করোনাকালীন দুর্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস নেওয়া বা না নেওয়া নিয়ে বেশ বিতর্ক চলে আসছে। ১৮ মার্চ থেকে বন্ধ আছে বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থীরা দীর্ঘ শিখন ক্ষতির সম্মুখীন। দিন দিন করোনা পরিস্থিতি যেভাবে ভয়াবহ আকার ধারণ করছে তাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেপ্টেম্বরের আগে খোলার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এমনকি সেপ্টেম্বরেও খোলা যাবে কিনা সন্দেহ। করোনার কারণে এমনিতেই সেশনজটের কবলে পড়ে গেছেন শিক্ষার্থীরা। ছুটি যদি আরও দীর্ঘায়িত হয় তবে দীর্ঘ সেশনজটের কারণে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নেওয়ার জন্য ইউজিসি অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রমের ওপর জোর দিচ্ছে। ইতোমধ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে ক্লাস নেওয়া শুরু করেছে। অল্প কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কিছু মাত্রায় অনলাইনে ক্লাস শুরু করলেও বেশির ভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন কার্যক্রম শুরু করেনি নানাবিধ প্রতিকূলতার কথা বিবেচনায় নিয়ে। আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষাক্রম যেমন প্রয়োজনীয় তেমন শিক্ষাঙ্গন ও শ্রেণিকক্ষের মানবীয় ও ভৌত উপাদানসমূহের উপস্থিতিও গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের শিখনে শ্রেণিকক্ষ, পাঠাগার, শিক্ষাঙ্গন ও এর পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
তবে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে অবস্থানকারী শিক্ষার্থীদের বিশেষ চাহিদার কথা বিবেচনা করে বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন কোর্স এমনকি ডিগ্রি সম্পন্ন করার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ১৯৮৯ সালে সর্বপ্রথম ইউনিভার্সিটি অব ফিওনিক্স অনলাইন এডুকেশনের যাত্রা করলেও ইউনিভার্সিটি অব ইলিয়নস যখন প্রথম ইন্টারনেট ওয়েব ব্রাউজার তৈরি করে তখন থেকে অনলাইন শিক্ষার বিস্তার ঘটে স্বল্প খরচে ঘরে বসে ডিগ্রি লাভের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায়। এটা দূরশিখনের একটি ধরন। শিক্ষার্থীরা একটি প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে বিশ্বের যে কোনো প্রান্ত থেকে ঘরে বসেই ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে লাইভে অংশগ্রহণের মাধ্যেমে ক্লাস সম্পন্ন করতে পারেন। এ ক্লাসসমূহ সেইভ করে রাখা যায় বিধায় একদিকে নোট রাখার প্রয়োজন হয় না, অন্যদিকে সরাসরি উপস্থিত না থেকেও পরে দেখে নিতে পারেন।
অনলাইন ক্লাসের জন্য জুম, গুগল ক্লাসরুম, স্কাইপ, ইউটিউব, ফেসবুক লাইভ, টিম ভিউয়ারসহ বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করা হয়। অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণকারীরা পরস্পরকে দেখতে এবং শিক্ষককে প্রশ্ন করতে পারেন। ইমেজ, ভিডিও, স্লাইড ইত্যাদিও ব্যবহার করা যায়। অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ারও ব্যবস্থা আছে। অনেক সময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিখনকে কার্যকর করতে ই-লার্নিং, এম-লার্নিং, ফ্লিপ্ড ক্লাসরুম, ব্লেন্ডেড লার্নিংয়ের ব্যবস্থা করে। অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের এসব সুবিধা থাকা সত্ত্বেও শিক্ষণ-শিখনের তত্ত্ব ও কৌশলের বেশির ভাগই প্রয়োগ করা সম্ভব হয় না বিধায় কার্যকর শিখন নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তবে করোনার কারণে এখন বিকল্প শিক্ষা কার্যক্রম হিসেবে শ্রেণিকক্ষের পরিবর্তে বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই অনলাইনের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার প্রধানতম শর্ত হলো স্মার্টফোন অথবা কম্পিউটার বা ল্যাপটপ ও উচ্চগতির ইন্টারনেট সংযোগ। বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকস ২০১৯-এর তথ্যানুযায়ী মাত্র ৫.৬% বাড়িতে কম্পিউটার রয়েছে। ৩৭.৬% বাড়িতে ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে। শহরাঞ্চলে এ হার ৫৩.১% ও গ্রামাঞ্চলে ৩৩.২%। বিভাগীয় ও জেলা সদরগুলোয় প্রয়োজনীয় ওয়াইফাই বা ব্রডব্যান্ড সুবিধা থাকলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে মোবাইল ডাটা ছাড়া ইন্টারনেটের সুবিধা পাওয়া কঠিন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীর ১৩ দশমিক ৩৮ শতাংশের স্মার্টফোন নেই। আবার গ্রামের দিকে ইন্টারনেটের গতি খুবই ধীর ফলে অনেক সময়ই ভয়েস এলেও ভিডিও আসে না। নেটওয়ার্কের জন্য গাছে ওঠার মতো ঘটনা প্রায়ই শোনা যায়। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়া নিত্যনৈমিত্তিক।অনেক শিক্ষার্থীর ইন্টারনেট প্রবেশগম্যতা থাকলেও ইন্টারনেট প্যাকেজের উচ্চমূল্য তাদের অনলাইন কার্যক্রমে অংশগ্রহণের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। সাধারণত একটি এক ঘণ্টার ভিডিও ক্লাসের জন্য ৪০০ থেকে ৬০০ মেগাবাইট ডাটা প্রয়োজন। একজন শিক্ষার্থীকে সপ্তাহে ১০টির মতো ক্লাস করতে হলে মাসে ২০ থেকে ৪০ জিবি ডাটার প্রয়োজন, টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানিসমূহের অপনীতির কারণে এর জন্য বেশ বড় ব্যয় প্রয়োজন হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা সাধারণত মধ্যবিত্ত বা তার ওপরের শ্রেণির বিধায় তারা এ ব্যয় যেভাবেই হোক চালিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রছাত্রীই দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা। এমনিতেই করোনার কারণে দরিদ্রের হার বেড়ে গেছে, অনেক শিক্ষার্থীর জন্যই অনলাইন শিক্ষা সুযোগের মূল্যকে অত্যন্ত বাড়িয়ে দেবে। আবার বিজ্ঞান, চিকিৎসা, প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন কোর্সের জন্য ল্যাব ও ব্যবহারিক ক্লাসের দরকার হয়, যা কীভাবে অনলাইনে সম্পন্ন করা হবে তাও ভাবার বিষয়। আরেকটি বিষয় হলো, ভার্চুয়াল পেডাগজির প্রশিক্ষণ বেশির ভাগ শিক্ষকেরই নেই। স্মার্ট ক্লাসরুমে অভ্যস্ত নন বেশির ভাগ শিক্ষক-শিক্ষার্থী। তাই হুট করেই অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালানো ঠিক হবে না। সবার আগে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম সচল রাখার জন্য বিশ্বের অন্য অনেক দেশের মতো যেসব শিক্ষার্থীর স্মার্টফোন বা অন্যান্য উপকরণ নেই ফেরত দেওয়ার শর্তে বা অন্য কোনো উপায়ে তা সরবরাহ করতে হবে। সেই সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ ও গতি নিশ্চয়তার পাশাপাশি মোবাইল ডাটার খরচ কমানো উচিত। তা ছাড়া শিক্ষকদের ভার্চুয়াল পেডাগজির প্রশিক্ষণসহ উপকরণাদিও সরবরাহ করা বাঞ্ছনীয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সব শিক্ষার্থী, অনুষদের কাস্টমাইজড ও সুসংগঠিত লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এসব ব্যবস্থা না করে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালালে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষার বৈষম্য তীব্র থেকে তীব্রতর হবে, যা কখনোই ভালো ফল বয়ে আনবে না।
লেখক : চেয়ারম্যান, বিশেষ শিক্ষা বিভাগ, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রভাষক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।