শুক্রবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

বাংলা ভাষায় সিরাতচর্চা

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

বাংলা ভাষায় সিরাতচর্চা

প্রগতিশীল তথা আধুনিক-মনস্ক আলেম সারা বিশ্বেই বিরল। ইসলামের সোনালি যুগে আলেমরা প্রগতিশীল ছিলেন বলেই আরবের বাইরের নানা জাতি ও ধর্মের মানুষের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে। শুধু তাই নয়, দীর্ঘ সময় ধরে ইতিহাস ছিল বন্ধ্যা। সে বন্ধ্যত্ব কেটেছে মুসলমানদের জ্ঞান সাধনায়। পরবর্তীতে মুসলমানদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ও বুদ্ধির সংকীর্ণতা পেয়ে বসে। মুসলমানরা ইসলামের বৃহৎ কল্যাণের কথা ভুলে ছোটখাটো বিষয় নিয়ে দলাদলি ও নোংরামিতে ডুবে যায়। এ ক্ষেত্রে ভারতীয় উপমহাদেশের আলেমদের কথা সবাই জানেন। যখনই জ্ঞান-বিজ্ঞানের কোনো আবিষ্কার হয়েছে, ভারতীয় আলেমরাই প্রথম ‘কাফেরদের বানানো’ বলে ওসব হারাম ঘোষণা করেছেন। এমন এক নাজুক পরিস্থিতিতে ভারতবর্ষে যে কজন মুক্তমনা আধুনিক পন্ডিতের আগমন ঘটে মাওলানা আকরম খাঁ তাঁদের অন্যতম।

মাওলানা আকরম খাঁর ইলমি খেদমতের মধ্যে হুজুর (সা.)-এর জীবনীনির্ভর গ্রন্থ ‘মোস্তফা চরিত’ অন্যতম। গ্রন্থটি লেখা হয়েছে ভিন্ন ঢঙে। কেবল নবীজীবনের ঘটনাপরম্পরা বর্ণনা করে যাওয়াই লেখকের উদ্দেশ্য ছিল না। বরং প্রতিটি ঘটনা নতুন করে যাচাই-বাছাই করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। ভূমিকায় আকরম খাঁ বলেন, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হজরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সা.)-এর সিরাতচর্চার দীর্ঘ ইতিহাসে একটি মারাত্মক ভুল হয়ে আসছে। ভুলটি হলো, সিরাতচর্চায় আমরা কেবল ঐতিহাসিক গ্রন্থ যেমন তাবারি, তাবাকাত, ইবনে হিশাম ও ওয়াকেদির লেখার ওপর নির্ভর করেছি। ঐতিহাসিক বর্ণনার সবচেয়ে বড় বিপদ হলো, এগুলো হাদিসের মতো শুদ্ধ-অশুদ্ধ নির্ণয় করা হয়নি। ফলে সিরাতচর্চায় ঐতিহাসিকদের লেখা বিনা বিচারে গ্রহণ করা আমি নিরাপদ মনে করিনি।

মাওলানা আকরম খাঁ বলেন, সিরাতের নির্ভরযোগ্য উৎস হলো কোরআন। তারপর হাদিস। তৃতীয় উৎস হলো ইতিহাস। দেখা গেছে, সিরাতচর্চায় কিছু কিছু ঐতিহাসিক বর্ণনা এমনভাবে ঢুকে গেছে যার গ্রহণযোগ্যতা কোরআন-হাদিসের মতোই নিরেট সত্য হিসেবে মুসলানদের কাছে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়। এটাও কোনো সমস্যা না। সমস্যা হলো, নবীজীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত এমন সব ঐতিহাসিক বর্ণনা ‘খাঁটি সত্য’র পোশাক পরে মুসলমানদের সামনে প্রতিদিন সকাল বিকাল ঘুরে বেড়াচ্ছে, যেগুলো কোরআন-সুন্নাহর সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। সিরাতের এসব বিষয় মাওলানা আকরম খাঁ বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। উদাহরণস্বরূপ ‘স্যাটানিক ভার্সেস’-এর বিষয়টি বলা যায়। সংক্ষেপে ঘটনা হলো, নবুয়তের কয়েক বছরের মাথায় হুজুর (সা.)-এর ওপর যখন জুলুম-নির্যাতনের খড়্গ নেমে আসে, তখন হুজুর একদিন কোরআনের আয়াত তিলাওয়াত করতে গিয়ে সুরা নাজমের কয়েকটি আয়াতে মক্কার বড় দুই দেবতা লাত ও উজ্জার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বসেন। অথচ হাদিস এবং খোদ সুরা নাজমের আলোকেই ঘটনাটি জাল। এর বড় প্রমাণ হলো, সুরা নাজমেই মিথ্যা দেবদেবীদের কঠোর নিন্দা করা হয়েছে। আবার বুখারিতে প্রত্যক্ষদর্শী সাহাবিদের থেকে এ ঘটনার যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তাতে স্যাটানিক ভার্সেস বা দেবদেবীর প্রশংসাসূচক কোনো আয়াতের উল্লেখ নেই। বুখারির হাদিস উল্লেখ করা ছাড়াও এ ঘটনাটি যে পুরোপুরি মিথ্যা তা প্রমাণের জন্য পূর্ববর্তী মুহাদ্দিসদের বিভিন্ন যুক্তিতর্ক তুলে ধরে মাওলানা বলেন, মুহাদ্দিস ইবনে খুজাইমাকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ লিখে এর অসারতা প্রমাণ করেন।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি পীর সাহেব, আউলিয়ানগর

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর