবুকে নিন্দা-ধিক্কার-প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ফেসবুকে যা খুশি তাই মন্তব্য করা যায়। কোনো একটা পোস্ট নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মন্তব্য-পাল্টা মন্তব্যে তুলাধোনা করা হয়। কারও কারও মন্তব্য, ভাষাজ্ঞান ও অশুদ্ধ বানান দেখে হতাশই হতে হয়। ফেসবুকের পাতায় কুরুচিকর ভাষায় অসম্মানজনক ও আক্রমণাত্মক কমেন্ট করা হয় যা সভ্যতা-ভব্যতার পর্যায়ে পড়ে না। মন্তব্য করতে গিয়ে আমরা অনেক সময় দিশা হারিয়ে ফেলি। পরিমিতিবোধের অভাব সর্বত্র। ফেসবুকে মন্তব্য সম্পাদনা করার কেউ নেই। জবাবদিহিতাও নেই।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক সময় ভুয়া ছবি পোস্ট করে বা মিথ্যা খবর রটিয়ে বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে। উদ্দেশ্য, সম্প্রীতি বিনষ্ট করা। ফেসবুকে ভুয়া আইডি খুলে বা অন্যের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে অবৈধভাবে প্রবেশ করে এটি করা হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়া এখন অনেকটাই হুজুগের জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো যাচাই-বাছাই না করে অসহিষ্ণু হয়ে তাত্ক্ষণিকভাবে আমরা প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছি। সাইবার ক্রাইম এখন আর একটি বা দুটি দেশের সমস্যা নয়। বৈশ্বিক সমস্যা। এটা প্রতিরোধ করতে হিমশিম খাচ্ছে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ।
স্মার্টফোন : কানে মুঠোফোন নিয়ে হাঁটতে গিয়ে অনেকে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। সমীক্ষা বলছে, প্রযুক্তির ওপর বেশি নির্ভরতা আমাদের সৃষ্টিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। স্মার্টফোন অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে মেজাজ খিটমিটে হয়ে যায়। অন্য এক সমীক্ষা বলছে, ফেসবুক আমাদের ক্ষুদ্রমনা করে দেয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমাদের একত্রিত করার পরিবর্তে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। অনলাইনে যত বেশি সময় ব্যয় করা হবে বাস্তব দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ ততই কমতে থাকবে। স্মার্টফোনে সারা দিন মাথা গুঁজে থাকার কোনো মানে হয় না। অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়। মুঠোফোনের ছোট পর্দার বাইরে আরেকটা জগৎ আছে। ওই জগত্টা অনেক বেশি সুন্দর, আনন্দের, উপভোগের।
সেলফি : সেলফি (নিজস্বী) ম্যানিয়ায় আক্রান্ত গোটা বিশ্ব। সেলফি তোলার নেশা ডেকে আনছে বিপদ। ইতিমধ্যে সেলফি ফিবার কেড়ে নিয়েছে বহু প্রাণ। অনেক মর্মান্তিক ঘটনার বিবরণ ছাপা হয়েছে পত্রিকার পাতায়। সেলফি নিয়ে এতটা মাতামাতি অনেকের কাছে নিছক পাগলামি বই কিছু নয়। নিজের জীবনের চেয়ে প্রিয় আর কী হতে পারে! নিজের নিরাপত্তার কথা নিজেকেই ভাবতে হবে। কিন্তু এসবে বয়েই গেছে নতুন প্রজন্মের। স্থান-কাল বিবেচনা না করে সেলফি তোলার এই বিপজ্জনক প্রবণতা ঠেকাতে সচেতনতা জরুরি। ইন্টারনেটের ভালো-মন্দ দিকগুলো নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির এই দায়িত্বটা কার?
লেখক : সাবেক ডিএমডি, জনতা ব্যাংক লিমিটেড।
ই-মেইল : [email protected]