শুক্রবার, ৩০ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

মুক্তিযুদ্ধের একটি স্মরণীয় অধ্যায়

বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম

মুক্তিযুদ্ধের একটি স্মরণীয় অধ্যায়

বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের রাজনৈতিক সচেতন মানুষ ‘নকশালবাড়ী’ ও ‘নকশাল’ শব্দগুলোর সঙ্গে বেশ পরিচিত। এ শব্দ দুটি শোনা বা মনে হওয়া মাত্রই অনুভূত হয় নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। মূলত ‘নকশালবাড়ী’ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি মহকুমার অন্তর্গত একটি এলাকার নাম। এলাকার নামানুসারে থানার নামও নকশালবাড়ী। ওই নকশালবাড়ী এলাকা বাংলাদেশের উত্তর সীমান্ত বাংলাবান্ধা থেকে কাছেই। আবার নেপাল সীমান্তেরও খুব কাছে। ভারতীয় উপমহাদেশ তো বটেই, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও নকশালবাড়ীর পরিচিতি ঘটে ১৯৬৭ সালের মে মাসের শেষ ভাগে। স্থানীয় জমিদার-জোতদারদের বিরুদ্ধে সাধারণ বর্গা চাষি, কৃষক-ভূমিহীনদের বিদ্রোহের কেন্দ্র ছিল এ নকশালবাড়ী। কমিউনিস্ট নেতা চারু মজুমদার, কানু সান্যাল, জঙ্গল সাঁওতালের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল সশস্ত্র কৃষক আন্দোলন। ‘লাঙ্গল যার জমি তার’ এ স্লোগানে উজ্জীবিত হয়ে শুরু হয় শক্তি প্রয়োগে জোরজবরদস্তিভাবে লাল পতাকা উড়িয়ে জমিদার-জোতদারদের জমি দখল, খেতের ফসল কাটা। ১৯৬৭ সালের ২৫ মে নকশালবাড়ীর বেঙ্গাইজোত গ্রামে জড়ো হয়েছিল হাজারো কৃষক, শ্রমজীবী মানুষ। এর আগে আন্দোলনকারীদের তীরের আঘাতে নিহত হন নকশালবাড়ী থানার এক পুলিশ কর্মকর্তা। আন্দোলনকারীদের নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে পুলিশ আক্রমণ চালায় তাদের ওপর। রক্তাক্ত হয় বেঙ্গাইজোত গ্রাম। নিহত হন দুই শিশুসহ ১১ জন। নিহতের মধ্যে মহিলা ছিলেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যায়। মহিলারা ছিলেন মিছিলের সম্মুখভাগে। তাদের দুগ্ধপোষ্য শিশুরা ছিল পিঠে বাঁধা। এ ঘটনার পর থেকে নকশালবাড়ীর এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ‘নকশাল আন্দোলন’ নামে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশেও নকশাল আন্দোলনের ঢেউ লাগে বিভিন্ন আঙ্গিকে।

১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ঐতিহাসিক একটি ঘটনার সাক্ষী এ নকশালবাড়ী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা ঘোষণা করলে শুরু হয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রতিরোধে সশস্ত্র যুদ্ধ। একাত্তরের ১০ এপ্রিল রচিত হয় স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং গঠিত হয় কারারুদ্ধ বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে বাংলাদেশের প্রথম সরকার। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী হন যথাক্রমে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদ। একাত্তরের ১৭ এপ্রিল তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে (পরবর্তীতে যার নামকরণ হয় মুজিবনগর) দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম প্রতিনিধির উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ও শপথ গ্রহণের মাধ্যমে শুরু হয় বাংলাদেশের প্রথম সরকারের ঝঞ্ঝাময় চ্যালেঞ্জিং পথচলা। এ সরকার বহুলভাবে পরিচিতি লাভ করে মুজিবনগর সরকার হিসেবে। সরকার গঠনের পর কোনো কোনো মহল প্রশ্ন ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করে সরকার গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে। আবার কোনো মহল থেকে দাবি করা হয় ‘যুদ্ধকালীন সময়ে প্রয়োজন বিপ্লবী সরকার’। আবার কারও দাবি ছিল ‘সর্বদলীয় জাতীয় সরকার’ কিংবা ‘জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট’ গঠন। সর্বোপরি খন্দকার মোশতাক আহমদ ও তার কতিপয় সহযোগীর প্রচেষ্টা ছিল সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও নেতৃত্ব নেওয়া; সরকারের প্রতি আস্থাহীনতার পরিস্থিতি সৃষ্টি করা। এহেন পরিস্থিতিতে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ও ভারত সরকারের কাছে এ ধরনের একটি বার্তা যায় যে ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী বাংলাদেশের নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের প্রতিনিধিবৃন্দ অনেকেই বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা ও সরকার গঠনের বিষয়ে দ্বিধাদ্ব›েদ্ব ভুগছেন। ফলে স্বাধীনতা যুদ্ধ ও মুজিবনগর সরকারের প্রতি জনপ্রতিনিধির আস্থার বিষয়টি দৃশ্যমান করা জরুরি হয়ে পড়ে। এরই প্রেক্ষাপটে একাত্তরের ৬ ও ৭ জুলাই নকশালবাড়ী ভারতীয় বর্ডার ফোর্সের (বিএসএফ) আঞ্চলিক সদর দফতরসংলগ্ন শালবাগানে অনুষ্ঠিত হয় নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের যৌথ সভা। সভায় ১৩৫ জন জাতীয় পরিষদ সদস্য ও ২৩৯ জন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য উপস্থিত ছিলেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানীসহ প্রায় সব নেতৃবৃন্দ।

ওই বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহের মধ্যে অন্যতম ছিল-

ক) বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণাকে অকুণ্ঠ সমর্থন এবং তাঁর প্রতি অবিচল আস্থা রেখে স্বাধীনতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া;

খ) মুজিবনগর সরকারের প্রতি পূর্ণ আস্থাজ্ঞাপন;

গ) পাকিস্তানের সঙ্গে যে কোনো রাজনৈতিক সমঝোতার সম্ভাবনা নাকচ;

ঘ) পাকিস্তানের কারাগারে আটক বঙ্গবন্ধুর নিঃশর্ত মুক্তি দাবি এবং এ লক্ষ্যে বিশ্বজনমত গড়ে তোলা;

ঙ) বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা-নির্যাতন বন্ধে জাতিসংঘসহ বিশে^র গণতান্ত্রিক দেশসমূহ যাতে পাকিস্তান সরকারকে চাপ প্রয়োগ করে- সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ;

চ) বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যবৃন্দের নিরাপত্তা যাতে কোনোভাবেই বিঘ্নিত না হয়, সে বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ;

ছ) যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পাকিস্তান সরকারকে অস্ত্র সরবরাহের নিন্দা প্রকাশ ও বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধের দাবি;

জ) যুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন।

ওই বৈঠকে খন্দকার মোশতাক ও তার কতিপয় অনুসারী সরকারের ওপর অনাস্থা ও বিভিন্ন সিদ্ধান্তে বিরোধিতা করার কারণে তিনি অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হন এবং এক পর্যায়ে বৈঠক ত্যাগ করেন। জনপ্রতিনিধিদের ঐতিহাসিক ওই বৈঠকের পর স্বাধীনতা যুদ্ধ ও মুক্তিসংগ্রাম নতুন গতি লাভ করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর সরকারের পূর্ণ আস্থা অর্জনে সক্ষম হয় মুজিবনগর সরকার। ওই বৈঠক সম্পর্কে ৩০ জুলাই, ১৯৭১ মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত জয় বাংলা পত্রিকায় (১ম বর্ষ : ১২শ সংখ্যা) আহমদ রফিক সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন- ‘এই বৈঠক প্রমাণ করেছে ইয়াহিয়া চক্রের বর্বরতার মুখেও বাংলাদেশের গণঐক্য অটুট, গণপ্রতিনিধিরা ঐক্যবদ্ধ এবং স্বাধীনতার চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ়সংকল্প। এই বৈঠক আমাদের মুক্তিবাহিনীর মনে নতুন প্রেরণা এনেছে, সাড়ে সাত কোটি মানুষের মনে এনেছে নতুন প্রত্যয়, সুপ্ত সাহস। বহিঃবিশে^র বন্ধু রাষ্ট্রগুলোও উপলব্ধি করেছে, বাংলাদেশের একমাত্র বৈধ ও প্রতিনিধিত্বশীল সরকার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।’ (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিপত্র : ষষ্ঠ খন্ড, পৃ: ৪৫)।

অবশ্য ওই সম্পাদকীয়তে বৈঠকের স্থান মুজিবনগর উল্লেখ করা হয়েছিল। সম্ভবত এটা করা হয়েছিল কৌলশগত কারণে। মূলত বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে বৈঠকটি বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল তেঁতুলিয়া-বাংলাবান্ধার নিকটবর্তী নকশালবাড়ী বিএসএফের আঞ্চলিক সদর দফতর-সংলগ্ন শালবাগানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এলাকাটি বর্তমানে শিলিগুড়ি-বাঘডোগরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিকটবর্তী। তৎকালীন জাতীয় পরিষদ সদস্য অধ্যাপক আবু সাইয়িদ তাঁর লেখা ‘যেভাবে স্বাধীনতা পেলাম’ (পৃ: ১৯৫) বইয়ে উক্ত বৈঠকটি বাঘডোগরায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল বলে উল্লেখ করেছেন। বাঘডোগরা, নকশালবাড়ী পঞ্চায়েত সমিতি ও কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট ব্লকের অন্তর্ভুক্ত অর্থাৎ নকশালবাড়ী প্রশাসনের অধীন। উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে যে, বর্তমান পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া-বাংলাবান্ধা অঞ্চল একাত্তরের যুদ্ধের পুরোটা সময় ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্ত-মুক্তাঞ্চল হিসেবে। যুদ্ধের সময় ওই এলাকা সফর করেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান, প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানীসহ অনেকেই।

রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী সম্পাদিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রাসঙ্গিক দলিলপত্র (মুক্তিযুদ্ধ পর্ব) ১৯৭১, পৃষ্ঠা-১৮৬ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : ষষ্ঠ খন্ড, পৃ. ৪৮২-এ উপরোক্ত বৈঠকটি সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের বাংলাদেশ মিশন, বহির্বিশ্ব প্রচার দফতর কর্তৃক মুজিবনগর থেকে ২১ জুলাই, ১৯৭১-এ প্রকাশিত ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘Bangladesh’-এ প্রকাশিত ‘ELECTED REPRESENTATIVES-VOW AFRESH’ প্রতিবেদনটিতে বৈঠকটির স্থান সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো কিছু উল্লেখ না করে ‘বাংলাদেশের কোনো এক স্থানে অনুষ্ঠিত হয়’ মর্মে উল্লেখ করা হয়। ১৬ জুলাই, ১৯৭১ ‘দি টাইমস অব ইন্ডিয়া’ পত্রিকায় ওই বৈঠকের খবর প্রকাশিত হয় ‘AWAMI M.P.s’ ALL-OUT WAR PLEDGE’ শিরোনামে। ওই প্রতিবেদনেও বৈঠকটির সুনির্দিষ্ট স্থান উল্লেখ না করে বাংলাদেশের কোনো এক স্থান (Somewhere in Bangladesh) উল্লেখ করা হয় (বাংলাদেশ ডকুমেন্টস : ভলিউম-১, পৃষ্ঠা-৩৩৬)। ওই বৈঠকে অংশগ্রহণকারী মুজিবনগর সরকারের পশ্চিম জোন-১-এর চেয়ারম্যান এম আবদুর রহিম, এমপি বৈঠকটি সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন এভাবে- ‘উপস্থিত এমএনএ এবং এমপিএ-দের নিয়ে নকশালবাড়ীর বিশাল শালবাগানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন মুজিবনগর সরকারের তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ ও মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানীসহ আরও অনেকে। এটিকে একটি মিনি যৌথ পার্লামেন্টও বলা যায়। এ অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয় যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। আমরা জনপ্রতিনিধি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর প্রতি অবিচল আস্থা রেখে আমৃত্যু যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সদাপ্রস্তুত। সর্বসম্মত রেজুলেশন গ্রহণ করে সেটা ইন্ডিয়ান গভর্নমেন্টকে দেওয়া হয়। কিন্তু মুজিবনগর সরকারের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ আমাদের এ সিদ্ধান্তে ভিন্নমত প্রকাশ করেন। এ সভাতেই তাঁর ডিফারেন্স অব অপিনিয়ন এলো। খন্দকার মোশতাক প্রকাশ্যেই পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন করার কথা বললেন। তিনি কনফেডারেশন গঠনের প্রস্তাব করলে সভায় উত্তেজনা দেখা দেয়। তখন রাগ করে খন্দকার মোশতাক তাৎক্ষণিকভাবে অধিবেশন ত্যাগ করেন। পরবর্তীতে আরও জানা গেছে, খন্দকার মোশতাক কনফেডারেশন গঠনের জন্য যুদ্ধকালেই নাকি গোপনে তার প্রতিনিধি হিসেবে কয়েকজনকে বিভিন্ন দেশে পাঠিয়েছিলেন। এই অন্তর্ঘাতকের হীনমানসিকাতার চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটে ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে এবং ৩ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারী জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে জেলখানায় নির্মমভাবে হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে...। আমার স্মৃতির পাতায় আজও অমলিন হয়ে আছে নকশালবাড়ীর সেই ঐতিহাসিক অধিবেশনের কথা। যেখানে সমবেত সদস্যগণের অবস্থানকালে আতিথেয়তার জন্য যেসব সামগ্রী আমাদের সরবরাহ করা হয়েছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল একটি দড়ির খাটিয়া, তিনটি কম্বল, একটি মশারি, একটি পানীয় জলের বোতল ও একটি মগ। খাবার সরবরাহের দায়িত্ব ছিল বিএসএফ কর্তৃপক্ষের।

বাঙালি জাতির সেই দুর্যোগময় মুহুর্তে বিশ্বমানবতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সেদিন সেই ঐতিহাসিক অধিবেশনে গৃহীত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকার উদ্যোগী হয়ে যৌথ কমান্ড বাহিনী গঠন করে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামে সক্রিয় সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান করে। আমার বিশ্বাস ভারত সরকার দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত যে সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান করেছিল তা জাতি কোনো দিন ভুলবে না।’ (মুক্তিযুদ্ধে দিনাজপুর- সম্পাদক সুকুমার বিশ্বাস, প্রকাশক মাওলা ব্রাদার্স; দিনাজপুরে মুক্তিযুদ্ধ-সম্পাদনা ড. মোহাম্মদ সেলিম)। ৬ ও ৭ জুলাই, ১৯৭১ সালে নকশালবাড়ীতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের যৌথ বৈঠক স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে নতুন গতি সঞ্চার করে। জনপ্রতিনিধিদের অকুণ্ঠ সমর্থনে মুজিবনগর সরকারের আইনানুগ সরকার হিসেবে ভারতসহ বিশে^র বিভিন্ন সরকার ও দেশের কাছে যথাযথভাবে উপস্থাপন ও প্রতিনিধিত্ব করার পথ সুগম হয়। ত্বরান্বিত হয় আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ।

লেখক : বিচারপতি, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট; হাই কোর্ট বিভাগ এবং সাবেক চেয়ারম্যান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১, বাংলাদেশ।

সর্বশেষ খবর