বৃহস্পতিবার, ৫ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

আফ্রিকায় খাদ্য উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের মহাসুযোগ

মেজর নাসির উদ্দিন আহম্মদ (অব.) পিএইচডি

আফ্রিকায় খাদ্য উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের মহাসুযোগ

বিগত কয়েকদিনে বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদমতে, অবৈধ পথে বাংলাদেশ থেকে লাখো কোটি টাকা পাচার সহজ হলেও বৈধ পথে সম্ভাবনাময় খাতে বিদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য ন্যূনতম পুঁজি প্রেরণ একটি দুরূহ বা প্রায় অসাধ্য বিষয়। ফলে ২০১১ সাল থেকে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে প্রচুর কৃষিজমি প্রাপ্তির এবং লাখ লাখ গরিব বাংলাদেশির কর্মসংস্থান ও পুনর্বাসনের নিশ্চয়তা থাকলেও একমাত্র ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বা চলতি মূলধন বাবদ বৈধভাবে টাকা নেওয়ার ব্যবস্থা বা অনুমতি না থাকায় এ মহামূল্যবান সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। বাংলাদেশের সঙ্গে আফ্রিকার সম্পর্কের ইতিহাস অতি পুরনো। সেই ১৪ শতাব্দীতে ইবনে বতুতা তৎকালীন বাংলাদেশের ভূখন্ড ভ্রমণের সময় এখানে ‘মাগরিব’ অর্থাৎ পশ্চিমের আরব ও আফ্রিকার ব্যবসায়ীদের সাক্ষাৎ পান বলে তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন। স্বাধীনতার পরপরই আফ্রিকার দেশসমূহ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এ ক্ষেত্রে সেনেগাল ও মরক্কোর ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য এবং বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখনই আফ্রিকার সঙ্গে রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক জোরদার করার প্রচেষ্টা চালিয়াছিলেন। কিন্তু তাঁর মর্মান্তিক মৃত্যুর কারণে তা বাধাগ্রস্ত হলে আজ পর্যন্ত আর শুরু করা হয়নি। বর্তমানে আলজেরিয়া, মিসর, ইথিওপিয়া, কেনিয়া, লিবিয়া, মরিশাস, মরক্কো, নাইজেরিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশের দূতাবাস রয়েছে বলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যে প্রকাশ। তবে বিগত তিন দশকে আফ্রিকার বিরোধপূর্ণ ও গৃহযুদ্ধকবলিত বিভিন্ন দেশে জাতিসংঘের অধীনে শান্তিরক্ষী হিসেবে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করার সুবাদে বাংলাদেশের সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী, পুলিশ ও এনজিও তথা বাংলাদেশের সঙ্গে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা আফ্রিকার কঙ্গো, সুদানের দুটি অংশ, পশ্চিম সাহারা ও মালিতে জীবন বাজি রেখে কর্তব্যরত রয়েছেন। ইতিপূর্বে বাংলাদেশের বীর সেনারা আফ্রিকার নামিবিয়া, মোজাম্বিক, সোমালিয়া, লাইবেরিয়া, রুয়ান্ডা, সিয়েরালিয়ন, বেনিন, আইভরি কোস্টসহ আরও কিছু দেশে সাফল্যের সঙ্গে শান্তি স্থাপন করেছেন। ফলে যুদ্ধবিধ্বস্ত এসব দেশ তাদের নিজ নিজ দেশের উন্নতির জন্য বাংলাদেশের সহযোগিতা কামনা করে। এ ক্ষেত্রে বেশকিছু দেশ তাদের বিশাল, অব্যবহৃত ও কৃষিকাজের উপযোগী উর্বর জমিতে কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। আর সে আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে পাশের ভারতসহ বিভিন্ন দেশ ৯৯ বছরের ইজারা নিয়ে চাষাবাদ শুরু করেছে। কিন্তু সেই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের বিরাট সুনাম, বাস্তব অভিজ্ঞতা, ঘনিষ্ঠ পরিচিতি ইত্যাদি কাজে লাগানোর বিশাল সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এ বিষয়ে সরকারি বা বেসরকারিভাবে কোনো ফলপ্রসূ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানা নেই। শান্তিরক্ষীদের মাধ্যমে সিয়েরালিয়নের সাবেক কৃষিমন্ত্রী সুফিয়ান কার্গবো ‘দি বাংলা সালোন জয়েন্ট ভেঞ্চার অ্যাগ্রিমেন্ট প্রজেক্ট’ নামে যৌথ উদ্যোগে কৃষি খামার স্থাপনের একটি প্রস্তাব স্থানীয় একটি ইসলামী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক পরিচালকের কাছে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু বৈধ পথে টাকা (চলতি মূলধন) পাঠানোর সুযোগ না থাকায় তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।

উল্লেখ্য, শান্তিরক্ষীদের সুনাম কাজে লাগানোর বিষয়ে ইসলামী ব্যাংক অব জাম্বিয়া গ্রুপের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব রয়েছে। বাংলাদেশকে সহজ শর্তে জমি প্রদানের প্রস্তাব করেছে জাম্বিয়া, তানজানিয়া, সুদান ও সিয়েরালিয়নের মতো উর্বর মাটিবিশিষ্ট বিশাল দেশসমূহ। এ আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে ২০১১ সাল থেকেই বাংলাদেশের স্থানীয় ও প্রবাসী একদল উদ্যোক্তা ইসলামী ব্যাংক অব জাম্বিয়া নামক ব্যাংক স্থাপনে সফল হয়। বেসরকারি আরও কিছু প্রতিষ্ঠান সেখানে বিনিয়োগে সচেষ্ট রয়েছে। আফ্রিকায় কৃষি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাংলাদেশের জন্য বহুবিধ অবদান রাখতে পারে; যা উভয় দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে। বিশ্বব্যাপী ‘খাদ্য নিরাপত্তার’ বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। অতিসম্প্র্রতি শুধু পিয়াজের জোগান দিতে গিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে বাংলাদেশের বর্তমান জনপ্রিয় সরকার। অথচ খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি মনে রেখে দেশে বা বিদেশে পিয়াজ উৎপাদনের পরিকল্পনা থাকলে এমনটি হতো না। ২০১৫ সালে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের নির্বাচনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল ডালের সংকট। সে সময় ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিভিন্ন গুদামে হানা দিয়ে ৮০ হাজার টন ডাল উদ্ধার করে। খাদ্য সংকটের কারণে ভেনেজুয়েলার রাজনৈতিক অঙ্গন ও প্রশাসনে ব্যাপক উত্থান-পতন হয়েছে বিগত দশকে। এসব থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশকে আজ খাদ্য নিরাপত্তার কথা ভাবতে হবে। এ ক্ষেত্রে আফ্রিকার জমিতে বাংলাদেশের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে চাষাবাদ এবং তা দেশের বাজারে জোগান দেওয়া একটি বড় সমাধান হতে পারে। বাংলাদেশের বাজারে বর্তমানে বিদেশি আদা, রসুন, পিয়াজ, ডাল, ছোলা, সুগন্ধি চাল, গম, তেলবীজ ও হরেকরকম মসলার ব্যাপক আমদানি লক্ষ্য করা যায়।

এসব পণ্য বিদেশের মাটিতে উৎপাদনের ফলে বিদেশি কৃষক ও ব্যবসায়ীরা সরাসরি লাভবান হয়। অথচ একই ফসল যদি বাংলাদেশের বিনিয়োগকারী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সরকারি সংস্থা দীর্ঘমেয়াদে লিজ নেওয়া বিদেশের জমিতে বাংলাদেশের কৃষকের দ্বারা উৎপাদন করে, তবে খাদ্য নিরাপত্তার পাশাপাশি কৃষকের ব্যাপক কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগকারীদের লাভের সুযোগ থাকে। বাংলাদেশে জনসংখ্যার তুলনায় কৃষিজমির স্বল্পতা রয়েছে। বিরাজমান জমিতে লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতাসহ নানা কারণে ফসল উৎপাদন অনেক ক্ষেত্রেই বাধাগ্রস্ত হয়। আবার শিল্পায়ন, নগরায়ণ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের স্বার্থে ক্রমবর্ধমান হারে কৃষি বা আবাদি জমির পরিমাণ দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। চাষের জমি বাড়াতে গিয়ে কমছে বনাঞ্চল। এ ছাড়া জনবায়ু পরিবর্তনের কারণে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ক্রমেই হ্রাস পাবে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। এমনি এক প্রেক্ষাপটে আফ্রিকায় চাষাবাদের বিষয়টি বিবেচনার দাবি রাখে।

বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশ জাম্বিয়া, তানজানিয়া, উগান্ডা ও সিয়েরালিয়ন বাংলাদেশের বিভিন্ন বিনিয়োগকারীকে বিশাল এলাকা ৯৯ বছরের জন্য লিজ প্রদানের প্রস্তাব দিয়েছে। এসব প্রস্তাবকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য ২০১১ সালে তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ‘আফ্রিকায় কৃষি ও বাণিজ্য সম্প্রসারণে বাংলাদেশের করণীয়’ শীর্ষক সেমিনার, সে পরিপ্রেক্ষিতে পররাষ্ট্র সচিবের নেতৃত্বে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ সফর, তৎকালীন কৃষি সচিবের প্রচেষ্টায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সমন্বয়ে এক সভায় আফ্রিকার বিষয়ে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সহায়তায় সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা প্রদানের সিদ্ধান্ত ইত্যাদি বিবেচনায় মুদ্রানীতি পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ২০১১ সালে। কিন্তু আজ পর্যন্ত তা চূড়ান্ত রূপ লাভ করেনি। ফলে বাংলাদেশের নিটল-নিলয় গ্রুপ এবং প্রস্তাবিত ইসলামিক ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক অব বাংলা-জাম্বিয়া লি. ২০১১ সাল থেকে এ বিষয়ে বিদেশে পুঁজি বিনিয়োগসংক্রান্ত সুষ্ঠু নীতিমালার অপেক্ষায় রয়েছে। সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে প্রস্তাবিত ব্যাংকের উদ্যোক্তা নওয়াব আলী ভূইয়াকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এ-সংক্রান্ত অনুমোদন ২০১১ সালে চাওয়া হলেও আজ পর্যন্ত এ-সংক্রান্ত নীতিমালা পাওয়া যায়নি। সেজন্য বিশেষ বিবেচনায় জাতীয় স্বার্থে অনুমোদন চেয়েও বারবার ব্যর্থ হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়। ফলে বিদেশে জমি পাওয়া সত্ত্বেও তা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। পক্ষান্তরে আফ্রিকায় কৃষিজমি প্রাপ্তির এ সুযোগ লুফে নিচ্ছে চীন, ভারত, আমেরিকাসহ বহু দেশ। চীনের বহু কৃষক পরিবার ইতিমধ্যে জাম্বিয়ায় বসতি গড়েছে এবং ক্রমেই তা বাড়ছে। বাংলাদেশের প্রস্তাবিত ব্যাংকটিও এমন প্রস্তাব পেয়েছে। ফলে বাংলাদেশ থেকে কয়েক লাখ কৃষককে সপরিবারে জাম্বিয়ায় পুনর্বাসন ও উৎপাদনমুখী করে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের তুলনায় জাম্বিয়া প্রায় ৫ গুণ বড় (প্রায় ৭ লাখ ৫২ হাজার বর্গকিলোমিটার)। অথচ বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের তুলনায় জাম্বিয়ায় জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ মাত্র। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনামূলক চিত্র কমবেশি এমনই। অর্থাৎ জায়গা অনুপাতে লোকসংখ্যা এত কম যে আফ্রিকার কয়েকটি দেশে কোটি কোটি লোক সহজেই পুনর্বাসন করা যাবে। সেসব দেশের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে বারবার আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। যার ফলে এ সুযোগ কোনোক্রমেই হাতছাড়া করছে না বুদ্ধিমান দেশগুলো। আফ্রিকার কৃষিভিত্তিক বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালে দেখা যায়, মিসর প্রায় ৬০০ হেক্টর উর্বর জমির ওপর গ্রিন হাউস নির্মাণ করছে জাম্বিয়ার মাটিতে। ইউরোপের বিভিন্ন পরিবার বোস্টয়ানাভিত্তিক ইমারা হোল্ডিংস১য়ায় ৫০০ হেক্টর জমির ওপর সুস্বাদু ও দামি ফল বেরি উৎপাদন শুরু করতে যাচ্ছে, যা হবে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বেরিবাগান। চীন জাম্বিয়ায় উৎপাদিত খাদ্য সংরক্ষণ ও প্রয়োজনে তা চীন বা অন্যত্র রপ্তানির জন্য জাম্বিয়ায় নয়টি বৃহৎ খাদ্য সংরক্ষণাগার বা সায়লো নির্মাণ করছে এবং সেচের জন্য ১ হাজার গভীর নলকূপ স্থাপন করছে। চীনের ২০টি কোম্পানি জাম্বিয়ার ১০ হাজার হেক্টর জমিতে মাশরুম চাষ করছে। ২০১৭ সালেই চীন জাম্বিয়ায় কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত অঞ্চল নির্মাণের কাজ সমাপ্ত করেছে।

২০১৬ সালে ভারতের তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী রাধামোহন সিং জাম্বিয়ায় ডাল ও তেলবীজ উৎপাদন শুরুর কথা ঘোষণা দেন। তাতে ধরে নেওয়া যায় জাম্বিয়ায় ২০১১ সালে সহজে যা বাংলাদেশিরা করতে পারতেন, তা আজ করতে কঠিন হবে। কাজেই খাদ্য উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের বিষয়ে আফ্রিকায় কার্যক্রম শুরু করা আর দেরি করা মোটেই কাম্য নয়।

প্রস্তাবিত ইসলামিক ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক অব বাংলা-জাম্বিয়া লি.-এর উদ্যোক্তারা মাত্র ১০০ কোটি টাকা সরকারি অনুমোদনক্রমে বৈধ পথে জাম্বিয়ায় প্রেরণ এবং সে টাকায় কৃষকদের অনেকটা আয় থেকে দায় শোধের ভিত্তিতে পুনর্বাসন এবং বাংলাদেশের জন্য আবশ্যকীয় কৃষিপণ্য উৎপাদনের জন্য সরকারের শুভদৃষ্টির প্রত্যাশায় দিন গুনছেন। অবৈধ পথে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের বিপরীতে বৈধ পথে এই ১০০ কোটি টাকা বিদেশে বিনিয়োগের প্রত্যাশা বিবেচনার দাবি রাখে। হাজার কোটি টাকাও সাবেক অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টিতে ছিল ‘পিনাটস’ (চীনাবাদাম) এবং ‘রাবিশ’। অথচ ১০০ কোটি টাকার জন্য একদল উদ্যোক্তা ১০ বছর অপেক্ষা করছেন। তাদের আবেদনে ‘না’ বললেও তারা হয়তো তাদের ভুল বুঝতে পারতেন বা সংশোধনের সুযোগ পেতেন। অথচ ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ কিছুই না বলার সংস্কৃতি থেকে দেশ কবে মুক্তি পাবে, তার উত্তর মেলে না। তবে বর্তমান মানবিক সরকার এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আস্থা হারাতে চান না উদ্যোক্তারা। তারা সব গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনসহ অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করে বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ প্রত্যাশা করছেন। সরকার ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি বিবেচনা করলে অচিরেই হয়তো আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে পাঠানো খাদ্যশস্যে নিশ্চিত হবে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা। চাল-ডাল-পিয়াজ-রসুনের জন্য দীর্ঘ লাইনে হয়তো আর দাঁড়াতে হবে না রাজধানীবাসী। বাংলাদেশের বেকারত্বের ভয়াবহ চিত্র অনেকভাবে প্রকাশ পেলেও বিশেষভাবে প্রকাশ পায় যখন ভূমধ্যসাগরে আর মালয়েশিয়ার জঙ্গলে বাংলাদেশিদের নির্মমভাবে লাশ হতে দেখা যায়। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের বেকারত্ব দূর করার বিষয়ে দেশের বাইরের বৈধ সুযোগকেও কাজে লাগাতে হবে। আন্তর্জাতিক ইসলামিক ব্যাংক অব জাম্বিয়ার মাধ্যমে সারা বিশ্বে এর শাখা স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশের বেশ কয়েক হাজার শিক্ষিত লোকের যেমন চাকরি হবে, তদ্রুপ বৈধ পথে লাখ লাখ বেকারের কর্মসংস্থান ও পুনর্বাসনের কাজও এই ব্যাংকের মাধ্যমে করা সম্ভব। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শুধু আফ্রিকার ২৪-২৫টি দেশেই ১ কোটি কৃষক পরিবার এবং প্রতি পরিবারে চারজন হিসাবে মোট ৪ কোটি লোক পর্যায়ক্রমে পুনর্বাসন করা সম্ভব। তাদের কৃষিকাজে সহযোগিতা করার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কৃষি সহকারী এবং এসব পরিবারের শিক্ষার জন্য শিক্ষক, স্বাস্থ্যের জন্য ডাক্তার-নার্স, বাড়িঘর তৈরির জন্য ইঞ্জিনিয়ার, ধর্মীয় কাজের জন্য ইমাম-মুয়াজ্জিন এবং ধোপা, নাপিত, দর্জি, রাজমিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রিসহ বিপুলসংখ্যক ব্যবসায়ী ও পেশাজীবীর প্রয়োজন হবে। তাতে প্রায় কয়েক কোটি লোকের কর্মসংস্থান ও পুনর্বাসনের সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ২৫ ভাগও যদি বাস্তবায়ন হয় তবে অনায়াসে লাখ লাখ লোকের কর্মসংস্থান ও পুনর্বাসন একমাত্র আফ্রিকা মহাদেশেই করা সম্ভব। তা ছাড়া উক্ত ব্যাংকের শাখা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত ও পিছিয়ে পড়া অঞ্চলে স্থাপন করা হলে জায়গাজমি বন্ধক দিয়ে ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে আফ্রিকায় যাওয়া যাবে এবং আফ্রিকায় ঠিকঠাকমতো জায়গাজমি বুঝে পেয়ে বাংলাদেশে ব্যাংকে বন্ধককৃত জমি বাড়িঘরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। এভাবে আফ্রিকায় সুন্দর ও উন্নত জীবনযাপন সম্ভব, যা ভারত, পাকিস্তান ও চীনারা শুরু করেছে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে বেকারত্বের কারণে অনেকেই অন্যায় ও অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে। এসব বেকারকে বৈধভাবে চাকরি ব্যবসা ও পেশার ব্যবস্থা করতে দিলে দেখা যাবে দেশে অপরাধপ্রবণতা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আফ্রিকার কৃষি ক্ষেত্রে দেশের অবহেলিত ও দরিদ্র পরিবারগুলো পুনর্বাসনের মহাপরিকল্পনা কাজে লাগানোর জন্য দেশ-বিদেশে বিজ্ঞ, সচেতন ও সচ্ছল লোক এগিয়ে আসা একান্ত জরুরি এবং জুতসই সরকারি নীতিমালা অত্যাবশক।

                লেখক : সিয়েরালিয়নে নিযুক্ত সাবেক শান্তিরক্ষী এবং  নিরাপত্তা ও উন্নয়নবিষয়ক গবেষক।

সর্বশেষ খবর