বুধবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন

খায়রুল কবীর খোকন

তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অবিস্মরণীয় একটি নাম জিয়াউর রহমান। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর এই বাঙালি মেজর জিয়াউর রহমানই বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে। বর্বর দখলদার পাকিস্তানি সেনারা রাজনৈতিক মুক্তিসংগ্রাম -রত নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ২৫ মার্চ (১৯৭১) মধ্যরাতে যখন ট্যাংক, কামান, মেশিনগান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল তখন মেজর জিয়া বিদ্রোহ করলেন, এক মুহূর্তও দেরি করলেন না। মধ্যরাতের পর ঠিক ২৬ মার্চের শুরুতে তিনি চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে তাঁর সঙ্গী বাঙালি সৈনিক ও সেনা অফিসারদের নিয়ে পাকিস্তানি দখলদার সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন বীরবিক্রমে। ইতিহাসে তা এক প্রকৃত বীর-নায়কের সময়োচিত পদক্ষেপ হিসেবে মূল্যায়নের দাবি রাখে।

১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি জিয়াউর রহমান (ডাকনাম কমল)-এর জন্ম। পিতা রসায়নবিদ মনসুর রহমান ও মাতা নজরুলসংগীত শিল্পী জাহানারা রহমানের (ডাকনাম রানী) দ্বিতীয় পুত্র তিনি। জিয়াউর রহমানের পিতামহ ও মাতামহের পরিবার উজ্জ্বল ঐতিহ্যের অধিকারী আর পিতা মনসুর রহমান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নশাস্ত্রের মাস্টার্স ডিগ্রিধারী, মেধাবী রসায়নবিজ্ঞানী। পিতামহ ছিলেন বীজগণিতের একজন দক্ষ ব্যক্তিত্ব আর মাতামহ চা-বাগান কোম্পানির একজন মেধাবী উদ্যোক্তা। পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড জিয়াকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছে জাতির একজন বীর-নায়ক ও রাষ্ট্রনেতা হওয়ার পথে।

জিয়াউর রহমান স্কুল-কলেজে মেধাবী ও গুণী শিক্ষার্থী হিসেবে সুনাম অর্জন করেন। পঞ্চাশের দশকে পাকিস্তান সামরিক অ্যাকাডেমির ক্যাডেট হিসেবে বেশ দক্ষ ও স্বনামধন্য হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন। তিনি অসাধারণ দেশপ্রেমিক সেনা অফিসার হিসেবে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে বীরোচিত অবদান রাখেন তৎকালীন পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলের খেমকারান সেক্টরে। রাষ্ট্রীয় পেশাদার সেনাবাহিনীর একজন দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারের যথাযোগ্য ভূমিকা রাখাই তাঁর কর্তব্য ছিল। আবার বাঙালি সেনা অফিসার হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনা-অফিসারদের কাছে নিজেদের আত্মমর্যাদা ও অধিকার সমুন্নত রাখার চেষ্টায় তিনি ছিলেন শক্ত মেরুদন্ডের এক যোদ্ধা। যখনই কোনো বাঙালি সেনা অফিসার বা সেনাকে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনা অফিসারদের দ্বারা অবমূল্যায়নের ও অবজ্ঞার শিকার হতে দেখতেন, জিয়াউর রহমান সুশৃঙ্খলভাবে তার প্রতিবাদ করতেন এবং নিজেদের বাঙালি অফিসার ও সেনাদের যথাযথ অবস্থান ও মূল্যায়ন আদায় করে ছাড়তেন। তাঁর সহকর্মীরা সে রকম অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী। ১৯৭০ সালে জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এর আগে তিনি নিজ দায়িত্বশীল ও দক্ষ আচরণের দ্বারা পাকিস্তান সামরিক গোয়েন্দা বিভাগে কাজের সুযোগ পান। ঊনসত্তরের ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানের পরপরই (সম্ভবত নতুন শাসকের আমলে) মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সঙ্গে টাঙ্গাইলের সন্তোষের বাড়ি গিয়ে আলোচনায় বসেন। তখন জিয়াউর রহমান বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের অনেক বিষয় জেনে তাতে নিজের দিক থেকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে উদ্বুদ্ধ হন। তবে সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে তিনি সেসব নিজের ভিতরে লুকিয়ে রাখেন। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর চাকরির দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে মেজর জিয়াউর রহমান বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন ও জাতীয়তাবাদী আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের সব বিষয় মওলানা ভাসানীর কাছ থেকে জেনে-বুঝে তাতে নিজেই উদ্বুদ্ধ হন অত্যন্ত গোপনীয়তার মধ্যে। জিয়া তখন থেকেই বাঙালির চূড়ান্ত লড়াইয়ে যোগদানের অপেক্ষায় ছিলেন। আজকে কোনো কোনো রাজনীতিক জিয়াউর রহমানের দেশপ্রেম নিয়ে, রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ নিয়ে কটাক্ষ করেন নিতান্তই মতলববাজির উদ্দেশ্যে, হীনমন্যতা ও ঈর্ষাকাতরতায় জ্বলে-পুড়ে। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে কর্মরত অবস্থায় বাঙালি সমসাময়িক সামরিক অফিসারদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে নিজেদের চূড়ান্ত লড়াইয়ে (পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অবাঙালি অংশের ক্ষমতাধরদের উপনিবেশবাদী চক্রান্তের বিরুদ্ধে) অংশগ্রহণের প্রস্তুতির ব্যাপারে আলোচনা ও আগাম সিদ্ধান্ত (সর্বশেষ বিষয়াদি) প্রস্তুত করে নিতেন একজন সাচ্চা দেশপ্রেমিক অফিসার হিসেবে। তা ছাড়া নিজের পারিবারিক সদস্যদের ও অন্য আত্মীয়স্বজনের সূত্রে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সর্বশেষ ঘটনাবলির প্রকৃত চিত্র সংগ্রহ করে রাখতেন কঠোর গোপনীয়তায়। একজন দক্ষ সামরিক অফিসার হিসেবে তিনি তা বেশ ভালোভাবে করার সক্ষমতা অর্জন করেন। তাঁর পশ্চিম পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বসদের তা ঘুণাক্ষরেও টের পেতে দেননি। ১৯৭০ সালের শেষ প্রান্তে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনের সময় তিনি সর্বশেষ সত্যগুলো যাচাই-বাছাই করার যথেষ্ট সুযোগ নেন এবং নিশ্চিতভাবে রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে ও জাতির স্বায়ত্তশাসন এবং আত্মনিয়ন্ত্রণ সংগ্রামে নিজ দেশপ্রেমিক দায়িত্ব পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। মেজর জিয়াউর রহমান ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন সতর্কভাবে। তিনি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্সে কাজ করা সাবেক ‘দক্ষ অফিসার’, তাই তাঁর কাছে সব খবর সহজেই পৌঁছে যেত, তিনি অপেক্ষায় ছিলেন কোন সময় মাতৃভূমির ডাকে কোন প্রক্রিয়ায় সাড়া দিতে হবে। তিনি নিশ্চিতভাবে জানতেন পাকিস্তানিরা এ দেশ আক্রমণ করবে এবং বাঙালিদের সশস্ত্র যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করতে হবে। এবং সেই স্বাধীনতার সশস্ত্র যুদ্ধে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম সারির সম্মুখযোদ্ধা হবেন বাঙালি সামরিক বাহিনীর সদস্যরা। তাতে নেতৃত্ব দেবেন সাহসী ও সাচ্চা দেশপ্রেমিক বাঙালি সামরিক অফিসাররা। হয়তো সবাই আসবে না, তবে একটা বড় অংশই আসবে যারা দেশপ্রেমিক অফিসার ও সৈনিক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যারা মনে-প্রাণে চায়।

প্রতিরোধযুদ্ধ চলমান রাখার জন্য মেজর জিয়াউর রহমানের সেই ২৭ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা এবং ২৫ মার্চ মধ্যরাত (দিবাগত) থেকে বিদ্রোহ করে পাকিস্তানি দখলদার বর্বর বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা ছিল একটা অপরিহার্য ব্যাপার। পুরো বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধে উদ্বুদ্ধ করার সবচেয়ে জরুরি বিষয়। মেজর জিয়াউর রহমান সে দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে জাতির জন্য নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেন। তিনি ৩০০ বাঙালি সেনা ও তার পেছনের লাখো সিভিলিয়ান সমর্থককে নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে কয়েকদিন ধরে যুদ্ধ করতে করতে ‘কৌশলগত পশ্চাৎপসরণ’ করে পিছিয়ে আরও বড় প্রস্তুতি গ্রহণের লক্ষ্যে ভারতের মাটিতে ঢুকে যেতে বাধ্য হন। শতভাগ দেশপ্রেম ও সর্বোচ্চ মানের সামরিক কৌশল অবলম্বন করে মেজর জিয়াউর রহমান যে ভূমিকা পালন করেন তা মানব জাতির সংগ্রামের ইতিহাসে, যে কোনো জাতির মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকবে। মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনা গ্রহণ এবং যুদ্ধ পরিচালনায় জিয়াউর রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৭১ সালের জুন পর্যন্ত ১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে এবং পরে ‘জেড’ ফোর্সের প্রধান হিসেবে তিনি নিজেকে অসম সাহসী যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত করে তোলেন এবং সাহসিকতার জন্য তাঁকে ‘বীরউত্তম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়।

নয় মাস যুদ্ধে কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধের পর জিয়াউর রহমানকে কুমিল্লায় সেনাবাহিনীর ব্রিগেড কমান্ডার নিয়োগ করা হয়। ১৯৭২ সালের জুনে তাঁকে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ পদে উন্নীত করা হয়। ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি তিনি ব্রিগেডিয়ার পদে এবং বছরের শেষ নাগাদ মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭৫ সালের ২৫ আগস্ট জিয়াউর রহমান চিফ অব আর্মি স্টাফ নিযুক্ত হন। ওই বছরের ৩ নভেম্বর শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বাধীন ঢাকা ব্রিগেডের সহায়তায় খালেদ মোশাররফ যখন এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটান তখন জিয়াউর রহমানকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয় এবং গৃহবন্দি রাখা হয়। ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার বিপ্লব তাঁকে রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে। ১৯৭৭ সালে তিনি রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করেন। ১৯৭৮ সালের নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হন এবং ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে সেনা অভ্যুত্থানে শাহাদাতবরণ পর্যন্ত ওই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। জিয়াউর রহমান ছিলেন এ দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা। তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন এ দেশের জনমনে।

 

লেখক : বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব

সাবেক সংসদ সদস্য ও ডাকসু সাধারণ সম্পাদক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর