মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

দুর্গতিনাশিনী শ্রীদুর্গা

অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী

দুর্গতিনাশিনী শ্রীদুর্গা

দুর্গা নামের মানে হলো- ‘দ’ অক্ষর দৈত্যনাশক, ‘উ-কার’ বিঘœনাশক, ‘রেফ’ রোগনাশক, ‘গ’ অক্ষর পাপনাশক ও ‘অ-কার’ ভয়-শত্রুনাশক। অর্থাৎ দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয়-শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন তিনিই দুর্গা। যে দেবী অগম্যা বা যাকে সহজে পাওয়া যায় না তিনিই মদুধদুর্গা। চন্ডীর বর্ণনা অনুযায়ী, দুর্গম নামক অসুরকে বধ করায় মায়ের নাম হয়েছে দুর্গা। দুর্গম অসুরের কাজ ছিল জীবকে দুর্গতিতে ফেলা। দুর্গমকে বধ করে যিনি স্বর্গবিতাড়িত দেবগণকে হৃতরাজ্য ফিরিয়ে দেন এবং জীবজগৎকে দুর্গতির হাত থেকে রক্ষা করেন তিনি মা দুর্গা। মায়ের পদতলে মহিষাসুর অশুভ ও অহংকারের প্রতীক, যা জগতের অমঙ্গলের হেতু। ত্রিনয়নী মহাদেবী দুষ্টের দমনে শিষ্টের পালনে আবির্ভূতা, এ পুজোর মূর্তি কল্পনায় ফুটে ওঠে শৌর্য বীর্য (কার্তিক), জ্ঞানভক্তি (সরস্বতী), সিদ্ধি (গণেশ), সম্পদ (লক্ষ্মী) এবং মানবজীবনের  ইহকালের বস্তুলাভ ও অন্তিমকালে মাতৃক্রোড়ে চির-আশ্রয়। পুরনো শাস্ত্রমতে দেবীর বোধন হয় বিল্ববৃক্ষে বা বিল্বশাখায়। ষষ্ঠীতে সন্ধ্যায় দেবীর বোধন হয়। পূজার ষষ্ঠীতে দেবীর ষষ্ঠাদিকল্প অর্থাৎ আবাহন, বোধন, আমন্ত্রণ, অধিবাস প্রভৃতি অনুষ্ঠান হয়। অন্যদিকে সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত প্রতিমায় দেবীর অর্চনা করা হয়। সপ্তমীতে অন্যতম অনুষ্ঠান নবপত্রিকা প্রবেশ কদলী বৃক্ষসহ আটটি উদ্ভিদ এবং জোড়াবেল একসঙ্গে বেঁধে শাড়ি পরিয়ে বধূর আকৃতির মতো তৈরি করে দেবীর পাশে বসানো হয়- একেই বলে কলাবউ। পূজার অষ্টমীতে বিশেষ অনুষ্ঠান অষ্টমী ও নবমী তিথির সন্ধিতে দেবীর বিশেষ পূজা হয়, যার নাম ‘সন্ধিপূজা’। হিন্দু ধর্মশাস্ত্রানুসারে দেবী দুর্গা ‘দুর্গতিনাশিনী’ বা সব দুঃখ-দুর্দশার বিনাশকারিণী। দেবী দুর্গা হলেন শক্তির রূপ, তিনি পরব্রহ্ম। অন্যান্য দেব-দেবী মানুষের মঙ্গলার্থে তার বিভিন্ন রূপের প্রকাশ মাত্র। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের  শরীর থেকে আগুনের মতো তেজরশ্মি একত্রিত হয়ে বিশাল এক আলোকপুঞ্জে পরিণত হয়। ওই আলোকপুঞ্জ থেকে আবির্ভূত এক দেবীমূর্তি। দেবী  দুর্গা দিব্য অস্ত্রে সজ্জিত আদ্যাশক্তি মহামায়া অসুরকুলকে একে একে বিনাশ করে স্বর্গ তথা বিশ্বব্রহ্মান্ডে শান্তি স্থাপন করেন।

আমাদের দেশে জাতীয়ভাবে এ উৎসবকে দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসব হিসেবে অভিহিত করা হয়। এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে একে শরৎকালের বার্ষিক মহোৎসব হিসেবে ধরা হয় বলে একে শারদীয় উৎসবও বলা হয়। কার্তিক মাসের দ্বিতীয় দিন থেকে সপ্তম দিন পর্যন্ত এ উৎসবকে মহালয়া, ষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাঅষ্টমী, মহানবমী ও দশমী নামে পালন করা হয়। অকালে বা অসময়ে দেবীর আগমন বা জাগরণ বলে বসন্তকালের এ উৎসবকে বাসন্তী পূজা বা অকালবোধনও বলা হয়। দুর্গা যেন সমস্ত জগতের প্রতীক, দুর্গাপূজা সমাজের সব বর্ণ, শ্রেণি ও পেশার সর্বস্তরের মানুষের মিলনমেলা ও উৎসব; সবার কল্যাণভাবনা ও প্রেরণার উৎস। মায়ের ডানপাশে রয়েছেন লক্ষ্মী ও গণেশ, বাঁ পাশে সরস্বতী ও কার্তিক। লক্ষ্মী ঐশ্বর্য ও সম্পদের, গণেশ সিদ্ধিদাতা ও গণঐক্যের, সরস্বতী জ্ঞানের, কার্তিক শৌর্য-বীর্যের প্রতীক। দেবী দুর্গা জগৎরূপে আমাদের আহার্যের সংস্থান করে আমাদের রক্ষণ ও প্রতিপালিত করছেন। দুর্গা যেন সমস্ত জগতের প্রতীক। চন্ডীতে বলা হয়েছে, তিনি আমাদের বুদ্ধিরূপে, নিদ্রারূপে, ক্ষুধারূপে, তৃষ্ণারূপে, ক্ষন্তিরূপে ইত্যাদি জীবন প্রকাশের যাবতীয় শক্তির উৎস, তার অস্তিত্বেই আমরা চেতনাবান, তার শক্তিতেই আমরা শক্তিমান। দুর্গা শক্তিদায়িনী। রাজভ্রষ্ট রাজা যুধিষ্ঠির বিপদ থেকে মুক্তিলাভ  করার জন্য মা দুর্গার আরাধনা করেছিলেন বলে মহাভারতের বিরাট পর্বের ২৪ অধ্যায়ে উল্লেখ আছে। ‘মা’ নাম করলেই আমরা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ভাব অনুভব করি। পূজা ও উপাসনার মাধ্যমে আমরা তারই শক্তিতে শক্তিমান হয়ে তাকেই লাভ করার চেষ্টা করি। দুর্গা শব্দের অর্থ যিনি জীবের দুর্গতি হরণ করেন। আরেকটি অর্থ দুর্জেয়া। দুর্গা, মহিষমর্দিনী, শলিনী, পার্বতী, কালিকা, ভারতী, অম্বিকা, গিরিজা, বৈষ্ণবী, কৌমারী, বাহারী, চন্ডী, লক্ষ্মী, উমা, হৈমবর্তী, কমলা, শিবানী, যোগনিন্দা প্রভৃতি নামে ও রূপে মায়ের পূজা হয়। যুগে যুগে বিভিন্ন সংকটের সময় তিনি মর্ত্যধামে আবির্ভূত হয়েছিলেন বিভিন্ন রূপে, বিভিন্ন নামে। তিনি তাই আদ্যাশক্তি মহামায়া, ব্রহ্মসনাতনী। দশভুজা মায়ের দশটি হাত দশ দিকের প্রতীক। অর্থাৎ বিশ্বব্রহ্মান্ডের সর্বত্রই ঈশ্বর বিরাজমান। মা দাঁড়িয়ে আছেন ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিমায়। তা হলো সৃজনী, পালনীত ও সংহারী শক্তির প্রতীক অর্থাৎ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রতীক। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে যিনি ব্রহ্মারূপে সৃষ্টি করেন, বিষ্ণুরূপে পালন করেন শিবরূপে তিনিই বিশ্বপ্রসারিণী, মাতৃরূপিনী দুর্গা। দেবী দুর্গা ব্রহ্মশক্তি স্বরূপিণী, তিনি বিভাসিতা মাতৃশক্তি, তিনি জগজ্জননীরূপে সর্বভূতে বিরাজমান। তিনি সকল প্রাণিতে চেতনারূপে, বুদ্ধিরূপে, শক্তিরূপে, শান্তিরূপে, শ্রদ্ধারূপে, দয়ারূপে ইত্যাদি নানারূপে বিরাজিত। সব অকল্যাণের হাত থেকে তিনি আমাদের অর্থাৎ তার সন্তানদের রক্ষা করেন, শাস্ত্রমতে দেবতা ও অসুরদের সংগ্রামে শরণাগত শুভবুদ্ধি ও কল্যাণকামী দেবতাদের তিনি সব সময় বরাভয় দান করেছেন।

মা দুর্গা জগজ্জুড়ে আছেন। তিনিই সমস্ত শক্তি ও গুণের আধারস্বরূপিণী, তিনি শরণাগত পালিনী, যে তার শরণ সকালে লয়, তিনি তার দুঃখ দূর করেন। সম্পদ, মহারি, লজ্জা, পুষ্টি, শ্রদ্ধা, তুষ্টি সবই মা দুর্গা। তিনি প্রলয় রাত্রি, তিনি নিয়তি, তিনি সর্বময়ী ও শক্তিময়ী। মা প্রসন্ন হলে সব বিপদ কেটে যায়, আর মা রাগ করলে বিপদ ঘটে, মনের সব বাসনা বিফল হয়। মা শরণাগত সন্তানকে কল্যাণ কাজের শক্তি ও প্রেরণা দিচ্ছেন দশ হাতে সতত সর্বপ্রতিকূলতা থেকে রক্ষা করে অভয় দিচ্ছেন এবং সন্তানকে পরম লক্ষ্যে পরিচালিত করছেন। মাতৃরূপিণী মহাশক্তির শরণাপন্ন হলে মা সন্তানের জন্য কল্যাণকর যথার্থ অভীষ্ট প্রদান করেন। চন্ডীতে তার স্তুতি করে বলা হয়েছে, হে দেবী! আপনি স্বর্গ ও মুক্তিদায়িনী মা আমাদের শত্রু বিনাশ করে আমাদের বিপদ থেকে এত দিন বাঁচিয়েছ, তেমনি ত্রিভুবনের সব দুঃখ-বিপদও তুমিই সব সময় দূর কোরো-  এই আমাদের প্রার্থনা। মা, আপনাকে প্রণাম করি।

লেখক : অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অব ডেন্টাল সার্জারি, বারডেম হাসপাতাল। ১৫/এ গ্রিন স্কয়ার, গ্রিন রোড, ঢাকা।

Email : [email protected]

সর্বশেষ খবর