বুধবার, ১১ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

আমরা কি আদতেই মানুষ হয়েছি

মহিউদ্দিন খান মোহন

আমরা কি আদতেই মানুষ হয়েছি

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পদার্পণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সদ্য স্বাধীন দেশের উদ্বেলিত নাগরিকদের কাছ থেকে যে সংবর্ধনা সেদিন তিনি পেয়েছিলেন, তা ছিল অভূতপূর্ব। যারা সেদিন উপস্থিত ছিলেন তাদের মুখে শুনেছি পুরো ঢাকা শহর যেন ভেঙে পড়েছিল তেজগাঁও বিমানবন্দরে। পুষ্পবৃষ্টিতে সিক্ত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু সেদিন। আমরা যারা গ্রামের মানুষ তারা সে আনন্দে শরিক হয়েছিলাম রেডিওতে ধারা বিবরণী শুনে। ৮ জানুয়ারি যখন খবর এলো, পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে নিঃশর্ত মুক্তি দিয়েছে, বাংলাদেশের মানুষ আনন্দে আত্মহারা হয়েছিল। তাদের মনের মধ্যে চেপে থাকা এতদিনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পাহাড় সরে গিয়েছিল মুহূর্তেই। দেশ স্বাধীন হলেও এর রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তানি কারাগারে বন্দি থাকায় বিজয়ের আনন্দ শতভাগ উপভোগ করতে পারছিল না জাতি। তাই যখন তাঁর মুক্তির খবর প্রচারিত হলো সারা দেশে আনন্দের প্লাবন বয়ে গেল। স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধুর পদার্পণের দিনটি জাতির ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। দিনটি ছিল শনিবার। আমাদের রেডিও সেটটি নিয়ে আমরা বসেছিলাম উঠোনে। একজন ধারাভাষ্যকার বর্ণনা করছিলেন, আমরা শিহরিত হচ্ছিলাম। এক সময় তিনি জানালেন, বিমানের দরজা খুলে গেছে, বঙ্গবন্ধু বেরিয়ে এসেছেন। সঙ্গে সঙ্গে তোপধ্বনির আওয়াজ ভেসে এলো ইথারে। সেই সঙ্গে পটকার শব্দ। আমরা কয়েকটি পটকা জোগাড় করে রেখেছিলাম আগেই। তা দিয়ে আনন্দে শরিক হলাম। কেউ আবার কেরোসিনের টিন বাজিয়ে নৃত্য করছিলাম। ধারাভাষ্যকার বললেন, এরপর বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে যাবেন সমবেত জনতার উদ্দেশে ভাষণ দিতে। সারাটা সময় রেডিওর ভাষ্যকার পথের দুই ধারে হর্ষোৎফুল্ল জনতা বঙ্গবন্ধুকে বরণ করে নেওয়ার বর্ণনা দিচ্ছিলেন।

কিছুক্ষণ পর জানানো হলো বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে নির্মিত মঞ্চে পৌঁছেছেন। একটু পর তাঁর ভাষণ শুরু হলো। তখন আর জনতার হর্ষধ্বনি শোনা যাচ্ছিল না। বঙ্গবন্ধুর জলদগম্ভীর কণ্ঠে ভেসে এলো- ‘ভাইয়েরা আমার...।’ দীর্ঘ ভাষণ দিয়েছিলেন তিনি। আবেগাপ্লুত বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণের একপর্যায়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন- ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ কর নি। কবিগুরুর কথা আজ মিথ্যা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে। বাঙালি আজ মানুষ। আমার বাঙালি আজ দেখিয়ে দিয়েছে। দুনিয়ার ইতিহাসে এত লোক আত্মাহুতি, এত লোক জান দেয় নাই। তাই আমি বলি, আমায় দাবায়া রাখতে পারবা না।’

সেদিন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষকে নিয়ে গর্বভরেই কথাগুলো বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর অন্তরে এ গর্বের অঙ্কুরোদগম এক দিনে হয়নি। দীর্ঘদিনের আন্দোলন-সংগ্রাম এবং নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে মুক্ত বাংলাদেশের মানুষ আক্ষরিক অর্থেই ‘মানুষ’ হয়ে উঠেছে, এ ধারণা তাঁর মনে বদ্ধমূল হয়েছিল; যেমন আগুনে পুড়ে খাঁটি হয় সোনা। তিনি গড়তে চেয়েছিলেন সোনার বাংলা। আর সে সোনার বাংলা গড়ার জন্য তাঁর দরকার ছিল সোনার মানুষ। বলেছিলেনও সে কথা একাধিকবার। আজ স্বাধীনতা এবং বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বায়ান্ন বছরে এসে যদি প্রশ্ন করা হয়, আমরা কি আদতেই বঙ্গবন্ধুর সেই ‘মানুষ’ হতে পেরেছি? এ প্রশ্নের সরাসরি জবাব কেউ দিতে পারবেন বলে মনে হয় না। কেননা, এ অর্ধশতাব্দীর ঘটনা পরিক্রমায় যা দেখেছি, যা উপলব্ধি করেছি এবং যা দেখছি তাতে আমরা সর্বাংশে ‘মানুষ’ হয়েছি- এ দাবি করা যাবে না। বঙ্গবন্ধুর সেই কাক্সিক্ষত মানুষ যে আমরা হতে পারিনি সে কথা কি অস্বীকার করা যাবে? তিনি ভেবেছিলেন আন্দোলন-সংগ্রাম আর সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে জাতি তাদের মাতৃভূমির স্বাধীনতা এনেছে, সে জাতি আর কখনো দর্নীতি, রিলিফ আত্মসাৎ, অর্থ পাচার, কালোবাজারির মতো দুষ্কর্মে লিপ্ত হবে না। তারা সৎ নাগরিক হিসেবে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখবে। কিন্তু অল্পদিনেই সেই ভুল ভেঙেছিল বঙ্গবন্ধুর। তাই মাত্র এক বছরের মাথায় তাঁকে আমরা হতাশা ব্যক্ত করতে দেখেছি-‘সবাই পায় সোনার খনি, আর আমি পাইছি চোরের খনি’ বলে। তিনি এতটাই হতাশ হয়েছিলেন যে, আক্ষেপ করে বলেছিলেন- ‘পাকিস্তানিরা আমার দেশের সব সম্পদ নিয়া গেছে। রাইখা গেছে কতগুলি চোর। এইগুলারে নিয়া গেলে বাঁচতাম।’ কতটা হতাশ ও ক্ষুব্ধ হলে একটি স্বাধীন দেশ ও নতুন জাতির জন্মদাতা সে দেশের মানুষ সম্পর্কে এমন উক্তি করতে পারেন, তা অনুধাবন করতে পণ্ডিত হওয়ার দরকার পড়ে না। সম্ভবত ১৯৭৪ সালে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে ক্যাডেটদের পাসিং আউট অনুষ্ঠানে তাঁর দেওয়া ভাষণের অংশবিশেষ এখনো সামাজিক মাধ্যমে ঘুরছে। সেদিন তিনি তাঁর ভাষণে বলেছিলেন- ‘মনে রেখো, শাসন করা তারই সাজে, সোহাগ করে যে। তুমি যখন শাসন করবা সোহাগ করতে শেখো। তাদের দুঃখের দিনে পাশে দাঁড়িও। তাদের ভালোবেসো। কারণ তোমার হুকুমে সে জীবন দেবে। তোমাকে শ্রদ্ধা অর্জন করতে হবে। সে শ্রদ্ধা অর্জন করতে হলে তোমাকে শৃঙ্খলা শিখতে হবে। নিজেকে সৎ হতে হবে। নিজের দেশকে ভালোবাসতে হবে। মানুষকে ভালোবাসতে হবে। তা না হলে কোনো ভালো কাজ করা যায় না। আমার মুখ কালা করো না, দেশের মুখ কালা করো না। সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুখ কালা করো না। তোমরা আদর্শবান হও। সৎ পথে থেকো। মনে রেখো, মুখে হাসি মনে বল, তেজে ভরা মন, মানুষ হইতে হবে মানুষ যখন। মাঝে মাঝে আমরা অমানুষ হয়ে যাই। এত রক্ত দেওয়ার পর যে স্বাধীনতা এনেছি, চরিত্রের এখনো অনেকের পরিবর্তন হয় নাই। এখনো ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, চোরাকারবারি, মুনাফাখোরি, বাংলার দুঃখী মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলছে। দীর্ঘ তিন বছর পর্যন্ত এদের আমি অনুরোধ করেছি, আবেদন করেছি, হুমকি দিয়েছি। কিন্তু চোরায় না শোনে ধর্মের কাহিনী’।

বঙ্গবন্ধু আজ নেই। তাঁর কথাগুলো রয়ে গেছে। যে হতাশা থেকে তিনি সেদিন কথাগুলো বলেছিলেন, আজ বাংলাদেশের পরিস্থিতি কি তার চেয়ে ভিন্ন? যে দুর্নীতি-অপরাধের বিরুদ্ধে সেদিন তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন তা কি এতটুকু হ্রাস পেয়েছে? উত্তর ব্যাখ্যা করে বলার দরকার পড়ে না। আমরা মানুষ হইনি বলেই আজও পত্রিকায় রাষ্ট্রীয় অর্থ-সম্পদের যথেচ্ছ তছরুপ-লুটপাটের খবর ফলাও করে ছাপা হয়। আজও সন্ত্রাসীদের হাতে নিভে যায় নিরীহ মানুষের জীবন-প্রদীপ। আজও দুর্র্বৃত্তের হাতে লাঞ্ছিত নারীর আর্তনাদে ভারি হয়ে ওঠে এদেশের বাতাস। আর দুর্নীতি আমাদের জাতীয় জীবনকে রাহুর মতো গ্রাস করেছে। বঙ্গবন্ধু তাঁর আরেক ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমার কৃষক চুরি করে না, আমার শ্রমিক চুরি করে না। চুরি করে ফাইভ পার্সেন্ট শিক্ষিত মানুষ’। এরচেয়ে কঠিন সত্য আর কী হতে পারে! আজ দেশে যেসব দুর্নীতি, অর্থ পাচার, ব্যাংক লোপাট, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়মের ঘটনা ঘটছে এসব কারা করছে? ওই ফাইভ পার্সেন্ট লোক, যার সংখ্যা আরও বেড়েছে। এরা দেশের অর্থনীতিকে ফোকলা করে দিচ্ছে, জনগণের সম্পদকে খাবলে খাচ্ছে। কোনো প্রতিকার নেই। থাকবে কী করে? যে সর্ষে দিয়ে ভূত তাড়ানো হবে সে সর্ষেতেই বাসা বেঁধে আছে ভূত। প্রতিটি সরকারি অফিস-আদালতে আজ দুর্নীতির মহোৎসব চলছে। আপনি যদি আপনার বাড়ি-জমির দলিল রেজিস্ট্রি কিংবা নামজারি করতে যান সেখানে দেখবেন দুর্নীতির উৎকট চিত্র। টাকা দিলে সব জায়েজ, না দিলে আপনাকে হতে হবে নাজেহাল। যাবেন বিদ্যুৎ অফিসে সেখানেও দুর্নীতির রাক্ষস ওত পেতে বসে আছে। থানা-পুলিশের কথা না বলাই শ্রেয়। ‘পুলিশ ঘুষ খায়’ এটা তো আমাদের দেশে এখন ‘চিরন্তন সত্য’ হিসেবেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। পুলিশ হোক কিংবা বিদ্যুৎ-গ্যাসের মিটার রিডার, চাকরি পাওয়ার দুই-চার বছরের মধ্যেই বনে যায় বাড়ি-গাড়ির মালিক। কীভাবে? ওদের হাতে কি আলাদিনের চেরাগ আছে? সম্ভবত আছে। সে চেরাগের নাম দুর্নীতি। যাতে ঘঁষা দিলেই কেল্লা ফতে। মাঝেমধ্যে শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক সরকারি কর্মকর্তা, কেরানি-পিয়ন, ড্রাইভারের কাহিনি সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে। আমরা বিস্ময়ে হতবাক হই। কিছুদিন হইচই হয়, তারপর সব সুনসান। এক সময় শত কাজের ব্যস্ততায় আমরাও ভুলে যাই সেসব সাগর চুরির ঘটনা। অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো দুর্নীতি-অবক্ষয়ের রাহুগ্রাসে পড়েছে আমাদের রাজনীতিও। নীতিহীন কিছু মানুষ এ অঙ্গনে প্রবেশ করে কলুষিত করে তুলেছে এর পরিবেশ। যে রাজনীতি ছিল দেশপ্রেমের পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের কর্মক্ষেত্র, সেখানে আজ দুর্নীতিবাজ, দেশপ্রেম এবং নীতি-নৈতিকতাহীন স্বার্থান্ধ কতিপয় মানুষের দোর্দণ্ড প্রতাপ। তাদের প্রচণ্ড দাপটে নিষ্ঠাবান রাজনীতিকরা আজ কোণঠাসা। কেউ কেউ ‘আলবিদা রাজনীতি’ বলে মান-ইজ্জত নিয়ে সরে পড়েছেন। রাজনৈতিক দল এখন কমিটি আর পদ-বাণিজ্যের রমরমা প্ল্যাটফরম। মনোনয়ন-বাণিজ্য তো স্বীকৃত পদ্ধতিতে রূপ লাভ করেছে। এখন রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন কিংবা পদ পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা এবং জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতার কোনো মূল্য নেই। যার কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আছে আর সেই টাকার সুবাদে তৈরি করে নিয়েছে কিছু মোসাহেব-মস্তান, রাজনীতিতে তারই এখন কদর বেশি। সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন পর্যন্ত দলীয় মনোনয়নের ক্ষেত্রে টাকার খেলা চলে খোলামেলা। ফলে রাজনীতির মাঠে-ময়দানে এখন সাচ্চা দেশপ্রেমিকের বড় আকাল। রাজনীতি ছিল এক সময় সমাজে সবচেয়ে মর্যাদাকর কর্মকাণ্ড। রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের মানুষ সম্মানের চোখে দেখত, সমীহ করত। এখন আর সেভাবে দেখে না। দেখবে কী করে? যে লোকটিকে তারা দেখেছে দুর্নীতি কিংবা অপরাধের জন্য হ্যান্ডকাফ পরে থানায় যেতে, কিছুদিন পর তাকেই দেখা যায় রাজনীতির মঞ্চে সম্মানীয় (?) অতিথির আসনে। ফলে রাজনীতিকদের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ কমতে কমতে এখন নিঃশেষ হওয়ার পথে। অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। দীর্ঘ দুই যুগ আমরা পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছি। আমরা কখনই ভাবিনি স্বাধীন বাংলাদেশে সেসব অনাচার আবার পত্রপল্লবে বিকশিত হবে। আমরা ভেবেছি আমাদের এ প্রিয় স্বদেশভূমি হবে দুর্নীতি-অনাচারমুক্ত একটি সমৃদ্ধ দেশ। বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের সে প্রত্যাশা হতাশার চোরাবালিতে হারিয়ে গেছে।

১৯৭৩ সালে মুক্তি পেয়েছিল বরেণ্য চলচ্চিত্র পরিচালক খান আতাউর রহমানের ‘আবার তোরা মানুষ হ’ ছবিটি। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের উচ্ছৃঙ্খল যুব সমাজের প্রতি সুপথে ফিরে আসার আহ্বান ছিল ছবিটির মূল উপজীব্য। কিন্তু আমরা সুপথে আসিনি। হতে পারিনি বঙ্গবন্ধুর গর্বের ‘মানুষ’। এ ব্যর্থতার দায় আমাদের সবার।

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক

সর্বশেষ খবর