বুধবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

এক মর্যাদাবান সাহাবি আমর আস সুলামি (রা.)

মাওলানা কারি রফিক আহমদ ওসমানী

এক মর্যাদাবান সাহাবি আমর আস সুলামি (রা.)

তিনি নিজেকে ইসলামের  চতুর্থ ব্যক্তি বলে দাবি করেন। আবার বলেন তিনি নাকি ইসলামের এক চতুর্থাংশ। তিনি আমর। বাবা আবাসা। দাদা খালেদ। মা রমলা। নানা ওয়াকিয়া। তাঁর উপাধি আবু নাজিহ। এই হলো তাঁর প্রাথমিক পরিচয়। তাঁর সম্পর্কে আরও গভীরে যাওয়ার আগে জেনে নিই নিজেকে ইসলামের এক চতুর্থাংশ বলে দাবি করার রহস্য কী? আমর (রা.)-এর নিজ মুখেই শুনি সে রহস্যের কথা।

‘জাহেলি যুগ থেকেই আমি সৎ-পবিত্র জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলাম। মদ, নারী, গানবাদ্য কোনো আসরই আমাকে টানত না। এমনকি মূর্তিও না। বরং যারা মূর্তিপূজায় লিপ্ত থাকত আমি তাদের পথভ্রষ্ট বলেই জানতাম। নিজের হাতে বানানো মূর্তিই নাকি আবার নিজের খোদা! এর চেয়ে বড় বুদ্ধিহীন কথা আর কী হতে পারে? ইসলাম আগমনের আগেই আমি তা অনুধাবন করতে পেরেছি। আমি বিশ্বাস করতাম এসব মূর্তি আমাদের ভালো-মন্দের মালিক নয়। কোনো একজন আছেন যিনি এ বিশ্বচরাচর নিয়ন্ত্রণ করেন। ইসলাম গ্রহণের পর জানতে পারি এরই নাম তাওহিদ। আর তাওহিদ হলো ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। এক চতুর্থাংশও বলা চলে। তাই নিজেকে ইসলামের এক চতুর্থাংশ বলে দাবি করি। কারণ আমার হৃদয়ে তাওহিদের নুর আল্লাহর পক্ষ থেকে সরাসরিই এসেছিল। আর নবী (সা.) সে নুরকে বিকশিত করে আমাকে জান্নাতের ঠিকানা দেখিয়েছেন।’

ইসলামের এক চতুর্থাংশ দাবি করার রহস্য তো বুঝলাম। কিন্তু নিজেকে ইসলামের চতুর্থ ব্যক্তি দাবি করার কারণ কী? মুসলিমসহ বিখ্যাত হাদিস গ্রন্থগুলোয় আছে এর জবাব। আমর ইবনে আবাসা আস সুলামি (রা.) নিজেই বলেছেন সে ঘটনা। ‘জাহেলি যুগের মিথ্যা ধর্ম যখন আমার হৃদয়ে স্থান করে নিতে পারেনি তখন আমি ইসা (আ.)-এর ধর্মানুসারী এক আহলে কিতাবের কাছে গেলাম। যিনি সত্যিকারভাবেই আল্লাহর কিতাবের ওপর গভীর জ্ঞান রাখতেন। তাঁর কাছে গিয়ে বললাম আমাকে সর্বোত্তম ধর্ম সম্পর্কে বলুন। তিনি বললেন, খুব শিগগিরই মক্কায় এক লোকের আবির্ভাব হবে। তিনি মানুষকে স্বজাতির ধর্ম বাদ দিয়ে এক নতুন ধর্মের প্রতি আহ্বান করবেন। এর ফলে তাঁর নিজের কওম তাঁর প্রতি বিদ্রোহী হয়ে উঠবে। তাঁর ধর্মই হবে সর্বোত্তম ধর্ম। তাঁর অপেক্ষায় থাক। সংবাদ পাওয়া মাত্রই তাঁর ধর্ম গ্রহণ করে মহাসৌভাগ্যবানদের খাতায় নাম লেখাবে।’

আমর ইবনে আবাসা আস সুলামি বলেন, ‘এর অল্প কদিন পরই আমি শুনতে পাই মক্কায় এক লোকের আবির্ভাব হয়েছে। যিনি নতুন ধর্মের দাওয়াত দিচ্ছেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে বাহন নিয়ে মক্কার উদ্দেশে রওনা করি। মক্কায় গিয়ে তাঁকে খুঁজতে থাকি। খুঁজতে খুঁজতে তাঁকে পেয়ে গেলাম উকাজ মেলায়। প্রথম সাক্ষাতে তাঁর সঙ্গে আমার কথোপকথন ছিল এ রকম-

আমি : আপনি কে?

তিনি : আল্লাহর নবী।

আল্লাহ কি আপনাকে পাঠিয়েছেন?

হ্যাঁ।

কী নির্দেশসহ পাঠিয়েছেন?

আল্লাহকে এক বলে বিশ্বাস করবে। তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না। মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলবে। আর আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখবে। এসব নির্দেশ মহান আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন।

এখন পর্যন্ত কেউ কি এ দাওয়াতে সাড়া দিয়েছে?

হ্যাঁ। একজন গোলাম ও আজাদ।

তারা কারা?

বিলাল ও আবুবকর।

তাহলে আমাকেও আপনাদের দলে অন্তর্ভুক্ত করে নিন।

তুমি বল- আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই। মুহাম্মদ আল্লাহর বান্দা ও প্রেরিত রসুল।

আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই। মুহাম্মদ আল্লাহর বান্দা ও প্রেরিত রসুল।

এখন থেকে তুমি আমাদেরই একজন।

হে আল্লাহর নবী! আমি আপনার সঙ্গেই থাকতে চাই।

শোনো আমর! আমার নিজ কওম আমার বিরোধিতা করছে। এ অবস্থায় আমার সঙ্গে থাকা সমীচীন নয়। তুমি নিজভূমে ফিরে যাও। মহান আল্লাহর নির্দেশে যখন আমি প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দেব তখন তুমি আমার কাছে এসো।

হে দুনিয়ার মানুষ! শুনে রাখ! এভাবেই আমর ইসলাম গ্রহণ করে এবং সে ইসলামের চতুর্থ ব্যক্তির মর্যাদা লাভ করে।’ মুসলিম, সিয়ারু আলামুন নুবলা।

রসুল (সা.)-এর নির্দেশমতো আমর (রা.) নিজ গোত্রে ফিরে যান। মক্কায় যাতায়াতকারীদের মাধ্যমে তিনি সব সময় নবীজির খবর রাখতে লাগলেন। একদিন শোনেন মদিনায় এক লোকের আবির্ভাব হয়েছে। তিনি সংবাদ-দাতাকে জিজ্ঞেস করেন কে সে? কোথা থেকে এসেছে? তাঁর গতিপথ এখন কেমন? সংবাদদাতা বলল, ‘সে নিজেকে নবী বলে দাবি করে। তাঁর কওম তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছিল। কিন্তু সফল হয়নি। মদিনায় আসার পরপরই মানুষ দলে দলে তাঁর ধর্ম গ্রহণ করছে।’ বিস্তারিত শুনে বুঝতে বাকি রইল না এই মানুষটির অপেক্ষায়ই তিনি দিন গুনছেন। সঙ্গে সঙ্গে নবী (সা.)-এর দরবারে হাজির হলেন আমর। বললেন, হে আল্লাহর নবী! আমাকে চিনতে পারছেন? নবী (সা.) বললেন, ‘তুমি আমর ইবনে আবাসা আস সুলামি। তোমার সঙ্গে মক্কার উকাজ মেলায় দেখা হয়েছিল। তখন আমার জাতি আমার বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে। তাই তোমাকে আমার কাছে রাখতে পারিনি। এখন থেকে তুমি নির্দ্বিধায় আমার সঙ্গে থাকতে পারবে।’ রসুল (সা.)-এর অনুমতি পেয়ে তিনি মদিনায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। মৃত্যু পর্যন্ত মদিনার বাসিন্দাই ছিলেন।

 

লেখক : খতিব, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সেন্ট্রাল জামে মসজিদ, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর