শনিবার, ২৬ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

ত্যাগের রাজনীতি বনাম লুটের রাজনীতি

সৈয়দ বোরহান কবীর

ত্যাগের রাজনীতি বনাম লুটের রাজনীতি

২৩ জুন ছিল আওয়ামী লীগের ৭২ -তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। বাংলাদেশের প্রাচীনতম দলটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দুই দিন আগে এক অসাধারণ কাজ করলেন দলটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং জনপ্রিয় নেতা তোফায়েল আহমেদ। বঙ্গবন্ধুর শিষ্য এই প্রবীণ রাজনীতিবিদ তাঁর সব সম্পত্তি ‘তোফায়েল আহমেদ ফাউন্ডেশন’-এ দান করার ঘোষণা দেন। এ ফাউন্ডেশনটি আর্তমানবতার সেবায় কাজ করছে। এ ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে হাসপাতাল, বৃদ্ধাশ্রম, শিক্ষাবৃত্তিসহ নানা মানবিক কার্যক্রম। তোফায়েল আহমেদের এই ত্যাগ নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগের জন্মদিনে একটি বড় প্রাপ্তি। এ ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ল ১৯৯৪ সালের কথা। ’৯৪-এর ১৪ আগস্ট বাংলাদেশের ’৭৫-পরবর্তী রাজনীতিতে এক উজ্জ্বল দিন। ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় শোকের দিন। জাতীয় শোক দিবস। জাতীয় শোক দিবসের আগের দিন জাতির পিতার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ত্যাগের এক অসাধারণ নজির স্থাপন করেছিলেন। ৩২ নম্বরে ‘বঙ্গবন্ধু ভবন’ তাঁরা বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের জন্য ‘বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’-এ দান করেন। পিতা-মাতা, ভাই এবং নিকটাত্মীয় হারানো বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা সেদিন প্রমাণ করেছিলেন পার্থিব সম্পদের প্রতি তাঁদের কোনো লোভ নেই। তাঁরা শুধু দিতেই জানেন। যা জাতির পিতা তাঁদের শিখিয়েছেন। জাতির পিতার রাজনীতির পুরোটাই ছিল ত্যাগের। এ দেশ, এ দেশের মানুষের জন্য তিনি দিনের পর দিন কারাগারে কাটিয়েছেন। জীবন দিয়েছেন এই পবিত্র জন্মভূমির জন্য। জাতির পিতা বিশ্বাস করতেন রাজনীতি মানেই হলো ত্যাগ। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘যে কোনো মহৎ কাজ করতে হলে ত্যাগ ও সাধনার প্রয়োজন আছে। যারা ত্যাগ করতে প্রস্তুত নয় তারা জীবনে কোনো ভালো কাজ করতে পারে নাই- এ বিশ্বাস আমার ছিল। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, এদেশে রাজনীতি করতে হলে ত্যাগের প্রয়োজন আছে...।’ পৃষ্ঠা ১২৮। বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতির মূল ভিত্তিই হলো মানুষের জন্য ত্যাগ, দেশের জন্য নিজেকে উজাড় করে দেওয়া। বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই হেঁটেছেন শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা। বঙ্গবন্ধুর প্রিয় রাজনৈতিক কর্মী তোফায়েল আহমেদও একই নজির স্থাপন করলেন। কিন্তু তোফায়েল আহমেদের সবকিছু দান করে দেওয়ার পর নিজের মনেই প্রশ্ন এলো বঙ্গবন্ধু এবং শেখ হাসিনার দেখানো পথেই কি হাঁটছে আওয়ামী লীগ? ত্যাগের রাজনীতি কি ৭৩-এ পা দেওয়া দলটির অন্যতম শক্তি? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে হোঁচট খেলাম। কদিন আগে আওয়ামী লীগে পদবাণিজ্য নিয়ে তোলপাড় হলো। আওয়ামী লীগের এ প্রজন্মের অন্যতম জনপ্রিয় নেতা মির্জা আজম। দলটির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক। ঢাকা মহানগরী (দক্ষিণের) এক সভায় পদবাণিজ্য নিয়ে হাটে হাঁড়ি ভাঙলেন। কর্মঠ, কর্মীবান্ধব এই নেতা খোলাখুলিভাবে বললেন ‘কিছু দুর্নীতিবাজ নেতা টাকা খেয়ে পদ বিক্রি করেন। তাদের কারণেই আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারীরা ঢুকে পড়ে।’ বিপুল করতালির মধ্যে মির্জা আজমের এ বক্তব্য গ্রহণ করলেন দলের কর্মীরা। মুহুর্তেই ওই কর্মিসভার অবয়ব পাল্টে গেল। পদবাণিজ্য, কমিটি-বাণিজ্য নিয়ে সোচ্চার হলেন সবাই। আওয়ামী লীগের নেতারাই খোলামেলাভাবে দলের অর্থলোভী, সুবিধাবাদী দুর্বৃত্তদের নিয়ে কথা বলেন। মির্জা আজম যেন কর্মীদের ক্ষোভ এবং আবেগের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলেন। শুধু মির্জা আজম কেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে সত্যিকারে বিশ্বাসী দলের প্রত্যেক নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগের লুটেরাদের নিয়ে উদ্বিগ্ন। এক কঠিন দুঃসময়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিলেন তারানা হালিম। প্রচন্ড মেধাবী শিক্ষার্থী, শিশুকালেই সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তাঁর প্রতিভার দ্যুতি ছড়িয়েছিলেন। ২২ জুন এক ওয়েবিনারে তারানার কথা শুনছিলাম। তিনি বলছিলেন, ‘সততা রাজনীতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’ আমার লেখা পড়ে তারানা হালিম মাঝেমধ্যে আমাকে খুদে বার্তা পাঠান। এ লেখার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করে তারানার একটি খুদে বার্তা পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করছি- ‘তৈলমর্দন করতে করতে বেশির ভাগ দলের মানুষ অন্ধ। আসলেই রাজনীতি এখন ব্যবসায়ীদের দখলে। ১৯৯১ সালে যুবলীগের মহিলা সম্পাদক ছিলাম। আমাদের সঙ্গে যাদের কখনো দেখিনি- জনতার মঞ্চে, মইন উদ্দিন-ফখরুদ্দীন বিরোধী আন্দোলনে, নেত্রীর মুক্তি আন্দোলনে বা থামাও সহিংসতার আন্দোলনে তারাই আজ রাজনীতি করে সংসদে বসে। দল ও আপার বিপদের সময় আমরা দেশে থাকি আর নব্য আওয়ামী লীগাররা সবার আগে নির্বাচনের সময় ভিসা পাসপোর্ট লাগিয়ে তৈরি হয়ে থাকে।’ আওয়ামী লীগে ব্যবসায়ী এবং অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে তারানার মতো অনেকেই উদ্বিগ্ন। রাজনীতি যেন এখন দেশের সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। দুই ভাবে এ ব্যবসা চলে। আপনি কিছু টাকা বিনিয়োগ করে ক্ষমতাসীন দলে ঢুকে পড়লেন। আপনি আগে জামায়াত করেছেন কিংবা বিএনপি- কোনো সমস্যা নেই। টাকা ঢালতে পারলেই হলো। আপনি ধর্ষণ মামলার আসামি ছিলেন, মানব পাচারকারী, ব্যাংক লুটেরা কিংবা শেয়ারবাজার কারসাজি করে অঢেল সম্পদ বানালেন, এখন কিছু খরচ করে ঢুকে পড়লেই হলো। এরপর আপনি মনোনয়ন কিনবেন, এমপি হবেন, কপালে থাকলে মন্ত্রীও হয়ে যেতে পারেন। খুলে যাবে রত্নভান্ডার। আপনি যদি মন্ত্রী-এমপি না-ও হন তা হলেও সমস্যা নেই। একটা পদ পেলেই হলো। আপনি পেয়ে যাবেন টাকা বানানোর মেশিন কিংবা আলাদিনের চেরাগ। একটা ওয়ার্ড কমিটির নেতা হলেও আপনি বিপুল বিত্তের মালিক হতে পারেন। উদাহরণ তো হাতের কাছেই আছে। ক্ষমতাসীন দলের ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা ছিলেন দুই ভাই এনামুল হক ওরফে রেনু এবং রুপন ভূঁইয়া। তাদের বাড়িতে এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে নগদ প্রায় ৩২ কোটি টাকা, ৯ কেজি সোনা ও ৫ কোটি ১৫ লাখ টাকার এফডিআর পাওয়া যায়। সিআইডির তদন্তে দুই ভাইয়ের নামে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে মোট ১২৮টি ফ্ল্যাট, ৬৬ কাঠা জমি এবং ব্যাংকে ১৯ কোটি ১১ লাখ টাকা থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। ফরিদপুরে অনুপ্রবেশকারী দুই আওয়ামী লীগ নেতা তো সবাইকে চমকে দিয়েছেন। ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ে তাদের নয়টি ব্যাংকে ১৮৮টি অ্যাকাউন্ট থেকে ২ হাজার ৯১০ কোটি ৭১ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে। এদের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার মামলা চলছে। এ রকম অনেক নাম আছে। মাঝেমধ্যে এ অর্থ পাচারকারীদের নিয়ে শোরগোল হয়। তারপর নতুন ইস্যুর স্রোতে এসব ইস্যু হারিয়ে যায়। সম্প্রতি সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিরা ৫ হাজার ২৯১ কোটি টাকা রেখেছেন। এসব তো দেশের টাকা। কানাডায় বাড়ি নিয়ে অনেক কথা হলো। কানাডায় রাজনীতিবিদদের সম্পদ বেশি না আমলাদের- এ রকম চানাচুর কুৎসিত বিতর্কে দুর্বৃত্তরা আড়ালে থেকে যাচ্ছে। এখন কোন মন্ত্রণালয়ে বেশি চুরি হয় তা নিয়েও চলছে বিতর্ক। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ১২ জুন এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে দাবি করেছেন অন্য মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতি হয় এবং কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়। দুর্নীতি, অর্থ পাচার, ব্যাংক লুট এসব যেন এখন কোনো অপরাধ নয়। নিয়োগ-বাণিজ্য, ভর্তিবাণিজ্য নিয়ে কথা বলতে বলতে এখন মানুষ যেন একে নিয়তি হিসেবেই মেনে নিয়েছে। খুব কম চাকরিপ্রত্যাশী বিশ্বাস করেন যোগ্যতায় চাকরি হয়। চাকরির জন্য ঘুষ না দিলে একজন চাকরিপ্রার্থী বিশ্বাসই করেন না যে তার চাকরি হবে। দুই-আড়াই বছর ধরে রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের আধিপত্য নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। স্বয়ং রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত এ নিয়ে তাঁর উষ্মার কথা জানিয়েছেন। আমি এ বিষয়ে একটু ভিন্নমত পোষণ করি। একজন ভালো ব্যবসায়ী, জনকল্যাণের আকাক্সক্ষা থেকে রাজনীতিতে আসতেই পারেন। এর মধ্যে দোষের কিছু দেখি না। কিন্তু এখন ব্যবসায়ী নয়, রাজনীতিতে লুটেরা ঢুকে পড়ছে। রাজনীতির নামে দেশে লুটতন্ত্র কায়েমের এক নীরব চেষ্টা ক্রমে দৃশ্যমান হচ্ছে। রাজনীতি যেন হয়ে উঠছে লুটপাটের সিঁড়ি। যে নির্বাচনে বিরোধী দল অংশ নেয় না, সেই তিনটি আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের ৯৪ জন মনোনয়নপত্র কেনেন, কীসের আশায়? কোন মধুর লোভে? লাখ টাকায় ছাত্রলীগ, যুবলীগের পদ বিক্রি হয়, কারণ এর বাজারমূল্য আছে। কাজেই রাজনীতিতে এখন লুটেরাদের আগ্রহ বাড়ছে। আমরা আজকাল আমলাতন্ত্র-বনাম জনপ্রতিনিধিদের বিরোধ নিয়ে কথা বলি। আমলাতন্ত্রের উত্থান গণতান্ত্রিক দেশে কাম্য নয়। কিন্তু আমাদের জনপ্রতিনিধিরা কী করছেন? করোনাকালে প্রধানমন্ত্রী গরিব মানুষকে সহায়তা করতে নানা উদ্যোগ নিয়েছেন। নগদ সহায়তা থেকে শুরু করে খাদ্য সহায়তা- সবকিছুতেই কিছু কিছু জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। কম দুঃখে প্রধানমন্ত্রী আমলাদের দিয়ে ত্রাণকাজ পরিচালনা করছেন না। আবার আমলারাও ধোয়া তুলসীপাতা নন। তারাও অতিরাজনীতি-প্রবণ হয়ে লুটেরা রাজনীতির হিস্সা হচ্ছেন। দুর্নীতিগ্রস্ত জনপ্রতিনিধি আর দুর্নীতিবাজ আমলাদের মহামিলন হচ্ছে কোথাও কোথাও। এটাই হলো লুটতন্ত্রের গন্তব্য। তাহলে কি বাংলাদেশে ত্যাগের রাজনীতি নির্বাসিত হতে যাচ্ছে, প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে লুটতন্ত্র? এ প্রশ্নের উত্তরে যাওয়ার আগে আসুন আমরা লুটের রাজনীতির উৎস অনুসন্ধানের চেষ্টা করি। বাংলাদেশে যত ভ্রষ্টাচার, অনিয়ম সবকিছুর সূচনাবিন্দু ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট। ওই দিন শুধু জাতির পিতাকে হত্যা করা হয়নি, হত্যা করা হয়েছে আমাদের স্বপ্ন, আকাক্সক্ষা এবং নৈতিকতাকে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান হলেন বাংলাদেশে লুটতন্ত্রের প্রবক্তা। রাজনীতিকে ডিফিকাল্ট করতে তিনি লুটেরাদের রাজনীতিতে ঢুকিয়েছিলেন। মন্ত্রিসভার বৈঠকে তিনি মন্ত্রীদের দলের জন্য টাকা সংগ্রহের নির্দেশ দিয়েছিলেন। পার্টি ফান্ডের নামে শুরু হয়েছিল রাষ্ট্রীয় লুটপাট। জিয়ার লুটতন্ত্রে, রাজনীতিবিদ, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের সিন্ডিকেট গড়ে তোলা হয়েছিল। এর মূল লক্ষ্য ছিল লুট করে ধনী হও। ধনী হয়ে দল চালাও। এরশাদ লুটতন্ত্রকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। এরশাদ নিজে কবি ছিলেন। কাজেই তাঁর লুটতন্ত্র ছিল শিল্পশোভিত কাব্যিক। যমুনা সেতুর নামে টেলিফোনে সারচার্জ বসিয়ে পুরো টাকা মেরে দেওয়ার নিপুণ দক্ষতা দেখিয়েছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এরশাদ যেমন প্রশাসন-আইন-আদালত বিকেন্দ্রীকরণ করেছিলেন, ঠিক তেমনি দুর্নীতিকেও ছড়িয়ে দিয়েছিলেন গ্রাম-গ্রামান্তরে। প্রতিটি গ্রামে ‘টাউট’ তৈরি করে দুর্নীতিকে সর্বব্যাপী করেছিলেন পল্লীবন্ধু। আর বেগম জিয়া ও তাঁর পুত্র তারেক জিয়া দুর্নীতির আন্তর্জাতিকীকরণ করেছিলেন। আজ যে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের টাকার পাহাড়, লুটের টাকা পাচার করে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে গচ্ছিত রাখার সংস্কৃতির আবিষ্কারক তারেক জিয়া। জল সব সময় নিচের দিকেই গড়ায়। ব্যাধির সংক্রমণ ভয়াবহ। জিয়া-এরশাদ-বেগম জিয়া-তারেক রাজনীতিতে লুটতন্ত্রের ভাইরাস ছড়িয়ে দিয়েছেন। তাতে আক্রান্ত এখন বাংলাদেশের গোটা রাজনীতি। আওয়ামী লীগে তা-ও মির্জা আজম, তারানা হালিমরা এ নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলেন। অনুপ্রবেশকারী, দুর্বৃত্ত, লুটেরাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ব্যবস্থা নিতে না পারলেও এদের বিরুদ্ধে সোচ্চার তৃণমূল। আওয়ামী লীগ লুটতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত কিন্তু একে মেনে নেয়নি। রোগটা নির্ণয় করতে পেরেছে। তাই আওয়ামী লীগে এসব আপদ, আবর্জনার বিরুদ্ধে একটা অবস্থান আছে। প্রতিরোধের একটা চেষ্টা আছে। কিন্তু বিএনপিতে কী অবস্থা? আওয়ামী লীগ টানা ১২ বছরের বেশি ক্ষমতায়। ক্ষমতাসীন একটি দলে মধুর আশায় মৌমাছি ভিড় করবেই। লুটেরা, সুবিধাবাদী, চাটুকাররা সব সময় ক্ষমতার বৃত্তেই ঘুরপাক খায়। কিন্তু বিএনপি তো ক্ষমতায় নেই ১৪ বছরের বেশি সময়। সেখানে কেন পদবাণিজ্য হয়? ২০১৮-এর নির্বাচনে বিএনপিতে মনোনয়ন-বাণিজ্য নিয়ে হুলুস্থুল হয়ে গেল। কোন কোন নেতা কোন আসন কত টাকায় বিক্রি হয়েছে তার হিসাব দিলেন। বিএনপি নীরব। এখনো বিএনপিতে মাঝেমধ্যেই কমিটি-বাণিজ্য ও পদবাণিজ্য নিয়ে কথা হয়। কদিন আগে বিএনপি নেতা মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন বলছিলেন, তাঁর জেলায় (ভোলা) অঙ্গসংগঠনের কমিটি হয়েছে, তিনি কমিটির কাউকে চেনেন না। শুধু ভোলায় নয়, সারা দেশে একই চিত্র। বিএনপির এক নেতা বলছিলেন, টাকা ছাড়া বিএনপির কোনো পর্যায়ের নেতা হওয়া যায় না। আওয়ামী লীগ যদি লুটতন্ত্রে আক্রান্ত হয়, তাহলে বিএনপি লুটতন্ত্রের প্রতীক। ’৭৫- পরবর্তীতে বাংলাদেশের সব ক্ষেত্রে লুটেরাদের যে অনুপ্রবেশ ঘটেছিল তা আজ রাজনীতিকে দূষিত, দুর্গন্ধময় করে তুলেছে। ’৭৫-এর পর কঠিন সময়ে আওয়ামী লীগকে অনেক ক্ষেত্রেই আপস-সমঝোতা করতে হয়েছে। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জটিল হিসাব -নিকাশে ত্যাগী-পরীক্ষিতদের মনোনয়ন থেকে বাদ দিতে হয়েছে। লুটেরাদের সঙ্গে সহাবস্থান করতে হয়েছে। যে কারণে আওয়ামী লীগে এখন ত্যাগী ও লুটেরাদের সমান্তরাল ধারা বহমান। এখানে যেমন শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা মানুষের জন্য নিজেদের শেষ সম্পত্তিটুকু ত্যাগ করেন, এখানে যেমন তোফায়েল আহমেদ মানুষের জন্য সবকিছু দান করে দেন, তেমনি এ দলেই রুবেল, বরকত, রুপু, এনামুলরা হাজার কোটি টাকা লুট করে নেয়। এরা ধরা পড়েছে, কিন্তু এখনো আওয়ামী লীগে আরও অনেক লুটেরা আছে, যারা আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়েছে। এদের উৎখাত না করতে পারলে আওয়ামী লীগও লুটতন্ত্রে আত্মসমর্পণ করবে। তখন এ দেশে গণতন্ত্রের শেষ বস্ত্রটুকুও খসে পড়বে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৩ জুন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের সব অর্জন আওয়ামী লীগের হাত ধরেই।’ আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কাছে দেশবাসী প্রত্যাশা করে আরও একটি অর্জন আওয়ামী লীগ এবং প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে হোক। দুর্নীতিবাজ, দুর্বৃত্ত, লুটেরাদের হাত থেকে দেশটাকে মুক্ত করার কাজটাও আওয়ামী লীগকেই করতে হবে। আওয়ামী লীগ যদি এটা করতে না পারে তাহলে লুটেরারা আওয়ামী লীগকেই খেয়ে ফেলবে। বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘বাজে গাছগুলো আমি নিজেই তুলে ফেলি। আগাছাগুলিকে আমার বড় ভয়, এগুলি না তুললে আসল গাছগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে। যেমন আমাদের দেশের পরগাছা রাজনীতিবিদ- যারা সত্যিকারের দেশপ্রেমিক তাদের ধ্বংস করে, এবং করতে চেষ্টা করে। তাই পরগাছাকে আমার বড় ভয়।’ পৃষ্ঠা ১১৭।

আওয়ামী লীগ যদি পরগাছারূপী এই লুটেরাদের উপড়ে ফেলতে না পারে তাহলে এরা আওয়ামী লীগকেই ধ্বংস করবে। তখন দেশে নতুন ব্যবস্থা কায়েম হবে, তার নাম ‘লুটতন্ত্র’।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।

ইমেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর