সোমবার, ২৪ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

একি হলো, পশু আজ মানুষেরই নাম

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

একি হলো, পশু আজ মানুষেরই নাম

সাহিত্যিক কালিকানন্দ অবধুতের কাহিনি অবলম্বনে, মরুতীর্থ হিংলাজ ছবির জন্য যে গানটি উপমহাদেশের কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গেয়েছিলেন, তারই একটি লাইন উপরে লিখিত রয়েছে। গানটি আক্ষেপের প্রতিধ্বনিত করেই গাওয়া হয়েছিল এটা ভেবে যে এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। আমাদের চিত্রজগতের অতি জনপ্রিয় এক তারকা চঞ্চল চৌধুরীর ধর্ম নিয়ে  কিছু নরদানব যেভাবে ধর্মীয় ঘৃণা জাগানোর চেষ্টা করছে, তা শুনে প্রথমেই মনে হলো বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন করেছিলেন সব ধর্মের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে, সবার ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিয়ে। কেন এবং কাদের দ্বারা এমন হলো, মানুষ নামীয় দানবরা এমন স্পর্ধা পেল তা আমাদের অজানা নয়। তবে এ গানের প্রখ্যাত গীতিকার গৌরি প্রসন্ন মজুমদার ভুল করে পশু শব্দ ব্যবহার করেছেন। তার উচিত ছিল দানব শব্দ ব্যবহার করা, কেননা বহু পশু বহু মানুষের চেয়েও অনেক বেশি মহৎ।

ছোটবেলায় উপমহাদেশের আরেক সংগীত কিংবদন্তি মোহাম্মদ রফির কণ্ঠে একটি গান শুনেছিলাম যার কথাগুলো হলো- ‘তু হিন্দু বনেগা, না মুসলমান বনেগা; ইনসান কি আওলাদ হ্যায় ইনসান বনেগা’ অর্থাৎ তুমি হিন্দু হবে না মুসলমান হবে সেটি কথা নয়, তুমি মানুষ হবে সেটিই কথা। গানটির আরেক লাইনে আছে- ‘মালিক নে হার ইনসানকো ইনসান বানায়ো, হামনে ওসে হিন্দু ইয়া মোসলমান বানায়া’, অর্থাৎ স্রষ্টা সবাইকে মানুষ করে বানিয়েছে, আর আমরা তাদের হিন্দু মুসলমান পরিচয়ে বিভক্ত করেছি। গানটি লিখেছেন শাহিদ লুধি-আনভী নামক এক বিখ্যাত মুসলিম গীতিকার। এ মন্ত্র উপমহাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ লালন করলেও ধ্বংসাত্মক অসুরের সংখ্যাও কম নয়। কিছু দিন আগে উভয় বাংলার জনপ্রিয় অভিনেতা দেব বলেছিলেন, ‘ধর্মের জয় হলে মানবতা ধ্বংস হবে আর মানবতা জিতলে ধর্মও রক্ষা পাবে।’ এত মূল্যবান দর্শন তত্ত্বের কথা একজন চলচ্চিত্র অভিনেতার দ্বারা উচ্চারিত হতে দেখে অনেকেই অবাক হয়েছেন, আর অতি সম্প্রতি পশ্চিম বাংলার বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী সুমন চট্টোপাধ্যায় ওরফে কবির সুমন, যিনি ‘প্রথমত আমি তোমাকেই চাই’ গানটি গেয়ে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছেছিলেন। তিনি কটি গান লিখে গেয়েছেন যার একটির প্রথম কটি লাইন হলো- ‘বাংলা ভাষাই দূর করে দেবে ধর্ম গেরুয়া বাজ’ আর এক গানে তিনি লিখেছেন- ‘রুখে দাও ধর্ম রাজনীতি এ দেশটাজুড়ে। লালনের কসম স্বদেশ যাচ্ছে পুড়ে।’

চঞ্চল চৌধুরীর ধর্ম পরিচয় পাওয়ার পরে ধর্মীয় উন্মাদরা যেভাবে তেড়ে উঠল, তাতে এ গানগুলো বিশেষভাবে মনে পড়ছে। মনে পড়েছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সেই বাণী যার মাধ্যমে তিনি বলেছিলেন- “লোকটি হিন্দু না মোসলমান সেটি আমার বিবেচ্য বিষয় নয়, সে মানুষ না অমানুষ সেটিই প্রশ্ন। সে যদি অমানুষ হয় তবে সে হিন্দু না মোসলমান তাতে আমার কিছু আসে যায় না।”

বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে ছাত্রলীগ সম্মেলনে বলেছিলেন, “সৃষ্টিকর্তা রাব্বুল আল আমিন, অর্থাৎ সকল মানুষের প্রভু। তিনি রাব্বুল মোসলেমিন নন, অর্থাৎ শুধু মোসলমানদের প্রভু নন।” বঙ্গবন্ধু আরও বলেছিলেন, ধর্মের পরিচয়ে কোনো মানুষকে ঘৃণা করা বস্তুত সৃষ্টিকর্তাকেই ঘৃণা করার শামিল। এর চেয়ে বড় সত্য আর কী হতে পারে? এক স্রষ্টাই তো সব ধর্মের মানুষ সৃষ্টি করেছেন। স্রষ্টা যাকে হিন্দু পিতা-মাতার ঘরে জন্ম দিয়েছেন তিনি হিন্দু হয়েছেন, যাকে বৌদ্ধ পিতা-মাতার ঘরে জন্ম দিয়েছেন তিনি বৌদ্ধ ধর্মাবম্বলী হয়েছেন, যাকে খ্রিস্ট পিতা-মাতার ঘরে জন্ম দিয়েছেন তিনি খ্রিস্টান হয়েছেন, জন্মের ব্যাপারে কোনো ব্যক্তির তো হাত নেই। এই অমোঘ সত্য যারা মানে না, তারা কোনো ধর্মেরই অনুসারী হতে পারে না। সৃষ্টিকর্তার একনিষ্ঠ কর্তৃত্বের বিশ্বাসীও হতে পারে না। তারা শুধু অমানুষ নয়, বিধর্মীয়ও বটে।

তাদের পঙ্কিল মনোজগতে কোনো পরিবর্তন আসবে সেটা এক দিবা স্বপ্ন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ যে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম থেকে কম অসাম্প্রদায়িক ছিলেন না তা তার রচনাবলি বিভিন্ন সময়ে তাঁর ভাষণ ইত্যাদি থেকে কৃষ্টাল পাথরের মতোই পরিষ্কার।

যে গানটি এখন ভারতের জাতীয় সংগীতে সেই ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে’...র দ্বিতীয় প্যারাতে কবিগুরু যা লিখেছেন তা হলো- “অহরহ তব আহ্বান প্রচারিত, শুনি তব উদার বাণী, হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মোসলমান খ্রিস্টানি, পূর্ব পশ্চিম আসে তব সিংহাসন পাশে, প্রেমহার হয় গাথা”।

ভারত তীর্থ কবিতায় তিনি লিখেছেন- ‘এসো হে আর্য, এসো অনার্য, হিন্দু-মুসলমান। এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ এসো খ্রিস্টান এসো ব্রাহ্মণ, শুচি করি মন ধরো হাত সবাকার।’ একই ভাবধারা নিয়ে কবি নজরুল লিখেছেন- ‘হিন্দু মোসলমান দুটি বৃন্তে দুটি ফুল’। তিনি কান্ডারি হুঁশিয়ার কবিতায় লিখেছেন- ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম, জিজ্ঞাসে কোন জন’, তিনি তার সবকটি পুত্রের নাম রেখেছেন বাংলা ভাষায় যথা কৃষ্ণ-কাজি, কাজি সব্যসাচি, কাজি অনুরুদ্ধ। তিনি ক্ষুদিরাম বসুর আরাধনায় লিখেছেন- ‘ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেলো যারা জীবনের জয়গান, আসি অলক্ষ্যে দাঁড়াবে তারা দিতে কোন বলিদান।’ লালন লিখেছেন- ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে, লালন বলে জাতের কি রং দেখলাম না এক নজরে।’ তিনি আরও লিখেছেন- ‘জাত গেলো জাত গেলো বলে একি কারখানা’। এই বঙ্গভূমিতেই মহাকবি চন্ডিদাস লিখেছিলেন- ‘শোনহে মানুষ, সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ কবি নজরুলও লিখেছিলেন- ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান’, এই ভূমিরই সন্তান রামকৃষ্ণ পরম হংসদেব, স্বামী বিবেকানন্দ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, নেতাজি সুভাষ চন্দ্রবসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, শ্রী চৈতন্য দেব, যারা ধর্মান্ধতার তিরস্কার করে মানবতার কথা শুনিয়েছেন, এ মাটিরই সন্তান শাহ আবদুল করিম যিনি লিখেছেন- ‘গ্রামের নওজোয়ান, হিন্দু মুসলমান, মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম, আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।’ এ মাটিতেই জন্মেছিলেন ভূপেন হাজারিকা যিনি গেয়েছেন- ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য।’ এ মাটির সন্তান শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির কথা বলেছেন তাঁর সাহিত্যকর্মের মধ্য দিয়ে। প্রশ্ন জাগে যে দেশে এত শত মানবতার মন্ত্রে দীক্ষিত মনীষীর জন্ম দিয়েছে, সে দেশে আজ কেন এত ধর্মান্ধ অসুরের বিচরণ? এর পেছনে এক শক্তিশালী চক্র নিশ্চয় কাজ করছে। যারা অকাতরে অর্থ বিলাচ্ছে সরলমনা ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যে ঘৃণার বাণী, সাম্প্রদায়িকতার বাণী প্রচারের জন্য। উদ্দেশ্য রাজনৈতিক। দেশকে আবার পাকিস্তান বানানোর। বেশ কিছু দিন কলকাতার এক জনপ্রিয় টেলিভিশন সাংবাদিক সুচন্দ্রিমার বাগ্যুদ্ধ শুনে আসছিলাম। ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে তার তীক্ষè ভাষায় আক্রমণ সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। তার তীর্যক আক্রমণে বহু ধর্মান্ধ চুপ হয়ে গেছে। আমাদের দেশেও এ ধরনের সোচ্চার সাংবাদিকসহ বহুজন রয়েছেন, যাদের সম্মিলিত উদ্যোগ চালিয়ে যেতে হবে ধর্মান্ধদের চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে।

বঙ্গভূমিতে যেভাবে ইসলাম প্রচার করা হয়েছিল, তার প্রেক্ষিতে এ ধরনের ধর্মান্ধতা থাকার কথা নয়। ইতিহাস বলছে ১৫ শতকে তুর্কি বংশীয় বঙ্গীয় সুলতানদের রাজত্বকালে বঙ্গভূমির হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা বিভিন্ন কারণে দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। এ প্রক্রিয়া বখতিয়ার খিলজির সময়ে শুরু হলেও বখতিয়ার খিলজির রাজত্বকাল ছিল স্বল্প স্থায়ী আর তাই ধর্মান্তরণ ঘটে মূলত খিলজি পরবর্তী বঙ্গীয় তুর্কি সুলতানদের আমলে। যারা ইসলাম ধর্ম প্রচার করে লাখ লাখ হিন্দু এবং বৌদ্ধকে ইসলাম গ্রহণ করিয়েছিলেন, তারা কিন্তু আরবের ওহাবি মুসলমান ছিলেন না। তারা ছিলেন মূলত তুর্কিস্তানি সুফি মতবাদের মুসলমান। যারা জঙ্গিবাদ বা ঘৃণার বাণী প্রচার করেননি, করেছিলেন মওলানা জালালউদ্দিন রুমি, ইবনে সিনা প্রমুখ সুফি সাধকের শান্তির বাণী। আর তাই যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তারা পরিণত হয়েছিলেন শান্তিবাদী মুসলমান হিসেবে। অনেকে যাদের মধ্যে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানও ছিলেন, বলে থাকেন শুধু নিম্নবর্ণের হিন্দুরাই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। ইতিহাস কিন্তু তা বলছে না। সে সময়ে বহু ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যও যে ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়েছিলেন তার ভূরি ভূরি নজির রয়েছে। যে ব্যক্তি পরবর্তীতে কালা পাহাড় নাম ধারণ করে মুসলমান হয়েছিলেন তিনি একজন ব্রাহ্মণ ছিলেন, যার নাম ছিল রাজিব লোচন রায়। এমনকি মুর্শিদ কুলিখান, যার নামে মুর্শিদাবাদের নামকরণ, তিনিও ব্রাহ্মণ ছিলেন। আজকের বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বাংলার বাঙালি মুসলমানরা মূলত সেই হিন্দু-বৌদ্ধদেরই বংশধর যারা ১৫/১৬ শতকে দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। এমনও হয়েছিল একই পরিবারে কেউ ইসলাম গ্রহণ করলেও বাকিরা হিন্দু-বৌদ্ধ রয়ে যান। যেহেতু তারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন শান্তিবাদী তুর্কি সুফিদের আহ্বানে তাই তারা যুগের পর যুগ শান্তিবাদী থেকে গেছেন, সম্প্রীতির সঙ্গে বাস করেছেন। যার কারণে ইংরেজের আগমন এবং ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতি প্রবর্তনের আগে এ দেশে হিন্দু মুসলমান, নজরুলের ভাষায় এক বৃন্তে দুটি ফুলের মতোই বাস করেছেন।

সুমন চট্টোপাধ্যায়ের আরেকটি নতুন গান এ প্রসঙ্গে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি গেয়েছেন, ‘আমি মুসলিম, আমি খ্রিস্টান, আমি নাস্তিক, তুই কেরে।’  আজ সময় এসেছে ওইসব ধর্মান্ধ অসুরদের সমূলে শেষ করে সম্প্রীতির অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার।

এটা অস্বীকার করার অবকাশ নেই যে, একশ্রেণির ওয়াজ ব্যবসায়ী কর্তৃক অন্য ধর্মের মানুষের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর কারণেই দেশে ধর্মান্ধতা এবং সাম্প্রদায়িকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই এটি রোধ করার  জন্য আইনের মাধ্যমেই এসব ওয়াজ ব্যবসায়ীর কণ্ঠ রোধ করতে হবে।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।

সর্বশেষ খবর