শনিবার, ৩০ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

আষাঢ়-শ্রাবণে নেই বর্ষা

শাইখ সিরাজ

আষাঢ়-শ্রাবণে নেই বর্ষা

“আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন

ঝর ঝর ঝর ঝর ঝরেছে

তোমাকে আমার মনে পড়েছে

তোমাকে আমার মনে পড়েছে॥”

লতা মঙ্গেশকরের কালজয়ী এই গানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের অনেকেরই শৈশব-কৈশোর। মনে পড়ে ষাট দশকেও সাধারণ মানুষের পক্ষে গান শোনার খুব একটা সুযোগ ছিল না। তখনো বাড়িতে বাড়িতে রেডিও আসেনি। যাদের সামর্থ্য ছিল তারা টিকিট কেটে সিনেমা দেখত। তবে সে সময় বিয়েবাড়ি মানেই মাইকে গান বাজত। কলেরগানে গান বাজানো হতো, সেই গানই বাজত মাইকে। নিশুতি রাতেও দূর থেকে ভেসে আসত সেই গান। মা যখন মধ্যরাতে ঘুম থেকে জাগিয়ে শৌচাগারে নিয়ে যেতেন, রাতের নিস্তব্ধতায় সেই গানগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে আসত। আর সত্যি আমাদের মন কেমন করত। কারও কথা মনে পড়ত। আমাদের সময় বর্ষাকাল মানে বর্ষাকালই ছিল। আর আষাঢ়-শ্রাবণেই বর্ষা হতো। আমার আশৈশব বেড়ে ওঠা ঢাকার খিলগাঁওয়ে। খিলগাঁও ছিল সবুজে ছাওয়া এক অরণ্য। বর্ষায় চলত সারা দিন ঝুম বৃষ্টি। বনে-জঙ্গলে ফুটত বর্ষার ফুল। বৃষ্টিভেজা কদমের চাপা ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ত চারপাশে। কিন্তু ক্রমেই বর্ষা হারিয়ে যেতে থাকল। বিশেষ করে ঢাকায় শীত-বর্ষা-বসন্ত বলে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকল না। ধীরে ধীরে এ পরিস্থিতি যেন ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশেই। বর্ষা যেন ঠিক আগের জায়গায় নেই। আগের জায়গায় নেই শীত, বসন্ত বা গ্রীষ্ম। এই সময়ে এসে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বেশ ভালোভাবেই টের পাচ্ছি আমরা। উত্তরবঙ্গে কয়েকটি জেলায় যেখানে এক মাস আগেও ছিল বন্যা। এখন সেখানে রীতিমতো খরা। পানির অভাবে নষ্ট হচ্ছে আমনের বীজতলা। একদিকে যেমন অনাবৃষ্টি, অন্যদিকে ডিজেলের দাম বৃদ্ধি ও তীব্র লোডশেডিংয়ের কারণে দিশাহারা কৃষক। শুধু আমাদের দেশেই নয়, এ মুহূর্তে বিশ্বের বহু দেশের মানুষকে ভয়ংকর দাবদাহে পুড়তে হচ্ছে, কোথাও আবার চলছে বন্যা। যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপের একটি অংশে এ মাসেই থার্মোমিটারের পারদ সব রেকর্ড ভেঙে উঠে গেছে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে। তাতে যানবাহন চলাচলে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, তৈরি হয়েছে পানির সংকট। অধিকাংশ ঘরবাড়ি কাঠের তৈরি বলে অধিক তাপে আগুন লাগার ঘটনাও ঘটছে। গত ১৯ জুলাই যুক্তরাজ্যের তাপমাত্রা ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে যায়। যুক্তরাজ্যের আবহাওয়া দফতর বলছে, এরকম তীব্র দাবদাহের প্রবণতা সাম্প্রতিক সময়ে অন্তত ১০ গুণ বেড়েছে এবং আগামীতে অবস্থা এর চেয়েও বাজে হতে পারে।

তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিরূপ প্রভাব পড়েছে চীনেও। প্রচ- গরমে অতিষ্ঠ হয়ে চীনের বিভিন্ন বাসাবাড়িতে, অফিস ও কারখানায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে। এতে আশঙ্কা করা হচ্ছে গ্রীষ্মকালজুড়ে বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। চীনের জরুরি ব্যবস্থাপনাবিষয়ক মন্ত্রণালয় বলেছে, উ™ূ¢ত পরিস্থিতিতে নিরাপদে কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়টি বড় ধরনের পরীক্ষার মধ্যে পড়তে পারে। এ মাসে সাংহাইয়ের তাপমাত্রা ৪০ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছে। ১৮৭৩ সালে চীনে তাপমাত্রা রেকর্ড রাখা শুরুর পর থেকে এ নিয়ে দ্বিতীয়বার তাপমাত্রা এমন উচ্চতায় পৌঁছাল। সাংহাইয়ে গ্রীষ্মকালে তৃতীয়বারের মতো চরম গরমজনিত সতর্কতা জারি করতে হয়েছে। এ সবই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘটছে। শিল্প যুগের শুরু থেকে জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে আমরা বায়ুমন্ডলে কার্বন গ্যাসের ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলেছি। ফলে বায়ুমন্ডল অতিরিক্ত তাপমাত্রা ধরে রাখছে। আবার পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলায় সেই তাপও বিশ্বের সব জয়গায় সমানভাবে ছড়াচ্ছে না। দাবদাহ যে শুধু আরও উষ্ণ হয়ে উঠছে তা নয়, এর স্থায়িত্বও বাড়ছে। গত ৫০ বছরে দাবদাহের স্থায়িত্ব দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আগেই বলেছি- জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের ঋতুচক্র বদলে যাচ্ছে। আর এর নেতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যে কৃষি উৎপাদনের ওপর পড়তে শুরু করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে- জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার জন্য আমরা কতটুকু প্রস্তুত। যত দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে, আমাদের গবেষণা সে গতির সঙ্গে পেরে উঠছে না। যেসব ফসলের জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হচ্ছে, তা কৃষকের কাছে ভালোমতো পৌঁছাচ্ছে না। অনেক প্রযুক্তি সঠিকভাবে কাজও করছে না। জলবায়ুর ক্রমপরিবর্তনের সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে খাদ্য উৎপাদনের ওপর; যার ফলে কৃষক সবচেয়ে ক্ষতির মুখে পড়ছে। নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে গত বছর হাওর অঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ধান নষ্ট হয়ে গিয়েছিল অকস্মাৎ হিট ওয়েবে। প্রতি বছরই আবহাওয়ার বিরূপ আচরণের শিকার হচ্ছে আমাদের কৃষি। তাই জলবায়ু পরিবর্তনকে মাথায় রেখে কৃষি পরিকল্পনার কথা ভাবতে হবে নতুন করে।

আমরা একটু দৃষ্টি দিতে পারি উন্নত বিশ্বের কৃষি পরিকল্পনার দিকে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার বিবেচনায় ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর ৬৭% লোক চলে আসবে নগর এলাকায়। একদিকে নগর ধেয়ে যাচ্ছে গ্রামাঞ্চলের দিকে। গ্রামীণ জীবন ও সমাজ নগরায়ণের প্রভাবে পাল্টে যাচ্ছে। অন্যদিকে অব্যাহত রয়েছে নগরমুখী মানুষের স্রোত। আমাদের ঢাকা শহরের বাস্তবতাই জানান দেয় সে কথা। প্রশ্ন হলো, নগর যদি মানুষের এই চাপ সামাল দিতেও পারে, তাহলে খাদ্য জোগান নিশ্চিত হবে কীভাবে? পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো এ ভাবনায় যথেষ্টই অগ্রসর। তার মানে নগরের মানুষও কৃষি থেকে পিছিয়ে নেই। আপনাদের অনেকেরই হয়তো মনে আছে নব্বই দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানে ‘ছাদে বাগান’ গড়ার একটি অভিযান শুরু করেছিলাম। আবার হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানের পক্ষ থেকে নগর কৃষির উদ্বুদ্ধকরণ অভিযান শুরু করেছি বেশ আগে। বিশেষ করে নগরের মানুষকে কৃষিতে অনুরক্ত করে তোলা ও প্রজন্মের কাছে কৃষির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরার প্রচেষ্টা থেকেই এসব উদ্যোগ। আমরা কখনই গ্রামের মানুষের, বিশেষ করে কৃষকের সমস্যাটি তেমনভাবে অনুধাবন করতে পারি না। এর প্রধান কারণ, নীতিনির্ধারক সবাই মূলত শহরে বসবাস করেন। আর একটা বিষয় আমরা আমলে নিচ্ছি না। সেটা হলো, গ্রামগুলো ধীরে ধীরে শহরে পরিণত হবে। আগেই বলেছি, আগামীর কৃষি মানেই ইন্ডাস্ট্রিয়াল কৃষি। এক অর্থে নগর কৃষি। এ আধুনিক কৃষির জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে আমাদের। তৈরি করতে হবে দক্ষ জনশক্তি। নতুন প্রজন্মের কৃষির জন্য প্রজন্মকে তৈরি করতে হবে। তরুণদের অংশগ্রহণ বাড়াতে নিতে হবে উদ্যোগ, তৈরি করতে হবে পরিবেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে গোটা পৃথিবীতেই আজ যে চ্যালেঞ্জ দানা বাঁধছে, তা হচ্ছে খাদ্য নিরাপত্তা ও নিরাপদ খাদ্য। যে হিসাবেই আমরা ২০৩০-এর মধ্যে পৃথিবীকে ক্ষুধামুক্ত করার চিন্তা করি না কেন, পরিকল্পিত নগরায়ণ, বিশুদ্ধ নিঃশ্বাসের ব্যবস্থা আর কৃষকসহ সব মহলের সমান অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে একটি বাস্তবমুখী কৃষি ও আবাসন পরিকল্পনা না করতে পারলে এই স্বপ্ন পূরণ করা কঠিন হবে।

সরকারের কৃষি বিভাগ, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও কৃষিপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়ে নিতে হবে পরিকল্পিত উদ্যোগ। একদিকে আধুনিক কৃষিচর্চার অবকাঠামোগত পরিবর্তন যেমন আনতে হবে, আধুনিক করতে হবে কৃষি শিক্ষাব্যবস্থার। মাঠের সমস্যাগুলো আমলে নিয়ে গবেষণা করতে হবে। অর্থাৎ কৃষি গবেষণা হতে হবে বাস্তবমুখী। সব উদ্যোগে যুক্ত রাখতে হবে কৃষককে। আগামীর কৃষির সঙ্গে কৃষককে পরিচয় করিয়ে দিতে না পারলে ভবিষ্যৎ কৃষি উৎপাদন পড়বে সংকটে। তাই খাদ্য নিরাপত্তা ও নিরাপদ খাদ্যের তাগিদে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ে সময়োপযোগী গবেষণাসহ নানামুখী কাজ অব্যাহত রাখতে হবে। তবেই অর্জিত হবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর