বৃহস্পতিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

সত্য নিয়ে তর্ক করা বোকামি

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

সত্য নিয়ে তর্ক করা বোকামি

ধর্ম নিয়ে দলাদলি নতুন কিছু নয়। দলাদলির ধরনও নতুন নয়। অমুক মাওলানার ফতোয়ার সঙ্গে অমুক শায়খের ফতোয়া মেলে না। একজন বলেন এটা জায়েজ, অন্যজন বলেন সুস্পষ্ট হারাম। কিছু মাওলানার দ্বন্দ্বে সাধারণ মানুষ দিশাহারা। আমজনতার বিশ্বাস, আমাদের হুজুর যা বলেছেন তা নিরেট সত্য। কিন্তু যে হুজুরকে আমরা চোখ বুজে বিশ্বাস করি, প্রশ্ন হলো সে হুজুর নিজেকে বিশ্বাস করেন কি! নিজের দেওয়া তথ্য, মন্তব্য, মাজহাবের ওপর কি হুজুরের পুরোপুরি আস্থা আছে? প্রশ্নটি হয়তো শিশুসুলভ শোনাচ্ছে। এমন কোনো হুজুর যদি লেখাটি পড়ে থাকেন তবে আমার সঙ্গে তিনি দ্বিমত করবেন আমি নিশ্চিত। তাচ্ছিল্যের সুরে জানতে চাইবেন, আমার ওয়াজ আমি নিজেই বিশ্বাস করব না, এটা কেমন কথা? আসলেই তো। তা ছাড়া আমি নিজেও একজন হুজুর। আলেম শব্দটা ইচ্ছা করেই লিখিনি। শব্দের ভার সইবার ক্ষমতা নেই তাই। মূল কথায় যাওয়ার আগে একটি গল্প বলে নিই।

একবার এক মুরিদ হন্তদন্ত হয়ে পীরের আস্তানায় এলেন। পীর সাহেব বললেন, কী হয়েছে বাবা! মুরিদ বললেন, হুজুর! পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে আপনি মূর্খ! আপনার কোনো এলেম নেই। আপনি ভণ্ডপীর। আমি তাদের সঙ্গে একচোট তর্ক করে এসেছি। আচ্ছা বলুন তো, মানুষ যা সব বলছে তা কি আসলেই সত্যি? আপনি কি ভণ্ড? পীর সাহেব মুচকি হেসে বললেন, যা রটে তা কিছু হলেও বটে। আমি আসলেই ভণ্ড। এমন কথা শুনে মুরিদের মন খারাপ হয়ে গেল। সে রাগারাগি করে দরবার থেকে বেরিয়ে গেল। অন্য মুরিদরা জিজ্ঞাসা করল, হুজুর! আপনি এত বড় কামেল হয়েও নিজেকে ভণ্ড বললেন কেন? এর রহস্য কী? পীর সাহেব বললেন, সূর্যকে যখন কোনো মোমবাতি জিজ্ঞাসা করে, ও সূর্য! রাত হলেই মানুষ আমাকে জ্বালায়, পোড়ায়। আচ্ছা বল তো, তোমার কি আসলেই পর্যাপ্ত আলো আছে? দিনে পারলে রাতে কেন আলো দিতে পারছো না? সূর্য জবাবে মুচকি হেসে বলল, ঠিক বলেছ ভাই মোমবাতি। আমার কোনো আলো নেই। তাই রাতের আঁধার দূর করার দায়িত্ব তোমাকেই পালন করতে হচ্ছে। একটু থেমে পীর সাহেব বললেন, শোনো বাবারা! সূর্য নিয়ে কোনো তর্ক চলে না। তবে পেঁচা সূর্যের অস্তিত্ব বিশ্বাস করে না। আমার ওই মুরিদের মনে আমাকে নিয়ে সন্দেহ ছিল। তাই নিজের সন্দেহ দূর করার জন্য সে মানুষের সঙ্গে তর্ক করেছে। বলেছে, আমার পীর ভালো। তিনি সেরা। তিনি কামেল। আরও অনেক কথা। কিন্তু এত কিছুর পরও যখন নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারেনি তখন সে আমার কাছে জানতে চেয়েছে আমি ভণ্ড না ভালো। আমি যতই তাকে বলি আমার পথ সঠিক সে ততই আমার সঙ্গে তর্ক জুড়ে দেবে। একটা পর্যায় মোমবাতির মতো বলে বসবে, তাহলে রাতে সূর্য আলো দেয় না কেন? তখন সূর্যকেও হার মানতে হবে। তাই আমিও হার মেনে গেলাম। তর্কে জড়ালাম না।

আসলে তর্কে কখনো সত্যি থাকে না। বিশ্বাসের দুর্বলতা থেকেই তর্ক জন্ম নেয়। শয়তান যখন আল্লাহর সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়ল, যখন সে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বসল তখনই ধ্বংস হয়ে গেল। এ কারণেই আল্লাহ দায়িদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘যখনই মূর্খদের সামনে পড়ে যাবে তাদের সঙ্গে তর্ক এড়িয়ে সালাম বলে কেটে পড়বে।’

এবার মূল কথায় ফিরি। আমরা যারা ওয়াজ করি এদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন একজনের ফতোয়া আরেকজন মিথ্যা বা ভুল বলে উড়িয়ে দিই, দলিলের পর দলিল নিয়ে হাজির হই। তখন এটাই প্রমাণ করে যে, আমার বক্তব্য আমি নিজেই বিশ্বাস করলাম না। যদি করতাম তাহলে তো এ নিয়ে তর্কের প্রয়োজন নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, যুক্তি দিয়ে যদি ঈশ্বরকে প্রমাণ করা যেত তাহলে যুক্তি দিয়েই ঈশ্বরকে খণ্ডন করা যেত। প্রতিটি যুক্তিরই পাল্টা যুক্তি আছে। হয়তো আমি জানি না। কিন্তু পাল্টা যুক্তি আছেই। আজ হয়তো কোনো বাহাসে আমি জয়ী হলাম। কিন্তু আমার চেয়ে কোনো বড় তার্কিক এলে আমাকে হারিয়ে দিত। তাই ধর্মীয় বিষয় নিয়ে কোনো তর্ক চলে না। যার ইজতিহাদে যা সঠিক মনে হয়, সে তা করবে। এ কারণেই তো ইসলামে মাজহাবের ভিন্নতা। সমস্যা হয় তখন যখন কেউ কোনো এজেন্ডা নিয়ে মাঠে নামে। একটা গ্রুপ মাঠে নেমেছে মুসলমানকে মোনাজাত, মিলাদ, রফে ইয়াদাইনে ব্যস্ত রাখবে। আলেমদের বড় চিন্তা করতে দেবে না। আমরা আলেমরাও কখনো কখনো ফাঁদে পা দিয়ে ফেলি। ফলে আজকের আলেমদের মধ্য থেকে, ওয়াজের মাঠ থেকে বড় চিন্তা আসে না। কিছু নিভৃতচারী আলেম যদিও বড় কাজ করতে চান আমজনতার কাছে তাদের কদর থাকে না। ফলে দীন ডোবানোর টার্গেট যারা নিয়েছে, আপাতত তারা সফল- এ সত্য স্বীকার না করাই হবে বড় বোকামি। আল্লাহ আমাদের বোঝার তৌফিক দিন।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি, পীর সাহেব, আউলিয়ানগর

সর্বশেষ খবর