বৃহস্পতিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনার কারণে কার কী অবস্থান

হানিফ সংকেত

করোনার কারণে কার কী অবস্থান

করোনাভাইরাসের ভয়াল থাবায় আক্রান্ত সারা পৃথিবী। আক্রান্ত আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। আর এই অদৃশ্য ভাইরাসের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধাস্ত্র-সচেতনতা, সতর্কতা এবং ঘরে থাকা, পাশাপাশি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও সরকার নির্দেশিত নিয়মগুলো যথাযথভাবে মেনে চলা। এই রোগ থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদের চোখ, নাক, মুখ রক্ষা করতে হবে। কারণ এ পথেই এই অদৃশ্য ভাইরাসটি আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। তাই তো বারবার হাত ধোয়ার আহ্বান। যাতে হাতের মাধ্যমে ভাইরাসটি আমাদের শরীরে ঢুকতে না পারে।

আসলে এই আগ্রাসী ভাইরাসে থমকে গেছে সারা পৃথিবী। কোনো যুদ্ধ নয় অথচ দেশে দেশে জারি করা হয়েছে কারফিউ, জরুরি অবস্থা, লকডাউন। স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত সব বন্ধ। উঁচু-নিচু, ধনী-গরিব, অর্থের দাপট, অস্ত্রের শক্তি, ক্ষমতার দম্ভ, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, পারমাণবিক শক্তি কিছুই কাজে লাগছে না এই অদৃশ্য আণুবীক্ষণিক ভাইরাস প্রতিরোধে। বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোও আজ অসহায়। দেশে দেশে বন্ধ অর্থনীতির চাকা, বিশ্বজুড়ে আমদানি-রপ্তানির চেইন ভেঙে পড়েছে। এক দেশ থেকে অন্য দেশে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। মন্দার মুখে পড়েছে বিশে^র অনেক দেশই। হাত পাতছে বিশ্বব্যাংকসহ বিশ্বের বড় বড় সাহায্য সংস্থার কাছে। সব মিলিয়ে আমরা একটা জটিল সময় পার করছি। সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। আর এই মুহূর্তে যদি আমরা করোনার বিরুদ্ধে আমাদের সচেতনতা ও সতর্কতার নিয়মগুলো যথাযথভাবে পালন না করি তাহলে সামনে আরও বড় ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। কবিগুরু বলেছেন, ‘ব্যাধির চেয়ে আধিই হলো বড়’। অর্থাৎ রোগের চেয়ে দুশ্চিন্তাটাই বড়। সুতরাং চিন্তিত কিংবা আতঙ্কিত না হয়ে নিয়মানুবর্তী হতে হবে। নিজের জীবনের জন্যই করোনা প্রতিরোধক নিয়মগুলো মেনে চলতে হবে।

তবে আজ আমার লেখার উদ্দেশ্য করোনা বা তার প্রতিরোধ নিয়ে নয়। কারণ এ বিষয়গুলো এখন অনেকেরই জানা। আমি আজ লিখতে চাইছি এই করোনার কারণে কার কী অবস্থান এবং করোনাকালের কিছু করুণ প্রতিভা নিয়ে। প্রথমেই আসি অবস্থান প্রসঙ্গে। ছোটবেলায় আমরা পড়েছি, ‘সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’। আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা বাল্যশিক্ষার এ আদর্শকে ধারণ করে মানুষের সেবা করছেন। যাদের জীবন সাধনার নামই হচ্ছে জনকল্যাণ। করোনা দুর্যোগের এই ক্রান্তিকালে আমরা তেমনই কিছু মানুষকে দেখতে পেয়েছি, যারা তাদের সীমিত সামর্থ্য নিয়েও বিত্তহীন, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। যেমন-নাটোরের বাঘাতিপাড়া উপজেলার জিয়াউর রহমান ও শিরিন আক্তার দম্পতি। জটিল রোগে আক্রান্ত স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য জমানো ১ লাখ টাকা যারা অসহায় মানুষের জন্য দিয়েছেন। ডা. নুরুল হাসান রাজধানীর উত্তরায় যিনি নিজে গিয়ে রিকশাচালকদের চাল, ডাল, লবণ, আলু ও সাবান বিতরণ করেছেন। পটুয়াখালীতে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা ইতালিপ্রবাসীর বাসায় পুলিশ বাজার করে দিয়েছে। করোনায় শ্রমিক সংকট, তাই ধান কাটা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষক। এ সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক স্থানীয় ছাত্র-জনতাকে নিয়ে কৃষকের ধান কেটে দিয়েছেন। এমনই অনেক আশা জাগানিয়া দৃষ্টান্ত আমরা দেখেছি। যা মানুষকে উদ্দীপ্ত করেছে, উদ্বুদ্ধ করেছে। সবচেয়ে মনে দাগ কেটেছে করোনাভাইরাসে অসহায় মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসা বৃদ্ধ ভিক্ষুক নাজিমুদ্দিনের (৮০) সাহায্য দেওয়ার বিষয়টি শুনে। শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার কাংশা ইউনিয়নের বৃদ্ধ নাজিমুদ্দিন তার ঘর মেরামতের জন্য ভিক্ষা করে জমানো ১০ হাজার টাকা স্থানীয় ইউএনওর হাতে তুলে দিয়েছেন। নাজিমুদ্দিনকে সশ্রদ্ধ সালাম।

পাশাপাশি ঘৃণা ও ধিক্কার জানাচ্ছি সেসব মানুষকে, যারা অসহায় মানুষের জন্য বরাদ্দকৃত ত্রাণসামগ্রী আত্মসাৎ করছেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, এই চুরি কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত জনগণের সেবক নামধারী কিছু জনপ্রতিনিধিও। এসব দুর্নীতিবাজ ছাড়াও আর এক দল রয়েছে যারা ত্রাণ দেওয়ার চাইতে ত্রাণ প্রচার কার্যক্রমে ব্যস্ত বেশি। এরা ত্রাণ দেয় এক পোঁটলা কিন্তু ক্যামেরার সামনে সেই পোঁটলা নিয়ে পোজ দেয় ৮-১০ জন। ফলে ছবি না তোলা পর্যন্ত বেচারা দিনমজুরকে পোঁটলা হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় দীর্ঘক্ষণ, যা অমানবিক। শুধু তাই নয়, ছবি তোলার পর ত্রাণ ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এদের ত্রাণদস্যুও বলা যায়।

তবে কিছু কিছু মানুষের ত্রাণ কার্যক্রমের প্রচারণার প্রয়োজনও রয়েছে। যেমন-শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও জনপ্রতিনিধি। তবে এ সময় এদের অনেকের অনুপস্থিতির কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এদের নিয়ে অনেক বিরূপ মন্তব্য করা হচ্ছে। করা হচ্ছে ট্রল। কদিন আগে একটি টিভি চ্যানেলের টকশোয় এক সাংবাদিক একজন শিল্পীকে প্রশ্নও করেছিলেন, ‘নির্বাচনে বিজয়ের পর সরকারের ঊর্ধ্বতন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের চারপাশে যেভাবে শিল্পীদের দেখা গেছে, এই দুর্যোগে সেভাবে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে না কেন?’

আবার টিভিতে, পত্রিকায় অনেককেই ইদানীং বলতে শোনা যায়, আমি ব্যক্তিগতভাবে গোপনে ত্রাণ দিচ্ছি, প্রচার করতে চাই না। এ ধরনের কথা বলার পেছনেও অনেকের উদ্দেশ্য থাকে। এ কথা বলে অনেকে যেমন নীরবে ত্রাণ দিচ্ছেন, তেমনি আবার না দিয়েও অনেকে গোপনে দিয়েছি বলে পার পেতে চেষ্টা করছেন। আসলে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য, পরিচিত ও জনপ্রিয় মানুষের ত্রাণ কার্যক্রম গোপনে নয়, প্রকাশ্যে করা উচিত। তাতে অন্যরা উদ্বুদ্ধ হয়। প্রসঙ্গক্রমে বলছি, আমরা নিজেরাও ইত্যাদি পরিবারের পক্ষ থেকে এই দুর্যোগে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। এসব পদক্ষেপে অংশগ্রহণ করেছেন ইত্যাদিতে বিভিন্ন সময়ে প্রদর্শিত বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিরা। তারই ধারাবাহিকতায় চলতি এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকেই রাজধানীর ১৫টি পয়েন্টে ‘ইত্যাদি’ কর্মীদের মাধ্যমে ও সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলা সদরের আলহাজ সিদ্দীক উচ্চবিদ্যালয় মাঠে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের উপস্থিতিতে ফেসবুকে সেবাদানকারী মামুন বিশ্বাসের মাধ্যমে কয়েক শ অসহায় ও অসচ্ছল পরিবারের মধ্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। পাশাপাশি ৩১ মার্চ থেকে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ পুরোটাই চলেছে দেশব্যাপী সচেতনতা কার্যক্রম। ইত্যাদিতে প্রদর্শিত ছাদকৃষির প্রবর্তক গ্রিন সেভার্সের প্রধান আহসান রনির মাধ্যমে নওগাঁ, কুড়িগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, নাটোর, পাবনা ও পটুয়াখালীর সাত উপজেলার ৪৭টি ইউনিয়নে, রাজশাহীর ‘ওরা ১১ জন’-এর মাধ্যমে চারঘাট ও বাঘা উপজেলায়, শ্রেণিকক্ষে নিয়মিত হাজির হওয়া কতর্ব্যনিষ্ঠ শিক্ষক নূরুল ইসলামের মাধ্যমে কক্সবাজারসহ আরও অনেক স্থানেই সচেতনতামূলক মাইকিং কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। বর্তমানে ইত্যাদির উদ্যোগে ‘সিএসআর উইন্ডো’-এর কর্মীদের মাধ্যমে চলছে ‘পাশে আছি’ কার্যক্রম। এ কার্যক্রমে যে কোনো পরিবার অসহায় মানুষকে খাবার দিতে চাইলে এসব কর্মী তাদের বাড়ি থেকে কমপক্ষে ১০ জনের জন্য রান্না করা খাবার সংগ্রহ করে ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। এ সময় আরও অনেক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানই প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করে মানুষের সেবায় এগিয়ে এসেছেন। কিছু প্রতিষ্ঠানকে দেখলাম রাস্তায় বিভিন্ন স্থানে সবজি স্তূপ করে রেখেছে, সেখান থেকে যার যা প্রয়োজন নিয়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ ভাসমান মানুষের হাতে পৌঁছে দিচ্ছেন খাদ্যসামগ্রী। এসব কার্যক্রম মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছে। এসব সাহায্য, সহযোগিতা, সহমর্মিতার কথা যত বেশি প্রচার হবে, ততই আলোকিত হবে বিবেকের চোখ। মানুষের পাশে এসে দাঁড়াবে মানুষ।

ত্রাণের পর এবার একটু সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে আসা যাক। করোনাকালের সংগীত ও কবিতা চর্চা। ফেসবুকের কল্যাণে ইতিমধ্যে কারও কারও সংগীত প্রতিভা দেখে কেউবা তৃপ্ত, কেউ ক্ষিপ্ত, কেউ ক্ষুব্ধ, কেউ হয়েছেন উদ্বুদ্ধ। এসব প্রতিক্রিয়ার কারণ করোনা দুর্যোগে ফেসবুকে প্রদর্শিত কিছু অদ্ভুত মোবাইল সংগীত। ভাগ্যিস এগুলোর লিরিক বা কথা পাশে লিখে দেওয়া হয়েছিল, নইলে এগুলোর মর্মকথা উদ্ধার করা কঠিনই ছিল। নববর্ষে হঠাৎ করে ইঙ্গ-বঙ্গ ভাষার মিশ্রণে শিল্পী, সাহিত্যিকদের অংশগ্রহণে এক উদ্ভট বৈশাখী সংগীত উদয় হলো ফেসবুকে। গানটিতে ইংরেজি শব্দদূষণে মনে হয়েছে নববর্ষে যেন বাংলা ভাষার আকাল পড়েছে। দেশের কজন বিখ্যাত শিল্পীও এসব গান নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। স্বনামধন্য গীতিকার মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বাংলা নববর্ষ নিয়ে গানে, বাংলা শব্দের আকাল দেখে বুঝলাম ইংরেজরা স্বভাবে যা ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে, ওটাতে এ জাতির তরুণ প্রজন্ম নতুন করে সুখ অনুভব করছে। বয়স্কদের কেউ কেউ সে সুখের জাবর কেটে কেটেও পুলক অনুভব করছেন।’ এ-জাতীয় গান সম্পর্কে ফেসবুকে অনেকেই অসন্তোষ প্রকাশ করে মন্তব্য করেছেন। একজন লিখেছেন, ‘এই গান যে শ্রেণির মানুষ শোনে তারা অনেক আগে থেকেই সতর্ক আছে। যাদের পকেটে টাকা নাই কিন্তু পেটে ক্ষুধা আছে তাদের ঘরবন্দী রাখতে কিছু করুন। এই গান শুনে তারা সচেতনও হবে না। আর পেটের ক্ষুধাও মিটবে না।’ শেষে তিনি লিখেছেন, ‘নিজেদের বিনোদিত করা আর টিকিয়ে রাখার এ ধরনের প্রবণতা নোংরা মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ।’

এবার কবিতা প্রসঙ্গ। একটি কবিতা হচ্ছে, ‘শঙ্খচিল’। কবিতাটি একটি জাতীয় দৈনিক চিত্রায়ণ করে অনলাইনে প্রচার করেছে। এ কবিতাটির লেখকের নাম দেওয়া হয়েছে কবি পার্থ মুখার্জি। ২৬ মার্চ ভারতের মঙ্গলকোট ডটকমে কবিতাটি প্রকাশিত হয় বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশ। কিন্তু ১৭ এপ্রিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সায়ন দাস ফেসবুক লাইভে এসে জানালেন কবিতাটি তারই লেখা। ২৩ মার্চ রাতে কবিতাটি তার ফেসবুকে প্রকাশ করেন বলে পত্রিকান্তরে জানা যায়। কবিতাটির মূল লেখক সম্পর্কে এই লেখা পর্যন্ত সঠিক কোনো তথ্য পাইনি। এ তো গেল এক কবিতা কাহিনি। আর দুটি কবিতা হচ্ছে ‘এ যাত্রায় বেঁচে গেলে’ এবং ‘এবার বেঁচে গেলে’। যার শিরোনাম ভিন্ন হলেও বিষয়বস্তু কাছাকাছি। কবিতা দুটি নিয়েও চলছে পারস্পরিক দোষারোপ এবং দাবি করা হচ্ছে লেখকস্বত্ব। এদিকে প্রবাসী শিল্পী টনি ডায়েস ২১ জন প্রবাসী শিল্পীকে নিয়ে চিত্রায়ণ করেছেন ‘এ যাত্রায় বেঁচে গেলে’ কবিতাটি। কবির নাম লিখেছেন, সহস্র সুমন। আবার এরই মধ্যে সাংবাদিক সোহেল সানি কবিতাটি তার লেখা বলে দাবি করে লেখক হিসেবে তার নাম উল্লেখ না করায় অভিনেতা টনি ডায়েসের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেছেন। তবে কবির নাম যা-ই হোক, ‘এবার বেঁচে গেলে’ কিংবা ‘এ যাত্রায় বেঁচে গেলে’ কবিতা দুটিতে যা যা করার কথা বলা হয়েছে, অনেকেই বলছেন তা তাদের আগেই করা উচিত ছিল। যেমন- ‘অন্যের হিসাব চুকিয়ে দেওয়া, নীড়ের ছানার খবর নেওয়া, ঋণী না হওয়া, অহংকারী না হওয়া, অসৎ পথে না চলা, গানের জন্য গলা সাধা’- এমনি আরও অনেক কথা রয়েছে যেগুলো সবার জীবনে করার সুযোগ ছিল কিন্তু কেন করেননি তা ভেবেও অনেকে কোনো জবাব খুঁজে পাচ্ছেন না। অনেকে সংশয় প্রকাশ করেছেন কেউ যদি এত বছরেও এ কাজগুলো না করে থাকেন, তবে ভবিষ্যতেও যে করবেন তার কি নিশ্চয়তা আছে? আবার কেউ কেউ বলছেন, এখনো এসব কাজ না করার জন্য যদি আক্ষেপ থেকেই থাকে, এখনো তো সময় আছে, করে ফেললেই পারেন। এখন ভাইরাল হওয়া এই কবিতাটি যে আসলে কার লেখা, কিংবা কে কার থেকে ধারণা নিয়ে লিখেছেন সে বিষয়ে এই লেখা পর্যন্ত সর্বশেষ তথ্য আমার জানা নেই। ইদানীং মিডিয়ায় অনেকেরই সংগীত এবং এ-জাতীয় কবিতা প্রকাশের পর রাজনৈতিক নেতাদের মতো চামচা বাহিনী প্রশংসার ডালি নিয়ে বসে থাকে। চলে পারস্পরিক পিঠ চুলকানি। এ বলে তোমারটা ভালো, ও বলে তোমারটা। এই করোনাকালে ফেসবুক, ইউটিউবে এমনি অনেক মজার মজার জিনিস দেখা গেছে।

এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। এই করোনা দুর্যোগে অনেক প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরাই তাদের ন্যায্য মজুরি পাচ্ছেন না বলে শোনা যাচ্ছে; যা দুঃখজনক। তবে কষ্ট লাগে যখন দেখি দেশসেরা কোনো ক্রিকেটারের ফার্মের শ্রমিকরা চার মাস বেতন না পেয়ে আন্দোলনে নেমেছেন। অথচ সুদূর আমেরিকা থেকে সেই ক্রিকেটারই আমাদের নানান সচেতনতার কথা বলছেন। অথচ তারই ফার্মের শ্রমিকরা দীর্ঘ চার মাস বেতন না পেয়ে আছেন। সচেতন মানুষের এমন উদাসীনতা কাম্য নয়। শুনেছি বিষয়টি মিডিয়ায় প্রচার হওয়ার পর শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য বেতন পেয়েছেন।

এবার মানুষের কিছু অমানবিক আচরণ প্রসঙ্গে আসি। এই করোনা পরিস্থিতিতে কিছু কিছু স্থানে মানুষ তাদের কবরস্থানের সামনে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে লিখে রেখেছেন, ‘করোনায় মৃত কোনো ব্যক্তির লাশ এখানে কবর দেওয়া যাবে না।’ এলাকাবাসীর বাধার মুখে বাধাগ্রস্ত হয়েছে হাসপাতাল নির্মাণ। এলাকার হাসপাতালগুলোতেও যেন করোনা রোগীর চিকিৎসা না হয় সেজন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে হুমকিও দেওয়া হচ্ছে। করোনা আক্রান্ত রোগীকে বাড়িছাড়া করেছে কেউ কেউ। করোনার কারণে টাঙ্গাইলে মাকে ফেলে রেখে গেছে সন্তানরা। পরে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। একই ঘটনা ঘটে সাভারে আরেক মায়ের সঙ্গে। আদরের সন্তানরা কীভাবে মাকে এভাবে ফেলে যায় তা দেখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ দেশের অনেক মানুষ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এসব দেখে মনে হয় মানুষের বিবেক, মনুষ্যত্ব, মূল্যবোধ দিন দিন লোপ পাচ্ছে। নিজের আত্মীয়স্বজনকে নিজেরাই কবর দিতে যাচ্ছে না ভয়ে। এসব ক্ষেত্রে যখন আমাদের মানবিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় দেখছি, তখন একদল স্বেচ্ছাসেবীকে দেখছি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে এসেছেন নিজেদের উদ্যোগে সেই লাশ দাফন করতে। তাদের জানাচ্ছি আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।

তবে একটি কথা- করোনা দুর্যোগে যত দুর্ভোগই হোক না কেন, এর কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে। এই করোনায় মানুষ আতঙ্কিত হয়েছে ঠিকই কিন্তু ঘরে আটকে থাকার কারণে পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় হয়েছে। পরিবারের সবাই একসঙ্গে গল্প করছে, একসঙ্গে খাচ্ছে। এই ঘরবন্দী জীবন সেই সুযোগ করে দিয়েছে। একজন আরেকজনের খোঁজখবর নিচ্ছে। কারও কিছু লাগবে কিনা, কোনো সাহায্যের প্রয়োজন আছে কিনা, মুঠোফোনে খুদে বার্তা আদান-প্রদান করছে। বলা যায় এই করোনা আমাদের ভালোবাসা, হৃদ্যতা, সহযোগিতা সর্বোপরি সামাজিক একাত্মতাকে বাড়িয়েও দিয়েছে।

এই সময়ে পরিবেশের দিক থেকেও কিছু ইতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গাড়ি-ঘোড়া, যান্ত্রিক জীবন, কোলাহল, শব্দদূষণ সবকিছু থমকে যাওয়ায় বায়ুমন্ডলে কমে গেছে বায়ুদূষণ, কমেছে শব্দদূষণ। এমনকি পরিবেশ দূষণ আর পর্যটকের ভিড় ও কোলাহল নেই বলে বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে খেলছে ডলফিন। এই দূষণমুক্ত পরিবেশের জন্য বাতাসটাও মনে হচ্ছে নির্মল, বিশুদ্ধ। ভবিষ্যতে আমরা যেন এই সময়টাকে ভুলে না যাই, এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যৎকে সাজাই। পরিশেষে কৃতজ্ঞতা ও আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই সেসব মানুষ, সেসব চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, সংবাদকর্মী, পরিচ্ছন্নতা কর্মী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য- যারা এই করোনার মধ্যেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। ধন্যবাদ জানাই সেসব স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও মানুষকে যারা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আর মানুষের এই ইতিবাচক দিকগুলো আমাদের মানবিক মূল্যবোধকে আরও সমৃদ্ধ করবে। জাগ্রত হবে মনুষ্যত্ব।

পরিশেষে একটি কথা বলে শেষ করতে চাই। পত্রিকায় দেখলাম করোনাভাইরাসে কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষের সহায়তায় ১০ হাজার টাকা দান করা সেই ভিক্ষুক বৃদ্ধ নাজিমুদ্দিনকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভিটেমাটি, পাকা বাড়ি ও একটি দোকান করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই সহানুভূতি ও মহানুভবতায় কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতা।

 

                লেখক : গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

সর্বশেষ খবর