শনিবার, ২ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

আমার প্রাণ অনুভূতি গৌরব- সবটুকুই ছাত্রলীগ

নূরে আলম সিদ্দিকী

আমার প্রাণ অনুভূতি গৌরব- সবটুকুই ছাত্রলীগ

প্রকৃতির নিয়মটাই বোধহয় এই, যে কোনো দুঃসংবাদ দুর্ঘটনা চেপে বসলে মানুষ পড়ে ঠিকই, কিন্তু আস্তে আস্তে ধাতস্থ হয়ে যায় এতটাই যে, উদ্ভূত অসহনীয় পরিস্থিতিকে মেনে নিয়ে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। একটা ক্যান্সার রোগী প্রথমে যতখানি মুষড়ে পড়ে, আস্তে আস্তে বিষয়টিকে গভীর বিবেচনার মধ্যে নিয়ে বাঁচার সংগ্রামে দুর্দমনীয় সৈনিকের মতো অবতীর্ণ হয়। প্রতি মুহূর্তে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে লড়তে থাকে জীবনঘাতী অসুখের বিরুদ্ধে। ক্যান্সারটি একটি বিচ্ছিন্ন উদাহরণ মাত্র। জীবনের বাঁকে বাঁকে ক্যান্সারের মতোই অসংখ্য প্রতিবন্ধকতা আসে। কিন্তু জীবনের পথচলাকে স্তব্ধ করে দিতে পারে না। আপন ছন্দে নিত্যপ্রবাহে জীবন সামনের দিকে ধেয়ে চলে। এ ক্ষেত্রে শুধু ক্যান্সারই নয়, জীবনের যে কোনো প্রতিবন্ধকতা মানুষকে নিত্যদিন মোকাবিলা করে যেতে হয় এবং মোকাবিলা করেই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হয়। যারা এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারে না, তারা মুষড়ে পড়ে। হয়তো অনেকের জীবনে শ্রান্তি-ক্লান্তি অবসন্নতায় আড়ষ্ট জীবন টানতে গিয়ে অসময়ে জীবনটাই থমকে যায়। ব্যক্তিজীবনের এহেন ঘটনা সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনেও ঘটে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বা সমাজ অকুতোভয়ে বিজয়ের মালা পরতে পারে। সেসব সফল পুরুষের অক্লান্ত মনোবল ও অধ্যবসায় সমাজকে টিকিয়ে রাখে। কথাগুলোর অবতারণা হলো বিগত নির্বাচনের অলৌকিক ও অকল্পনীয় ফলাফলটি যখন প্রকাশিত হয়েছিল, তখন সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক মহল তো বটেই, বিজয়ী সংসদ সদস্যরা পর্যন্ত স্তম্ভিত ও বিস্ময়াভিভূত হয়েছিলেন। অনেকে ভাবতেই পারেননি, তার সপক্ষে প্রদর্শিত ভোট লৌকিক না অলৌকিক। নির্বাচনের আগে ১৯৬৯-৭০-এর মতো কোনো গণঅভ্যুত্থান হয়নি, সমগ্র বাংলাদেশ গণসমুদ্রের ফেনিল চূড়ায় ভিসুভিয়াসের মতো জ্বলে ওঠেনি। অন্যদিকে সরকার এমন কোনো চমকও সৃষ্টি করতে পারেনি, যাতে জাতি সরকারের পক্ষে একাট্টা হয়ে শতকরা ৯০ ভাগ, ক্ষেত্রবিশেষে তারও বেশি ভোট প্রদান করে আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনে উজ্জীবিত ও উচ্ছ্বসিত করবে এবং নিজেরাও কৃতার্থ হবে। সাড়ে ৩ লাখ ভোটের একটি নির্বাচনী এলাকায় দেড় লাখ ভোটপ্রাপ্ত প্রার্থীরাই বিজয়ী হন এবং সেই লক্ষ্যেই তারা প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু এবারের নির্বাচনের চিত্রটাই ছিল ভিন্ন। সরকারি দলের প্রার্থীর পক্ষে যে ভোট পড়েছে তাতে প্রার্থীই স্বয়ং এমনকি সপরিবারে চমকে উঠেছেন। সুহৃদ-শুভাকাক্সক্ষীরাও উল্লাসে উচ্ছ্বাসে আত্মহারা তো হনইনি, বরং বিস্ময়াভিভূত হয়ে অনেকটাই আর্তনাদের মতোই বলেছেন, এতটা বাড়াবাড়ির কী প্রয়োজন ছিল। নির্বাচনে কমবেশি কারচুপি হয়, আর এ দেশে প্রার্থীরা পরাজিত হলে কারচুপি করে তাকে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে- এ অভিযোগ পরাজিত প্রার্থীর কাছ থেকে আসবেই, এটা স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপটটা ভিন্ন। বরং অনেক প্রার্থী বলাবলি করছেন, নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন যখন শতভাগ নিশ্চিত ছিল, তখন কারচুপির এহেন উদগ্র প্রকাশ আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী ও নির্বাচনমুখী দলকে বিশ্বদরবারে মারাত্মকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করেছে। বিশ্বের সংবাদমাধ্যম ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা শুধু বিস্ময়াভিভূতই নন, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছেন। নির্বাচনে সংখ্যাতত্ত্বের দিক দিয়ে পর্যবেক্ষকদের মতে এটা বিশ্বরেকর্ড, অভিনব ও কল্পনাতীত। দেশের মধ্যে আওয়ামী লীগের অনেক ঘনিষ্ঠ সুশীলও ভেবেছেন, এতটা বাড়াবাড়ি করা উচিত হয়নি, বরং এতে নিছক নির্লজ্জতার উৎকট প্রকাশ ঘটেছে। দেশের নিষ্প্রাণ প্রতিবাদহীন সংবাদমাধ্যমের রথী-মহারথীরাও এই উদগ্র ও বল্গাহীন কারচুপিকে উন্মাদের উন্মত্ততা হিসেবেই ভেবেছেন। কোনো কিছুর পরোয়া না করে নির্বাচনের আগের রাতে শতকরা ৪০ ভাগ ভোট সরকারি দলের প্রার্থীর পক্ষে সিল মেরে ব্যালটবাক্সে ভরে রাখার যে অভিযোগটি বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে উত্থাপিত হয়েছে, সেটা জনগণেরই অভিযোগ বলে প্রতীয়মান হয়েছে। অবশ্য ঐক্যফ্রন্টের এখানে যতখানি জোরালো প্রতিবাদী কর্মসূচি দেওয়া উচিত ছিল, তারা তা দিতে পারেনি। এটা  যে সাংগঠনিক দুর্বলতা, তা সন্দেহাতীতভাবে বলা চলে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, সামরিক ব্যক্তিত্বে ঔরসে ক্যান্টনমেন্টের গর্ভে জন্মলাভ করা সংগঠন বিএনপি সাংগঠনিক শক্তির দিক থেকে যে একেবারেই নিষ্প্রাণ, নিস্তব্ধ ও নিষ্প্রভ- তা বলারই অপেক্ষা রাখে না এবং সরকারি দলেরও চিন্তা তো দূরে থাক, কল্পনার আবর্তেও ছিল না। বেগম খালেদা জিয়াকে সুকৌশলে বৃহস্পতিবার জামিন নাকচ করে কারাগারে প্রেরণ করা হয় শুক্র ও শনিবার আদালত বন্ধের সুযোগ নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি এবং আন্দোলনের গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য। হায়রে পোড়া কপাল বেগম খালেদা জিয়ার! আন্দোলনের ঝড় ওঠা তো দূরে থাক, তার গ্রেফতারের প্রতিবাদে একটা খ-মিছিলের উল্লেখযোগ্য পদচারণও পরিলক্ষিত হলো না। সভা-সমিতি থেকে আগ্নেয়গিরির গলিত লাভার উদ্গিরণ তো দূরে থাক, বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে রাজধানীসহ দেশের কোনো শহরেই তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো সভা-সমাবেশ তো হলোই না, রাজধানী ঢাকা শহরেও কোনো প্রতিবাদী বিক্ষোভ মিছিল বের হলো না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হতভম্ভ হয়ে শ্রান্ত-ক্লান্ত মনে দাঁড়িয়ে বসে অবসন্ন সময় কাটাল। জলকামান, টিয়ারগ্যাস নিয়ে প্রস্তুত থাকা দাঙ্গাপুলিশের অংশটি নীরব, নিস্তব্ধ ও নিষ্প্রভই রয়ে গেল। সংবাদমাধ্যমগুলো তাদের ক্যামেরা নিয়ে রাস্তায় অপেক্ষায় থাকল, একটি প্রতিবেদন তৈরির কোনো উপাদানই পেল না। এ যেন ২৯ ডিসেম্বর ‘মার্চ ফর ডেমোক্র্যাসি’র ব্যর্থতারই পুনরাবৃত্তি। ক্ষমতাশ্রিত দল হিসেবে বিএনপি আন্দোলন সৃষ্টির সংগ্রামে এমনকি পদচারণে দুর্বল, এটা সর্বজনজ্ঞাত। কিন্তু এতখানি ভঙ্গুর যে, ল্যাংড়া-লুলার মতো মিছিলের পথে হাঁটতেই পারে না, এটি অকল্পনীয় এবং একটি রাজনৈতিক দলের কাছে প্রত্যাশিত নয়। বিএনপির নেতৃত্বের অধুনা বৈশিষ্ট্য এই যে, তারা সংবাদ সম্মেলন করে চোখা চোখা বক্তৃতা-বিবৃতি দেবেন। তাদের জ্যেষ্ঠ যুগ্মমহাসচিব সংবাদ সম্মেলন করে নিষ্ফল ও নির্লজ্জ বাণী বর্ষণ করে জাতিকে কৃতার্থ করবেন, আর শুধু তাতেই গোটা জাতি উজ্জীবিত উদ্বেলিত হয়ে কাফনের কাপড় পরে রাজপথে নেমে পড়বেন, নূর হোসেন, মনু মিয়াদের মতো বুকনিঃসৃত রক্তে রাজপথ রাঙিয়ে তাদের ক্ষমতার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার পথ প্রশস্ত করে তুলবেন- এই স্বপ্নে বিভোর থাকলে তা যে দুঃস্বপ্নেরই নামান্তর হয়, মওদুদ-রিজভী সাহেবরা তা শুধু প্রমাণই করলেন না, নিরেট বাস্তব সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন।

বেচারা খালেদা জিয়া তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। আশির দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তিনি আপসহীন হিসেবে নিজেকে অনেকটাই প্রতিভাত ও প্রতিস্থাপিত করতে পেরেছিলেন। কিন্তু কল্পনাও করতে পারেননি, সত্যিকার আন্দোলনে রাজপথের কর্মীর অভাব তার দলে কতখানি। এখানে তিনি দেউলিয়া, অসহায় ও একান্তই নিঃসঙ্গ। হয়তো এখন তিনি কারাগারে বসে অনুধাবন করছেন, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে গ্রেনেড হামলা করা যায় কিন্তু রাজনৈতিক দিগ্দর্শন না থাকলে রাজপথের লড়াকু সৈনিক তৈরি করা যায় না। মিছিলের মধ্যে মুষ্টিবদ্ধ উত্তোলিত হাত অথবা উদ্বেলিত জনতার বিস্ফোরণে আন্দোলনে আগ্নেয়গিরির গলিত লাভার মতো অগ্নিবর্ষণ দূরে থাক, কর্মীবাহিনীর দৃপ্ত পদচারণে রাজপথ প্রকম্পিত করা যায় না। গণসমুদ্রের ফেনিল চূড়ায় ভিসুভিয়াসের মতো জ্বলে ওঠার যে উপাদান, তা যে তার নেই বা সেখানে যে তিনি রিক্ত, নিঃসহায় এবং কপর্দকহীন- হয়তো তিনিও তা অবহিত বা অবগত ছিলেন না। বেগম খালেদ জিয়া যাদের ওপর নির্ভর করেছেন, তারা সব দলের জন্যই বসন্তের কোকিল। বার বার দলবদল করে সুবিধামতো অবস্থান তৈরি করতে তারা যতখানি পরিপক্ব, গণআন্দোলন সৃষ্টিতে ততখানিই অনভিজ্ঞ ও অনীহাগ্রস্ত। তারা নিরাপদ প্রাসাদের চড়–ই পাখি। আপন আশ্রয় নির্মাতা বাবুই পাখি নয়। তারা রোদ-বৃষ্টি হলে নিরাপদে থাকেন, খরতপ্ত রৌদ্রের তাপে দগ্ধীভূত হন না। আবার বিরামহীন বৃষ্টি বর্ষণের প্রচ- প্রবাহে তাদের জড়সড়ো হতে হয় না। তবু স্বাধীন নির্ভীক নির্মাতা। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটি পাখি হলেও আপন বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর তাদের জীবন।

নির্বাচনের কাছাকাছি সময়ে বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে ড. কামাল হোসেনের ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব জাতির মনে একটা আস্থার ভাব তৈরি করেছিল। বিএনপিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করানোর কৃতিত্ব ড. কামাল হোসেনকে দিতেই হয়। কিন্তু কোথায় যেন একটা দুর্বলতা বা গলদ ঐক্যফ্রন্টে ছিল। তা না হলে নির্বাচনে কাক্সিক্ষত ফল অর্জনে তারা এভাবে ব্যর্থ হবে কেন? যদি ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনের মাঠে না থাকত, তাহলে আওয়ামী লীগ ইতিহাসের অভূতপূর্ব এই প্রকাশ্য কারচুপি এবং সরকারি দলের মনোনীত দুজন সদস্য বাদে ভোটের সিল মারার দুঃসাহসিকতার সুযোগ পেত কিনা তাও ভেবে দেখতে হবে। এ ক্ষেত্রে ড. কামালের ভূমিকা অনেকের কাছে রহস্যজনক।

আজকের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সৃষ্ট দুর্নীতি, স্বাধীনতা আন্দোলনের বিস্তীর্ণ পথপরিক্রমণের অকুতোভয় যাত্রী ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের কর্মীরা যেভাবে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন, ভবিষ্যতে কোনো রাজনৈতিক দুর্যোগ বা দুর্বিপাক সৃষ্টি হলে তাদের তরণিখানি কোথায় গিয়ে আছড়ে পড়বে, আজকে তাও বলা দুষ্কর।

ছাত্রলীগের সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা এতটাই নিবিড় ও গভীর যে, ছাত্রলীগের কোনো অপকীর্তি ও দুষ্কর্মের খবর সংবাদমাধ্যমে গোচরীভূত হলে আমার সব অনুভূতি কুঁকড়ে কেঁদে ওঠে, ষাটের দশকের একজন কর্মীর অনুভূতি শিরায় শিরায় একটি মর্মান্তিক রক্তক্ষরণ ঘটে। মন মানতে চায় না, হৃদয় সায় দেয় না। স্বাধীনতা অর্জনকারী সংগঠন ছাত্রলীগের কোনো পদস্খলন, অনৈতিক ও অরাজনৈতিক কর্মকা-ের অপবাদ মেনে নেওয়া যায় না। টেন্ডারবাজি, হলে সিট দখল, ভর্তি বাণিজ্যসহ নানা অরাজনৈতিক কর্মকা-ে যেভাবে অনুপ্রবেশ ঘটছে, তাতে মনে হয়, ছাত্রলীগ কি এনএসএফ হয়ে যাবে? ছাত্রলীগের বর্তমান প্রজন্ম তাদের পূর্বসূরিদের সব সফলতা ও অর্জন কি ভুলে যাবে? ছাত্রলীগের ইতিহাস স্বাধীনতার ইতিহাস বা ছাত্রলীগই স্বাধীনতার অগ্রদূত- এ সত্য থেকে বিচ্যুত হলে ছাত্রলীগ কি তার নিজ ইতিহাসকেই নিজ হাতে ধ্বংস করার কলঙ্ক বহন করবে না? এ সতর্কবাণী বজ্রনির্ঘোষে প্রতিনিয়ত তাদের শোনাতে হবে। এখন অনভিপ্রেতভাবে হলেও শেখ হাসিনা এককভাবেই ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগকে পরিচালনা করছেন। তাই দায়িত্বটা তাঁরই স্কন্ধে অর্পিত হয়।

ছাত্রলীগকে তলপিবাহক পেটোয়া সংগঠন না বানিয়ে তার অতীত ঐতিহ্য উজ্জীবিত রাখার নৈতিক দায়িত্ব শেখ হাসিনার। শেখ হাসিনা এ কথাটি যত সম্যক উপলব্ধি করতে পারবেন, তত ছাত্রলীগের জন্য তো বটেই, জাতি এমনকি তাঁর নিজের জন্যও কল্যাণকর। ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধুকে জাতির নেতৃত্বের একক প্রতীক বানাতে সক্ষম হয়েছিল। সেখানে তাদের আদর্শের কোনো বিচ্যুতি ছিল না। আন্দোলনের সোপান উত্তরণের মধ্য দিয়ে দক্ষ কারিগরের মতো তারা স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নেতৃত্ব প্রতিস্থাপনে যে গৌরবদীপ্ত দৃষ্টান্ত রেখেছে, ইতিহাস একদিন না একদিন তার স্বীকৃতি দেবেই। তবে সতর্ক থাকতে হবে, আজকে ছাত্রলীগের নৈতিকতার যে বেহাল অবস্থা সেখান থেকে অবশ্যই তাদের বেরিয়ে আসতে হবে। ছাত্রলীগ সরকারের তলপিবাহক সংগঠন নয়। বরং সব আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষক।

ডাকসু নির্বাচন অতি সন্নিকটে। এ নির্বাচনে সর্বান্তঃকরণে আমি ছাত্রলীগের বিজয় প্রত্যাশা করি। আমি কায়মনোবাক্যে প্রত্যয়দৃঢ় চিত্তে আশা করব- নিষ্ঠা, সততা ও সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সহমর্মিতা সৃষ্টির মাধ্যমে ছাত্রলীগ তার বিজয়ের পথ বিনির্মাণ করবে। প্রার্থী নির্বাচনে দলীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে মনোনয়ন প্রদান যৌক্তিক এ কারণে যে, এখানে নতুন করে মতানৈক্য সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা কম থাকবে। বিদ্রোহী প্রার্থীর উদয় হলে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে। ডাকসুর প্যানেলে উদ্ভূত ঝামেলার সম্ভাব্য কারণ যা শুনেছি, খুলনা বিভাগের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বিপুল হওয়া সত্ত্বেও ডাকসুর মনোনীত প্যানেলে তাদের কোনো প্রতিনিধিই নেই। আমার মনে হয়, এটা অনিচ্ছাকৃত ও কৌশলগত ভুল। এ ভুলের খেসারত যেন দিতে না হয়, তার জন্য সযত্ন প্রচেষ্টা রাখতে হবে। ছাত্রলীগ সমগ্র বাংলাদেশের। এটি কোনো আঞ্চলিক সংগঠন নয়। কোনো একটি ক্ষেত্রে অনিচ্ছাকৃত ভুলত্রুটি হলেও তা শুধরে নেওয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

আমাদের সময়ে (’৬৯, ’৭০, ’৭১) ছাত্রলীগ সমগ্র ছাত্রসমাজে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। আমাদের সময়ে ছাত্রলীগ ছিল মরুভূমির নিষ্কলুষ সূর্যরশ্মির মতো পবিত্র। আদর্শিক পদচারণ, মানসিক সহনশীলতা, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষ বিরোধিতা থাকলেও যৌক্তিক পর্যায়ে তার একটা সমঝোতা করার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা আমরা করতাম এবং প্রায় সর্বত্রই সফল হতাম। আজকের প্রজন্মকে বিনম্র চিত্তে বাস্তবতার নিরিখেই কথাগুলো স্মরণ করাতে চাই। চলার পথে আদর্শিক স্খলন, অন্যায়ের বিরোধিতার প্রশ্নে নেতিবাচক মনোভাব, সরকারের প্রতি শর্তহীন সমর্থনে, আত্মস্বার্থ চরিতার্থের হীনমন্যতা শুধু সংগঠনকে দুর্বলই করে না, অবক্ষয়ের অতলান্তে ডুবিয়ে দেয়। এ কথাটি সার্বক্ষণিকভাবে মনে রাখতে হবে।

জীবনসায়াহ্নে এসে আমার একান্ত কাম্য হলো- ছাত্রলীগ নির্মল সূর্যালোকে বাংলাদেশকে উদ্ভাসিত করুক। সব অন্যায়, অবিচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে বজ্রনির্ঘোষে গর্জে উঠুক। অতীত ঐতিহ্যকে অম্লান রাখার নির্মোহ লক্ষ্যে হিমাচলের মতো অটল থাকুক- এটিই আমাদের সবার কাম্য। আমাদের এ কামনা ছাত্রলীগের সূর্যস্নাত অতীতকে অমলিনই রাখবে না, আগামী দিনের চলার পথকে অনির্বাণ করবে, তাদের চিত্তকে সত্য ও সুন্দরের সাধনায় দুর্নীতিবিমুক্ত বাংলাদেশ গঠনে সূর্যসৈনিকের ভূমিকা পালনে উদ্বেলিত করবে- এটিই তো সময়ের দাবি।

লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা।

 

 

সর্বশেষ খবর