বুধবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি হত্যা

অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান

যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি হত্যা

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যামব্রিজ শহরে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি শিক্ষার্থী সৈয়দ ফয়সাল আরিফের মৃত্যুর প্রতিবাদে সেখানে প্রবাসীদের বিক্ষোভ এবং প্রতিবাদ চলছে। পুলিশের ভাষ্যমতে, ৪ জানুয়ারি চেস্টনাট স্ট্রিটে ফয়সাল নিজের গলায় ছুরি তাক করে ছুটছিলেন। পুলিশ প্রথমে তাকে ছুরিটি ফেলে দিতে আহ্বান জানালে তিনি তা শোনেননি। তাকে নিবৃত্ত করতে পুলিশ প্রথমে এক রাউন্ড স্পঞ্জ গুলি ছোড়ে। তাতেও ফয়সাল নিরস্ত্র না হয়ে ছুরি হাতে পুলিশের দিকে এগিয়ে আসছিলেন। তখন একজন পুলিশ তাকে পাঁচ রাউন্ড গুলি ছোড়ে। গুরুতর আহত ফয়সালকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যামব্রিজ শহরে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি শিক্ষার্থী সৈয়দ ফয়সাল আরিফের মৃত্যুর প্রতিবাদে সেখানকার প্রবাসীরা বিক্ষোভ এবং প্রতিবাদ জানিয়েছেন। ৯ জানুয়ারি ঢাকাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে বিচারের দাবিতে মানববন্ধন হয়েছে। বিশ্বব্যাপী মানবাধিকারের কথা বলে নিজ দেশে মানবাধিকার নেই কেন, সে প্রশ্ন ওঠে মানববন্ধন থেকে। মানবাধিকার নিয়ে রাজনীতি না করার কথাও বলেন বক্তারা। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি।

আত্মরক্ষা বা ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষার অধিকার প্রত্যেকটি মানুষের জন্মগত অধিকার। সব দেশের আইনে এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ঘোষণাপত্র দ্বারা এটি স্বীকৃত। কিন্তু কারোর আত্মরক্ষার জন্য কোন পরিস্থিতিতে কতটুকু আঘাত অথবা শক্তি প্রয়োগ করতে হবে, সেটিও আইনসিদ্ধ বিধান। এই অধিকার আত্মরক্ষার জন্য যতটুকু প্রয়োজন কোনো অবস্থাতেই তার অতিরিক্ত প্রয়োগ করা যাবে না। চুরি ঠেকাতে গিয়ে চোরকে খুন করা যায় না।

ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব রেডক্রস প্রদত্ত ইন্টারন্যাশনাল রুলস অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ড অব পুলিশ অনুযায়ী, মারণাস্ত্র ব্যবহারে নির্দিষ্ট কতগুলো শর্ত দেওয়া আছে। তার মধ্যে প্রধান শর্ত হলো, মারণাস্ত্র ব্যবহারে মৃত্যুর শঙ্কা থাকায় এটির ব্যবহার তখনই প্রযোজ্য হবে যখন আক্রমণকারী ব্যক্তির ওই মুহূর্তের গতিবিধির কারণে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের জন্য মৃত্যুঝুঁকি থাকে এবং গুরুতর আঘাত বা মৃত্যু এড়ানোর জন্য সর্বশেষ উপায় হিসেবে মারণাস্ত্র ব্যবহার করা যাবে। দ্বিতীয়ত, মারণাস্ত্র ব্যবহারের আগে সতর্কতা সংকেত দিতে হবে এবং আক্রমণকারী ব্যক্তিকে সেই সতর্কতা সংকেত শুনে সাবধানী প্রতিক্রিয়া প্রদর্শনের জন্য যথেষ্ট সময় দিতে হবে। তাছাড়া যে কোনো পরিস্থিতিতে মারণাস্ত্র ব্যবহারে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের স্বচ্ছ জবাবদিহিতার ব্যবস্থা থাকতে হবে। জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের মারণাস্ত্র ব্যবহারবিষয়ক সর্বোচ্চ শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি সবচেয়ে বিপজ্জনক ও কঠিন পরিস্থিতিতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার মতো সক্ষমতা থাকতে হবে। সর্বোপরি আইনশৃঙ্খলা রক্ষা অথবা মৃত্যুঝুঁকি এড়ানোর জন্য শর্তসাপেক্ষে মারণাস্ত্র প্রয়োগ করার বিধান থাকলেও, সব ধরনের পূর্ব সতর্কতা অবলম্বন করে জীবনের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ফয়সাল আরিফকে যখন পুলিশ গুলি করে, সে সময় কোনো প্রত্যক্ষদর্শী ছিল না। এ ঘটনার বিস্তারিত এবং ওই মুহূর্তে ফয়সালের গতিবিধি সম্পর্কে যা কিছু জানা গেছে, সম্পূর্ণটাই পুলিশের ভাষ্য। কিন্তু স্থানীয় একটি টিভিতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ওই এলাকার বাসিন্দা এক নারী নিজেকে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী দাবি করে বলেছেন, ফয়সালের হাতে কোনো ছুরি তিনি দেখেননি। সুতরাং পুলিশ ‘আত্মরক্ষার্থে’ ফয়সালকে গুলি করার সময় মারণাস্ত্র ব্যবহারের সব শর্ত যথাযথভাবে অনুসরণ করেছে কি না, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। ফয়সাল নিজেকে ছুরি দিয়ে আঘাত করতে উদ্যত ছিলেন, যেটি দেখে আত্মহত্যার চেষ্টা বলে প্রতীয়মান হচ্ছিল। ফয়সালকে নিরস্ত্র হওয়ার জন্য হুঁশিয়ারি দেওয়া এবং তাকে যথাযথ সময় দেওয়া হয়েছে কি না, এসব বিষয়ে প্রশ্ন রয়ে যায়। হত্যাকান্ডের বিষয়ে ৫ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলনে মিডলসেক্স ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি ম্যারিয়েন রায়ান বলেন, ৪ জানুয়ারি স্থানীয় সময় দুপুর ১টা ১৫ মিনিটের দিকে ক্যামব্রিজ পোর্টের এক বাসিন্দা ৯১১-তে ফোন করে পুলিশের জরুরি বিভাগকে জানান যে, গায়ে শার্ট নেই- এমন এক তরুণ ঘরের জানালা দিয়ে লাফিয়ে রাস্তায় নেমেছেন এবং হাতে বড় ধরনের একটি ছুরি রয়েছে। তরুণটি নিজেকে ছুরিকাঘাতে আহত করার চেষ্টা করছেন। এ তথ্য জেনেই ডজনখানেক পুলিশ অফিসার ঘটনাস্থলে যান এবং তাকে বিরত থাকার আহ্বান জানান। কিন্তু তিনি পুলিশের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে চেস্টনাট স্ট্রিট দিয়ে দৌড়াতে থাকেন। সে সময়ও তার হাতের ছুরিটি গলার দিকে তাক করা ছিল বলে তদন্তকারীদের বরাত দিয়ে ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি উল্লেখ করেন। পুলিশ তার পিছু নিলে এক পর্যায়ে তিনি ছোরা উঁচিয়ে পুলিশের দিকে তেড়ে যান। ‘আত্মরক্ষার্থে’ তখন পুলিশ সদস্যরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। ক্যামব্রিজ পুলিশ কমিশনার ক্রিস্টিন ইলো এ ঘটনার সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান। ইতোমধ্যেই সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানোর কথাও জানান পুলিশ কমিশনার।

এর আগেও যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী বাংলাদেশি হত্যার শিকার হয়েছে। গত জুন, ২০২২-এ যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টায় বন্দুকধারীদের গুলিতে আবু সালেহ মোহাম্মদ মাহফুজ আহমদ নামে আরেক বাংলাদেশি নিহত হন। তিনি সেখানকার গ্রিনকার্ডধারী ছিলেন। প্রায় ১০ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে যান আবু সালেহ মোহাম্মদ মাহফুজ। পরবর্তীতে আটলান্টা শহরে নিজে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু করেন। ১৬ জুন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বন্দুকধারীরা তাকে তার দোকানের সামনে হত্যা করে।

যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে সদা উচ্চকণ্ঠ। ২০২০ সালে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু যুক্তরাষ্ট্রে সংখ্যালঘু কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পুলিশের নৃশংসতাকে আবার সামনে এনেছিল। ওয়াশিংটন পোস্ট সংবাদপত্রের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে আমেরিকায় পুলিশের গুলিতে মারা গেছে ১,০১৪ জন এবং বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, আমেরিকায় পুলিশের গুলিতে নিহতদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে বেশির ভাগই কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান। দেশটিতে পুলিশি নির্মমতার প্রতিক্রিয়ার ফলশ্রুতিতে গড়ে উঠেছে হ্যাশট্যাগ #BlackLivesMatter  (কৃষ্ণাঙ্গদের জীবনও মূল্যবান) নামের আন্দোলন।

আসুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আইন প্রয়োগকারী কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের দিকে একটু নজর দেওয়া যাক। টার্কিশ মিডিয়া আউটলেট (টিআরটি ওয়ার্ল্ড) এর প্রতিবেদন অনুসারে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দ্বারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শীর্ষে অবস্থান করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ১ জুন, ২০২০-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সাত বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের গুলিতে মোট ৭,৬৬৬ জন মানুষ নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ২০১৮ সালে পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর সংখ্যা সর্বোচ্চ ১,১৪৩ জন। ২০১৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত, প্রতি বছর গড়ে ১,১০০ মানুষ নিহত হয়েছেন। একই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৩ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ পুলিশের গুলিতে নিহত বা আহত হয়েছেন, শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় যা অন্তত তিন গুণ বেশি।

ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত ২০১৯ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টানা চার বছর ধরে পুলিশের গুলিতে নিহতের সংখ্যা ১ হাজারের কাছাকাছি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে পুলিশের গুলিতে ৯৯৬ জন নিহত হয়েছেন, যেখানে ২০১৭ সালে এ সংখ্যা ছিল ৯৮৭ জন, ২০১৬ সালে ৯৬৩ জন এবং ২০১৫ সালে ৯৯৫ জন।

‘ম্যাপিং পুলিশ ভায়োলেন্স’ এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে দেশটির ১ হাজার ১৭৬ জন নিহত হয়েছেন। ২০১৩ সালের পর থেকে যে কোনো বছরের তুলনায় এ সংখ্যা সর্বোচ্চ। ২০২১ সালের তুলনায় পুলিশের হাতে দেশটিতে নিহতের সংখ্যা ২০২২ সালে ৩৬ জন বেশি। এ সময় দেশটির পুলিশের হাতে নিহতদের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ রয়েছেন ২৮৭ জন। পুলিশের হাতে নিহত হওয়া মানুষের মোট সংখ্যার এটি ২৪ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের পরিসংখ্যান তথ্য বলছে, দেশটিতে কৃষ্ণাঙ্গ রয়েছে ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ। এই কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে ৯৬ শতাংশই নিহত হয়েছেন পুলিশের গুলিতে। মানবাধিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৯৮ দশমিক ৮ শতাংশ মামলায় যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডসহ বিভিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘনের অজুহাতে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রায়ই অভিযোগ আনে মানবাধিকারের যুক্তরাষ্ট্র।

মানবাধিকার একটি সর্বজনীন বিষয়। যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশ কিংবা পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রেই যেন মানবাধিকার লঙ্ঘিত না হয়, সেটিই আমাদের কাম্য। যুক্তরাষ্ট্র যখন অন্যান্য রাষ্ট্রের মানবাধিকার লঙ্ঘন সংক্রান্ত সব বিষয়ে সোচ্চার, সাম্প্রতিক ঘটনার প্রেক্ষাপটে বলা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত এখন নিজেদের রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর দিকে সতর্ক দৃষ্টিপাত করা।

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান তার পরিচয়পত্র পেশ করতে গেলে ওয়াশিংটনে তাকে স্বাগত জানিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করতে তারা আগ্রহী। মার্কিন প্রশাসন দুই দেশের সম্পর্ককে আরও গভীর করতে কাজ করে যাবে। আমরা আশা করি, মার্কিন য্ক্তুরাষ্ট্র সব নাগরিক এবং বাংলাদেশসহ সব প্রবাসীর মানবাধিকার সমুন্নত রাখার জন্য আরও দায়িত্বশীল, ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ করবে এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ককে আরও মজবুত করবে।

            লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন

সর্বশেষ খবর