শনিবার, ১৯ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

মন্ত্রী যখন সরকারের বোঝা

সৈয়দ বোরহান কবীর

মন্ত্রী যখন সরকারের বোঝা

এ রকম চমৎকার অনুষ্ঠান আজকাল তেমন একটা হয় না। অনুষ্ঠানের আয়োজক কমিউনিটি ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ। কমিউনিটি ক্লিনিক ট্রাস্টের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী বললেন, অনুষ্ঠানে কিছু কথা বলতে হবে। বক্তৃৃতা করা আমার কাজ না। এ কাজে আমি খুবই অস্বস্তি বোধ করি। তারপরও মোদাচ্ছের স্যারের অনুরোধে অনুষ্ঠানে গেলাম। মাত্র কয়েকজন আলোচক।  আলোচনার বিষয়বস্তু ব্যতিক্রমী। ‘কমিউনিটি ক্লিনিক : জাতির পিতার স্বপ্ন, রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার সাফল্য’ শিরোনামে আলোচনা। চমৎকার মূল প্রবন্ধ পাঠ করলেন কবি শাহানা পারভীন। অনুষ্ঠানের আলোচক প্রায় সবাই স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন এবং আরও দুই-চারজন। সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী নিজেই সভাপতি এবং সঞ্চালক। অনুষ্ঠানটি ছিল প্রাণবন্ত। সভাপতির প্রস্তাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শেখ হাসিনা কমিউনিটি ক্লিনিক চেয়ার’ চালুর ঘোষণা দিলেন। অনুষ্ঠানে মন্ত্রী নেই। আয়োজকদের জিজ্ঞাসা করলাম, স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে দাওয়াত দেওয়া হয়নি? আয়োজকদের একজন বললেন, প্রথমে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে প্রধান অতিথি করা হয়েছিল। তাঁকে আমন্ত্রণও জানানো হয়। কিন্তু পরবর্তীতে ট্রাস্টের চেয়ারম্যান সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। এ রকম একটি গোলটেবিলে প্রধান অতিথির প্রয়োজন নেই, তাই তাঁরা অনুষ্ঠান বিন্যাস পরিবর্তন করেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে বাদ দেন। এর কারণ জানতে চাইলাম। একজন বললেন, মন্ত্রী এলেই করোনা, টিকা এসব নিয়ে কথা বলবেন। সাংবাদিকরা এসব বিষয় লুফে নেন। ফলে অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে। কমিউনিটি ক্লিনিক সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তা আড়ালেই থেকে যাবে। আমরা অনুষ্ঠানটি বিতর্কহীন, একাডেমিক করতে চেয়েছিলাম। মানে কী? স্বাস্থ্যমন্ত্রী তাহলে একটি ভালো অনুষ্ঠানের অন্তরায়? তিনি এখন জাতির দায়? আমার এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হলো না। বার্ধক্যজনিত কারণে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মা ইন্তেকাল করেছেন। তাঁর স্মৃতির উদ্দেশে শোক ও স্মরণসভা। সেই অনুষ্ঠানেও দেখি স্বাস্থ্যমন্ত্রী করোনা এবং টিকা নিয়ে কথা বললেন। বললেন, ‘ক্যামেরা নিয়ে হাসপাতাল দেখালেই করোনা যাবে না।’ এটা দেখার পর কমিউনিটি ক্লিনিকের আয়োজকদের বিচক্ষণতায় আমি মুগ্ধ। স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে নিয়ে আমার এখন আর কিছু লিখতে ভালো লাগে না। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ব্যাপারে পুরো জাতিই হাল ছেড়ে দিয়েছে। জাতীয় সংসদে তাঁকে তুলাধোনা করা হলো। তিনি নির্বিকার। গণমাধ্যমে প্রতিদিন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি, অনিয়ম, অদক্ষতা নিয়ে লেখা হয়। মন্ত্রী ভ্রুক্ষেপহীন। টিআইবি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি নিয়ে গবেষণা করে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, বানোয়াট। আজকাল চায়ের আড্ডায়, রাজনৈতিক দলের অফিসে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর খুঁটির জোর নিয়ে আলোচনা হয়। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা প্রকাশ্যে তাঁর সমালোচনা করতে করতে ক্লান্ত। কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী এসব পাত্তা দেন না। তিনি সবকিছুর ঊর্ধ্বে। কদিন আগে প্রধানমন্ত্রী এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, করোনা মোকাবিলায় জনসচেতনতা বাড়াতে হবে’। মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানা, মাস্ক পরা নিয়ে সচেতন করতে হবে। এ নিয়ে প্রচার-প্রচারণা বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদফতরে জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং প্রচার-প্রচারণার জন্য একটি বিশেষ বিভাগ আছে। স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরো নামে এই বিভাগটির কাজ হলো; স্বাস্থ্য সচেতনতা বিষয়ে প্রচার-প্রচারণা করা। এই খাতে বেশ টাকাও বরাদ্দ থাকে। বাংলাদেশে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি হলো স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরো। এই প্রতিষ্ঠানে একজন লাইন ডিরেক্টর হয়েছেন মন্ত্রীর পছন্দে। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে মামলা আছে। তিনি প্রচারণা না করেই টাকা ভাগ-বাটোয়ারা করেছেন বলে গণমাধ্যমে একাধিক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে সরকারের আরেকটি প্রতিষ্ঠান। বর্তমান সরকার, দেশের মানুষের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে ২০১৫ সালে ‘নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ’ নামে একটি স্বতন্ত্র, শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান গঠন করে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের একক কর্তৃত্ব এখন খাদ্যের গুণগত মান তদারকি করা। এ সংক্রান্ত জনসচেতনতা তৈরি করা। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ খাদ্যের মান নিয়ে নানা প্রচার-প্রচারণা করে থাকে। এসব প্রচার-প্রচারণার মূল লক্ষ্য হলো, কোনো ভুল তথ্য যেন না যায়। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের নীতি অনুযায়ী খাবারের মান এবং ঝুঁকি নিয়ে বক্তব্য দেবেন কেবল চিকিৎসক, পুষ্টিবিদ বা উপযুক্ত ব্যক্তি। এখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একটি বিজ্ঞাপন প্রচার হচ্ছে। যাতে দেখা যাচ্ছে, স্বামী-স্ত্রী রিকশায় করে যাচ্ছেন। স্ত্রীর ফাস্টফুড খেতে ইচ্ছা হলো। স্বামী বলছেন এসব খাবার খেলে কলেরা, ক্যান্সার নানা রোগ হয়। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ অভিযোগ করেছে, এই বিজ্ঞাপন অবৈজ্ঞানিক। নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে রুখবে কে? তাদের অযোগ্যতা, ব্যর্থতা নিয়ে কথা তো কম হলো না। অর্থমন্ত্রী বললেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, প্রধানমন্ত্রী চাইলেন করোনা নিয়ে প্রচারণা, স্বাস্থ্যমন্ত্রী করছেন ফাস্টফুডের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। কী চমৎকার। দেখতে দেখতে গত আড়াই বছর স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং তাঁর মন্ত্রণালয় জাতির জন্য এক বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এই বোঝা বইতে গিয়ে সরকারই যেন ন্যুব্জ হয়ে পড়েছে। এ সরকারের এ রকম কয়েকজন মন্ত্রী আবিষ্কৃত হয়েছেন, যাদের একমাত্র কাজ সরকারকে বিব্রত করা। সরকারের ভালো কাজগুলো আড়াল করা। গত ১৭ মার্চ ছিল জাতির পিতার ১০১তম জন্মবার্ষিকী অনলাইনে। এ দিনটি শিশু-কিশোর দিবস হিসেবে পালিত হয়। করোনা মহামারীতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ প্রায় দেড় বছর। তাই ওই অনুষ্ঠানের বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শিশু-কিশোরকে আশ্বাস দিলেন, উজ্জীবিত করলেন। তাদের দুঃখ এবং উৎকণ্ঠার সঙ্গে একাত্ম হলেন। তাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিলেন। মনে হলো মমতাময়ী মা সন্তানকে স্বাভাবিক রাখার এক অকৃত্রিম ভালোবাসার প্রকাশ। আর সেদিন দেখলাম শিক্ষামন্ত্রীর কথার ঝঙ্কার। এক বছর শিক্ষাজীবন ব্যাহত হলে নাকি তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। কী আশ্চর্য কথা! শিক্ষামন্ত্রী গত দেড় বছরে মূলধারার শিক্ষাজীবন চালু করতে কী করেছেন? সেদিন একজন শিক্ষক বলছিলেন, সপ্তাহে এক দিন একটি শ্রেণিকক্ষে ১০ জন করে শিক্ষার্থীকে এনে শিক্ষাদান করা যেতে পারে। এসব শিক্ষকের পরামর্শ শোনার মতো সময় আমাদের শিক্ষামন্ত্রীর আছে কি? শিক্ষামন্ত্রী একাই দেশের শিক্ষার্থীকে এবং তাদের অভিভাবকদের সরকারের প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলছেন। গত সপ্তাহের লেখায় পরিকল্পনামন্ত্রীর দায়িত্বহীন মন্তব্য নিয়ে লিখেছিলাম। এই লেখার পর প্রধানমন্ত্রীর সাবেক প্রটোকল অফিসার এবং আওয়ামী লীগ নেতা আলাউদ্দিন নাসিম আমাকে একটি খুদে বার্তা পাঠান। আমার লেখার একটি ভুল তথ্য শুধরে দেওয়ার জন্যই এ খুদে বার্তা। পাঠকদের জন্য খুদে বার্তাটি তুলে ধরছি- “মান্নান সাহেব ১৯৭৩ সালের বিসিএসে যোগ দেননি। তিনি ছিলেন সিএসপি ১৯৭১ এর ব্যাচ। সারা দেশ যখন যুদ্ধে তখন এই সিএসপি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং পাস করেন। জয়েন করতে পারেননি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু সরকার এই পরীক্ষাকে মেনে নেননি। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর ১৯৭৭ সালে তাদের সিনিয়রিটি দিয়ে ক্যাডারে যোগদান করিয়েছিলেন। এ ব্যাচে প্রশাসন ক্যাডার চারজন ছিলেন এম এ মান্নান, আহমেদ মাহমুদুর রাজা চৌধুরী, আনিসুল হক এবং শফিকুল ইসলাম। আর বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবদুল মোমেন পেয়েছিলেন সচিবালয় ক্যাডার। তিনিও ১৯৭৭ সালে একইভাবে জয়েন করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পরীক্ষা দিয়েছিলেন বলে প্রশাসনে ওনাদের ‘রাজাকার ব্যাচ’ বা রাজাকার সিএসপি বলে কৌতুক করা হতো।” তাহলে, বর্তমান মন্ত্রিসভায় দুজন রাজাকার ব্যাচের মন্ত্রীও আছেন। এরা কাজ না করে সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলবেন- এটাই তো স্বাভাবিক। মাঝে মাঝেই বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন ওঠে, মন্ত্রীদের কাজ কী? সংসদে দেখলাম কয়েকজন সংসদ সদস্য বলার চেষ্টা করছেন মন্ত্রীদের ক্ষমতা নেই, সব ক্ষমতা আমলাদের হাতে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বলে, ‘ক্ষমতা কেউ কাউকে দেয় না, ক্ষমতা অর্জন করতে হয়।’ মন্ত্রী যদি যোগ্য হন, তাহলে কখনো আমলারা ছড়ি ঘোরাতে পারে না। আর মন্ত্রী যদি তাঁর কাজটা না জানেন, তাঁর যদি অন্য কোনো মতলব থাকে, মন্ত্রীর গদিতে বসে আড়াই শ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ শোধ করার তাগিদ থাকে, তাহলে তিনি প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায় বাস্তবায়ন করতে পারবেন না। একজন মন্ত্রী যদি মনে করেন, মন্ত্রিত্বটা কেবল একটা চাকরি কিংবা পুরস্কার তাহলে তিনি কিছুই করতে পারবেন না। তিনি যদি মনে করেন, এটা দেশসেবার দায়িত্ব তাহলে তিনি অনেক কিছুই করতে পারেন। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি একজন আদর্শ রাজনীতিবিদের উদাহরণ। আশির দশকে তাঁকে বলা হতো বিশে^র সেরা অর্থমন্ত্রী। অথচ তিনি অর্থশাস্ত্রে পড়াশোনাই করেননি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং ইতিহাসে মাস্টার্স করেছিলেন। ১৯৮২ সালে প্রয়াত শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়ে চমক দেখিয়েছিলেন, ভারতের অর্থনীতির নবযাত্রার সূচনা হয়েছিল তাঁর হাত ধরেই। বাংলাদেশেও এ রকম অনেক উদাহরণ আছে। মন্ত্রী হয়ে যারা অনবদ্য অবদান রেখেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারা জীবনই রাজনীতির পক্ষে, গণতন্ত্রের পক্ষে। রাষ্ট্র পরিচালনায় রাজনীতিকে চালকের আসনে বসাতে তিনিই সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন। ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী হয়েই তিনি ‘রুলস অব বিজনেস’ পরিবর্তন করেন। সচিবদের বদলে মন্ত্রীদের দেন মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব। এই পরিবর্তনের ফলে, মন্ত্রীরা এখন মন্ত্রণালয়ের মূল ব্যক্তি। মূল ব্যক্তি হিসেবে অনেক মন্ত্রী দেশকে এগিয়ে নিতে গিয়ে তাঁদের মেধা ও মনন উজাড় করে দিয়েছেন। বেশি উদাহরণ দরকার নেই। এক সময় প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব, কৃষিবিদ ড. আওলাদ হোসেনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল কদিন আগে। ড. আওলাদ বলছিলেন, মতিয়া আপা কৃষি মন্ত্রণালয়ে যে শৃঙ্খলা এবং উন্নতি করেছেন, তাতে ওই মন্ত্রণালয়ে নতুন মন্ত্রীকে কিছুই করতে হবে না, শুধু রুটিনওয়ার্ক করলেই হবে।’ বেগম মতিয়া চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাটা ধারণ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা প্রতিপালন করেছেন, মন্ত্রণালয় দুর্নীতিমুক্ত রেখেছেন। নেতা হিসেবে একটা চমৎকার টিমওয়ার্ক তৈরি করেছিলেন কৃষি মন্ত্রণালয়ে। তাঁর হাত ধরেই বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। তোফায়েল আহমেদ দুই মেয়াদে বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন। তিনি ব্যবসায়ীদের প্রতিপক্ষ বানাননি, তাদের ধমক দিয়ে বলেননি, সিন্ডিকেট করা যাবে না, দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ানো যাবে না। তোফায়েল আহমেদ অভিভাবকের মতো দায়িত্ব পালন করেছেন। সব পক্ষকে আস্থায় নিয়েছেন। তাঁর দুই দফা মন্ত্রিত্বে চিনি কেলেঙ্কারি হয়নি। লবণ কেলেঙ্কারি হয়নি। পিঁয়াজের দাম লাগামহীন হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা, রোজায় তিনি পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে বিস্ময়কর সফল মন্ত্রী। এই মেয়াদেও আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক মন্ত্রী ভালো কাজ করছেন। প্রধানমন্ত্রীর আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে তাঁরা কঠোর পরিশ্রম করছেন। বাংলাদেশ যে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে, তার পেছনে কিছু মন্ত্রীরও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। দুই-একটা উদাহরণ দিতে চাই। গত বছর যখন করোনা মহামারী শুরু হলো, তখন শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্ব ছিল অপ্রস্তুত। কী করতে হবে না হবে আমরা জানতাম না। নানা ভয়, কুসংস্কার, গুজব ছিল চারপাশে। এর মধ্যে গুজব ছড়িয়ে পড়ল, ডিম ও দুধ খেলে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে। ব্যস, মানুষ ডিম-দুধ খাওয়া বন্ধ করে দিল। ভয়ংকর অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ল খামারিরা। খামারিরা রাস্তায় দুধ ঢেলে দিচ্ছেন এমন সংবাদও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলো। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম এ সংকট উত্তরণে উদ্ভাবনী, দায়িত্বশীল এবং চমৎকার কয়েকটি পদক্ষেপ নিলেন। তখন কঠোর লকডাউন। এর মধ্যে ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ আর পুষ্টিবিদ তামান্না চৌধুরীকে দিয়ে ডিম, দুধের উপকারিতা এবং ডিম-দুধ খেলে করোনা হয় না এ রকম বার্তা রেকর্ড করালেন। বিভিন্ন টেলিভিশনে এবং পত্রিকায় এটা প্রচার করার ব্যবস্থা করলেন। মন্ত্রণালয় খামারিদের কাছ থেকে ডিম-দুধ কিনে ভ্রাম্যমাণ দোকানের মাধ্যমে তা বিক্রির উদ্যোগ নিল। খামারিদের জন্য নগদ অর্থ সহায়তার ব্যবস্থা করল। করোনায়ও আমাদের যে পুষ্টি ও প্রাণিজ আমিষের অভাব হয়নি, (যেখানে ইউরোপ, আমেরিকায়ও প্রাণিজ আমিষের সংকট হয়েছিল) তা শ ম রেজাউল করিমের অবদান। প্রধানমন্ত্রী তাঁকে পরামর্শ দিয়েছেন, নির্দেশনা দিয়েছেন। এটি বাস্তবায়নে তিনি আমলাদের ওপর নির্ভর করেননি, নিজ উদ্যোগে করেছেন।

ড. আবদুর রাজ্জাক কৃষিমন্ত্রী। করোনার প্রথম ধাক্কায় বোরো ধান কাটা নিয়ে চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ল সরকার। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে ড. রাজ্জাক ধান কাটার জন্য জাতীয় উদ্যোগ নিলেন। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী- সবাইকে জাগ্রত করলেন। ধান কাটায় এক জাগরণ তৈরি হলো। যতদূর জানি, তৎকালীন সচিব এ রকম উদ্যোগে সায় দেননি। কিন্তু কৃষিমন্ত্রী তাঁর নেতৃত্বগুণে একটি অসাধারণ জাগরণের পরিবেশ গড়ে তুলেছিলেন দেশে। তরুণ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। করোনায় দেখিয়ে দিলেন ডিজিটাল বাংলাদেশের বাস্তবতা।

এক সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মানেই ছিল বিতর্ক। ‘আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে’। ‘উই আর লুকিং ফর শত্রুজ’। ‘২৪ ঘণ্টার মধ্যে সাগর-রুনির হত্যাকারী গ্রেফতার হবে’ কিংবা ‘বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা পিলার ধরে ধাক্কাধাক্কি করেছে এ জন্যই রানা প্লাজা ধসে গেছে’।- এমন সব চিরঞ্জীব কৌতুকময় উক্তি হলো বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর। এক্ষেত্রে আশ্চর্য ব্যতিক্রম বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। টানা দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পালন করছেন বিতর্কহীনভাবে। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতির অভিযোগ নেই। এ করম অনেকেই আছেন, যারা প্রধানমন্ত্রীর আস্থার প্রতিদান দিচ্ছেন। দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাজ করছেন। এ জন্যই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। করোনার মধ্যেও মাথা উঁচু করে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। কিন্তু সব অর্জন ম্লান হয়ে যায় কিছু মন্ত্রীর দায়িত্বহীন মন্তব্য এবং কাজে। কেউ কেউ বলবেন, হাতের পাঁচ আঙুল তো সমান হয় না। মন্ত্রিসভা ভালো-মন্দ মিলিয়েই। সবাই তো আর সমান দক্ষ হয় না। কিন্তু এ রকম চিন্তার সঙ্গে আমি মোটেও একমত হতে পারি না। এক গ্লাস দুধ নষ্ট করতে এক ফোঁটা চুনই যথেষ্ট। একটি ঝকঝকে সফেদ শার্ট পরার অযোগ্য হয়ে পড়ে, একটি কালির দাগে। তেমনি, একজন বা গুটিকয় মন্ত্রী সরকারকে ডোবাতে পারেন। জনগণকে খেপিয়ে তুলতে একটি অপকর্মই যথেষ্ট। বিতর্কিত, অযোগ্য, দুর্নীতিবাজ একজন মন্ত্রীও রাষ্ট্র, দেশ এবং জনগণের জন্য বিপজ্জনক।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সাল থেকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে মন্ত্রিত্ব দিচ্ছেন। একজন রাজনৈতিক নেতা বা কর্মীর জন্য মন্ত্রিত্ব একটা বিরাট সুযোগ। এই সুযোগ যারা কাজে লাগাতে পারেন না, এটা তাঁদের ব্যর্থতা। কিন্তু তাঁদের ব্যর্থতার মূল্য দিতে হয় প্রধানমন্ত্রীকে, এ দেশের জনগণকে। মন্ত্রী যখন সরকারের বোঝা হন, আপদে পরিণত হন তখন সেই আপদ দ্রুত বিদায় করাই উত্তম। আমরা এমন মন্ত্রী চাই না, একটি সুন্দর অনুষ্ঠান সফল করতে যাকে প্রধান অতিথি করতে আয়োজকরা বিব্রত হন।  আমরা এমন মন্ত্রী চাই, যাকে প্রধান অতিথি না করলে অনুষ্ঠানই অপূর্ণ থেকে যায়।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর