বৃহস্পতিবার, ২১ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

কভিডের টিকা আমরা নেব কি নেব না

তসলিমা নাসরিন

কভিডের টিকা আমরা নেব কি নেব না

যে করোনাভাইরাসে গত এক বছরে ২০ লাখের চেয়ে বেশি মানুষ মরে গেল, কোটি কোটি মানুষ আক্রান্ত হলো, সেই ভয়াবহ অতিমারী থেকে মানব জাতিকে বাঁচানোর জন্য বিজ্ঞানীরা দিনরাত গবেষণায় ডুবে থেকে প্রতিষেধক আবিষ্কার করেছেন, যে প্রতিষেধকের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছে গোটা মানব জাতি, আর এখন কিনা শুনছি সেই প্রতিষেধকই মানুষ গ্রহণ করতে চাইছে না। অন্তত ভারতে এই প্রবণতা দেখা দিচ্ছে। গণটিকাকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে সুপরিকল্পিতভাবে। কিন্তু মানুষ তো টিকা নিতে যাচ্ছে না অথবা গেলেও খুব কম যাচ্ছে।

অক্সফোর্ড আর জার্মানির বায়োএনটেকের কোভিশিল্ড প্রতিষেধক এবং ভারত বায়োটেকের তৈরি কোভ্যাকসিন প্রতিষেধক, এই দুই প্রতিষেধকই আছে সরকারের গণটিকাকরণ প্রকল্পে। সরকার জানিয়ে দিয়েছে, কেউ বলতে পারবে না, আমি এক্স টিকা নেব না, আমি ওয়াই টিকা নেব। যাকে যে টিকা দেওয়া হবে, তাকে সেই টিকাই নিতে হবে। টিকা না নিতে চাইলে টিকা নিও না। আর যদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ভোগো, সে দায়িত্ব তোমার, সরকারের নয়, যারা টিকা তৈরি করেছে তাদেরও নয়।

আদেশটি নিশ্চয়ই নির্দয়। আমেরিকায় টিকা নেওয়ার পর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে দায়িত্ব টিকা প্রস্তুতকারকেরা নেয়। ইউরোপেও তাই। কিন্তু ভারতে টিকা দেওয়ার পর যখন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিল, কারও কারও মৃত্যুও হলো, তখন টিকা নিতে মানুষের দ্বিধা হচ্ছে। খুব স্বাভাবিক যে মানুষ ভয় পাচ্ছে টিকা নিতে। টিকা তো মানুষকে বাঁচানোর কথা, কিন্তু টিকা কেন মানুষকে মারছে! রক্ষককে ভক্ষক হিসেবে দেখতে কেউ চায় না। যদিও সরকার থেকে বলা হচ্ছে, যারা মরেছে, তাদের মৃত্যুর সঙ্গে টিকার কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু আশংকা কাটছে না।

মানুষ দ্বিধায় ভুগছে। ভারত বায়োটেকের কোভ্যাকসিনের যেহেতু এখনও ট্রায়াল বা পরীক্ষা শেষ হয়নি, আর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ওই টিকাতেই বেশি হচ্ছে, তাই মানুষ টিকা নিলে কোভিশিল্ড নিতে চাইছে, কোভ্যাকসিন নয়। কিন্তু সরকার তো আবার দুটোর মধ্যে একটিকে পছন্দ করতে দেবে না। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার দায়িত্ব যদি নিতে বলো, তাহলে টিকা বাছাই করার স্বাধীনতাটা দাও, অনেকেই বলছে।

পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া প্রচুর হচ্ছে বলে ভারত এবার বায়োটেককে জানিয়ে দিয়েছে কারা কারা এই টিকা নিতে পারবে না। গর্ভবতীরা নয়, যারা শিশুদের স্তন্যপান করায় তারা নয়, যারা এমন কোনও ওষুধ খাচ্ছে-যার প্রভাব শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উপর পড়ছে, যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, যাদের অ্যালার্জির সমস্যা রয়েছে, তাদের কোভ্যাকসিন এড়িয়ে চলা উচিত। শুধু তাই নয়, জ্বর হলে, রক্তপাতের সমস্যা থাকলে, রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক রাখার ওষুধ খেলে অথবা অন্য কোনও গুরুতর শারীরিক সমস্যা থাকলেও কোভ্যাকসিন নেওয়া নিরাপদ নয়। এই সতর্কবাণী টিকাকরণের শুরুতেই জানিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। এই ভুলটি কি শুধু ভারত বায়োটেক করেছে, ফাইজারের মতো বিখ্যাত কোম্পানিও তো করেছে। ফাইজারের টিকা নিয়ে নরওয়ের ২৯ জন মানুষ মরে যাওয়ার পর ফাইজার ঘোষণা করেছে, মুমূর্ষু এবং অশীতিপর বৃদ্ধদের এই টিকা দেওয়া হবে না। এই ঘোষণাটি প্রথমেই দেওয়া হলে মুমূর্ষু ওই ২৯ জন টিকা নিতেন না, তাঁদের মরতেও হতো না। ভারত বায়োটেক এখন জানিয়েছে, টিকায় কারও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলে বা গুরুতর কোনও সমস্যা হলে তার চিকিৎসার দায়িত্ব তারা নেবে।

আমরা কভিডে বাঁচবো না, আবার কভিডের টিকাতেও বাঁচবো না, এ কেমন কথা। কেউ কেউ বলছে টিকাই নেওয়া উচিত, যেহেতু কভিডে যত লোক মরছে, তার চেয়ে কম লোক মরছে টিকায়। পিঠ দেওয়ালে ঠেকলেই মানুষ এমন কথা বলতে পারে।

ক্যালিফোর্নিয়ায় মডার্না টিকা দিতে গিয়ে ছয়জনের মধ্যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল। যে লটে ওই টিকা ছিল, তিন লাখ টিকার পুরো ওই লটটি ফেলে দেওয়া হয়েছে। এই পদক্ষেপটি বড় দরকারি পদক্ষেপ। এটি মানুষকে আস্থা জোগায়। এরকম পদক্ষেপ ভারত বায়োটেকেরও করা উচিত।

ভারতের সভ্য শিক্ষিত যে কোনও মানুষকেই জিজ্ঞেস করেছি, টিকা কবে নিচ্ছেন। সবাই বল্লো, আরও একটু দেখি। এর মানে হচ্ছে, তাঁরা আরও অপেক্ষা করতে চান। দেখতে চান টিকা আদৌ নিরাপদ কিনা। টিকায় কত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ভয়াবহতাই বা কেমন তা না জেনে হুটহাট কেউ টিকা নিতে চাইছেন না।

ওদিকে ভারতে কোভ্যাকসিনের ট্রায়াল সম্পূর্ণ হওয়ার আগে ছাড়পত্র পাওয়া নিয়ে সমালোচনা চলছেই। এই সমালোচনার মধ্যেও ভারত বায়োটেকের তৈরি কোভ্যাকসিন ব্যবহার করা হচ্ছে টিকাকরণে। কিন্তু ভারত যদি শুধু কোভিশিল্ড ব্যবহার করতো টিকাকরণে, আর কোভ্যাকসিনের ট্রায়াল শেষ হওয়ার পর ওটিকে টিকাকরণের প্রতিষেধক হিসেবে মেনে নিত, ভালো হতো। টিকা নিতে মানুষ এগিয়েও আসতো। মনে হচ্ছে বড় দেরি হয়ে গেছে।

যার যে টিকা পছন্দ, তা নেওয়ার স্বাধীনতা থাকা উচিত। একটিই যদি টিকা বানানো হতো, তাহলে পছন্দ করার কিছু থাকতো না। যেহেতু কয়েকটি আছে, কয়েকটির মধ্যে একটিকে বেছে তো নিতেই পারি। বিশ্বের ৭.৮ বিলিয়ন লোকের জন্য টিকা চাই। এ তো সোজা কথা নয়। টিকার অভাব থেকে থেকে দেখা দেবেই। এক বছরের মধ্যে দ্রুত টিকা বানানো হয়েছে। কিন্তু দ্রুত টিকা উৎপাদন, দ্রুত সবাইকে দেওয়ার কাজ চললেও সবাই পেতে পেতে ক’মাস লাগে কে জানে।

বিশ্বময় কোনও কিছু ঘটতে এই প্রথম দেখছি। অন্য কোনও গ্রহ থেকে কোনও দুষ্ট এলিয়েন এসে আমদের গ্রহের সবাইকে যদি গপাগপ খেতে শুরু করতো, তাহলে সেই এলিয়েনের হাত থেকে বাঁচার জন্য সারা বিশ্ব এক হয়ে যেভাবে কাজ করতো, মনে হয়েছে সেভাবেই এই প্যান্ডেমিকের সময় এক হয়ে বিশ্বের মানুষ কাজ করেছে। তারপরও মানুষ তো এই ভাইরাসকেও, এই রোগকেও, এর টিকাকেও রাজনীতির ঘোলা জলে গুলেছে। অনেকেই বড় গলায় বলছে, তারা মাস্ক পরবে না, তারা টিকা নেবে না। সরকারও বলে দিয়েছে, টিকা যদি না নিতে চায় কেউ, নেবে শতকরা ৮০ ভাগ লোক টিকা না নিলে অতিমারী ঠেকানো যাবে না। কিন্তু বিশ্বের ৮০ ভাগ লোক কি কভিডের টিকা নেবে? আমার সংশয় হচ্ছে। ৯৫% লোক হামের টিকা নেওয়ার পর হাম দূর হয়েছে। ৮০% লোক টিকা নেওয়ার পর পোলিওর বিরুদ্ধে হার্ড ইমিউনিটি গড়ে উঠেছে।

কেউ কেউ তো বলে গোটা ভাইরাসের খবরই নাকি ফেক নিউজ, টিকাও নাকি ফেক টিকা। জানি না ২০ লাখ মানুষের মৃত্যুকেও তারা ফেক মৃত্যু বলে কিনা। অবিজ্ঞানে বিশ্বাস যাদের, তারা তো মেতে ছিলই অকল্যাণে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানের ওপর গভীর বিশ্বাস নিয়ে বিরামহীন কাজ করেছেন বলেই আমরা ১০ বছরের জায়গায় ১ বছরেই টিকা পেয়েছি।

ভেবেছিলাম বিশ্বের সবার সামনে যখন প্রাণঘাতী ভাইরাস নেচে বেড়াচ্ছে, সবাই অসহায় হয়ে পড়ছে, তখন বোধহয় মানুষের জন্য মানুষের সহানুভূতি বাড়বে। আশ্চর্য, সহানুভূতি কিন্তু সব সময় বাড়েনি। কেউ কভিডে আক্রান্ত হয়েছে শোনার পর আত্মীয়স্বজন প্রতিবেশী বন্ধু সব দূরে সরে গেছে, শারীরিকভাবে তো দূরত্ব বজায় রাখতেই হয়, কিন্তু মানসিকভাবে দূরে সরে যাওয়াটা নিশ্চয়ই অমানবিক। শরীরের পাশে গিয়ে না দাঁড়ালেও তো নানাভাবে সহযোগিতার মাধ্যমে পাশে দাঁড়ানো যায়। মানুষ বাঁচুক অথবা না বাঁচুক, স্বজন বন্ধু তার পাশে আছে, এই অনুভব অনেকটাই যুদ্ধ করার শক্তি জোগায়।

অনেককে বলতে শুনি, এ রোগ কোনও রোগই নয়, কারণ মৃত্যুর হার খুবই কম। গত এক বছরে প্রতিদিন কভিডে মানুষ মারা যাচ্ছে, ২০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে, তারপরও নাকি এ রোগ কোনও রোগই নয়। যাদের কাছের কারও বা প্রিয় কারও মৃত্যু হয়নি কভিডে, তারা এর ভয়াবহতা আঁচ করতে আজও পারেনি। অচেনা কারও মৃত্যু কি মৃত্যু নয়?

যারা টিকা নিতে চাইছে না, তাদের মধ্যে অনেকেই বলছে, এত তাড়াহুড়ো করে যে টিকা বের হয়, সে টিকায় বিশ্বাস না করাই ভালো। এ টিকার জন্য লোকবল অর্থবল অন্য টিকার চেয়ে লক্ষগুণ বেশি ছিল বলেই এ টিকা তাড়াহুড়ো করে সম্ভব হয়েছে। সহস্র লোকের ওপর ট্রায়াল দেওয়া হয়েছে। নিরাপদ প্রমাণিত হওয়ার পরই তো টিকার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। স্পুটনিক ভি ট্রায়াল ছাড়াই বাজারে এসেছে। রাশিয়াতে নাকি ট্রায়াল দেওয়ার চল তেমন নেই। স্পুটনিক ভি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনও পায়নি। কিছু লোক দেখলাম, রাশিয়াকে ভালোবাসে বলে স্পুটনিক ভিকেও ভালোবাসে। জানিয়ে দিয়েছে, ট্রায়াল দেয়নি না দিক, যে দেশ মহাশূন্যে মানুষ পাঠিয়েছে সবার প্রথম, সে দেশের টিকাকে চোখ কান বুজে বিশ্বাস করা যায়, নিলে তারা স্পুটনিক টিকাই নেবে। কোথায় মহাকাশ কোথায় টিকা। তবে দুটোকে জুড়ে দেওয়ার ব্যাপারটি মজার। মহাকাশবিজ্ঞানে ভালো বলে চিকিৎসাবিজ্ঞানেও ভালো, এ আমাদের সরল মনের আস্থা। আস্থা আসলে এই দুঃসময়ে কোথাও না কোথাও রাখতে হয়। রাশিয়া তো নতুন আরেকটি টিকা নিয়ে আসছে, এপিভেককরোনা তার নাম। এটি আসছে ফেব্রুয়ারিতে। এটির নাকি কার্যকারিতা ১০০ ভাগ। দেখা যাক। ওয়েট এন্ড সি ছাড়া আমাদের মতো নিরীহ মানুষের আপাতত আর কিছু করার নেই।

কভিড থেকে বেঁচে এলেও অনেকের শরীর কিন্তু আগের মতো সুস্থ হচ্ছে না। শরীরের কোথাও না কোথাও সমস্যা হচ্ছে। পেশির দুর্বলতা তো কারও কারও কাটতেই চাইছে না। এই ভাইরাস বিশ্বে রয়েই যাবে। সবাই টিকা নেওয়ার পর এর কামড় হয়তো এতটা হিংস্র হবে না। তবে বছর বছর আমাদের এই ভাইরাস থেকে বাঁচতে টিকা নিতে হবে, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের জন্য যেমন নিতে হয়।

জীবন চলতে থাকবে। যতদিন বেঁচে থাকি, করোনাভাইরাস গোটা মানবজাতিকে গৃহবন্দি করেছিল, তা ভুলবো না। কী জানি, হলফ করে বলতে পারি না ভুলবো না। মানুষের তো আবার ভুলো মন। যখন আশায় বুক বাঁধি, তখন চারদিকে হতাশার উল্লাস দেখি। যখন হতাশায় ডুবে যাই, তখন দেখি ফুল ফুটছে, যখন অন্ধকারে তলিয়ে যেতে থাকি, দেখি কোথাও আলো হাসছে। ভারত তার প্রতিবেশী দেশগুলোতে কোভিশিল্ড প্রতিষেধক উপহার পাঠাচ্ছে। পাঠাচ্ছে বাংলাদেশ, বার্মা, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, শ্রীলংকা, আফগানিস্তান আর মরিশাসে। দুঃসময়ে ভারত প্রতিবেশী দেশগুলোয় করোনার ওষুধপত্র, মাস্ক, সেনিটাইজার ইত্যাদিও পাঠিয়েছিল। যদিও প্রতিবেশী দেশগুলো প্রতিষেধক কিনছে ভারতের কাছ থেকে, ভারত তার উদারতাও দেখিয়েছে। একটি বড় দেশ আশপাশের ছোট দেশগুলোকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখবে, বিপদ এলে পাশে দাঁড়াবে এটিই তো কাম্য। দেশে দেশে বন্ধুত্ব বাড়লে মানুষে মানুষে বন্ধুত্ব বাড়ে।

            লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

সর্বশেষ খবর