বুধবার, ২২ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

ক্রমাগত অঘটনে প্রশ্নবিদ্ধ জননিরাপত্তা

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

ক্রমাগত অঘটনে প্রশ্নবিদ্ধ জননিরাপত্তা

১১ মার্চ ২০২৩ তারিখে সাত দেশের মন্ত্রী, ১২টি বহুজাতিক কোম্পানির প্রধান নির্বাহী, ১৭ দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী এবং দুই শতাধিক বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণে আকর্ষণীয় বাণিজ্য সম্মেলন শুরু হয় দেশের রাজধানী ঢাকায়। এ গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনের খবর দেখার আশায় টেলিভিশন চালু করা মাত্র ভেসে উঠল চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে অবস্থিত ছোট কুমিরা নামক স্থানে ইউনিটেক্স স্পিনিং মিলের তুলার গুদামে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে টানা ১০ ঘণ্টা ধরে আগুন জ্বলার দৃশ্য। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের আটটি ইউনিট আপ্রাণ চেষ্টা করেও আগুন নেভাতে না পারায় স্থানীয় সেনা সদস্যরা সেই আগুন নেভাতে যোগ দিয়েছে। এ স্পিনিং মিলের একটু দূরেই অবস্থিত সীমা অক্সিজেন প্লান্টে মাত্র এক সপ্তাহ আগে সংঘটিত ব্যাপক বিস্ফোরণ ও অগ্নিকান্ডে সাতজনের মৃত্যু ঘটে। অন্যদিকে চার দিন আগে রাজধানী ঢাকার সিদ্দিকবাজার বিস্ফোরণে নতুন একজনসহ ২৩ জনের মৃত্যুর খবর প্রচারিত হচ্ছিল সব টেলিভিশনে। এরই মাঝে তাৎক্ষণিক খবর (ব্রেকিং নিউজ) এলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের দোকানে আগুন দিয়েছে ছাত্ররা। প্রায় ৫০টি দোকান পুড়ে ছাই। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয়দের সঙ্গে বিরোধ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, বৃষ্টির মতো ইট নিক্ষেপ, দোকান ভাঙচুর, দোকানে অগ্নিসংযোগ, রাস্তা অবরোধ, শতাধিক হতাহত, পুলিশের অসহায়ত্ব ইত্যাদি দৃশ্য বারবার সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছিল প্রায় ২৪টি টেলিভিশনের পর্দায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো ধরনের রাখঢাক না রেখে চারদিকের এসব মৃত্যু এবং অগ্নিকান্ডের বীভৎস দৃশ্য তুলে ধরার যেন প্রতিযোগিতা চলছিল। বাণিজ্য সম্মেলন উপলক্ষে ঢাকায় জড়ো হওয়া শতাধিক দেশের প্রতিনিধি ও বিদেশের গণমাধ্যমকর্মীরা হোটেলে বসে এসব দৃশ্য দেখে থাকবেন এটাই স্বাভাবিক।

পরদিন ১২ মে রবিবার সকালে বেশ কিছু ইংরেজি সংবাদপত্র এবং ইংরেজি অনলাইন নিউজ পোর্টালে চোখ রাখলাম বাণিজ্য সম্মেলনে যোগ দেওয়া বিনিয়োগকারীদের লক্ষ্য করে। স্থানীয় শীর্ষ ইংরেজি দৈনিকে মূল সংবাদের শিরোনামের অর্থ বাংলাদেশ আপনাদের স্বাগত জানাতে সর্বদা প্রস্তুত। অথচ তার পাশেই রাজশাহীতে ৫০টি দোকানে আগুনের ছবি আর ২২০ জন হতাহতের খবর। অপর ইংরেজি দৈনিক লিখেছে- জামায়াত-শিবির দেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্টে চক্রান্ত করছে। একই দৈনিকের শিরোনাম ‘আরেকটি এক-এগারোর সম্ভাবনা কি বাড়ছে?’। সীতাকুন্ডে অগ্নিকান্ডের খবরের পাশাপাশি একটি ইংরেজি দৈনিকের মূল সংবাদের মর্মকথা হলো- সরকার নির্দেশনা জারি তথা গেজেট প্রকাশ করলেও সেই নির্দেশনা মাঠ পর্যায়ে মানা হচ্ছে না। মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সেবা খাতের মাসিক বিল মওকুফের বিষয়ে এ সংবাদ পরিবেশিত হয়, যা সরকার চাইলেও যে অনেক কিছু সরেজমিনে বাস্তবায়ন করতে পারে না তাই জানান দিল এ সংবাদ। দুই দলের কাদা ছোড়াছুড়ির খবরের পাশে গুলিস্তানে বিস্ফোরণে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ২৩ হওয়ার খবর ছিল একটি ইংরেজি সংবাদপত্রে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে গনগনে আগুনে দোকান পোড়ার ছবি, ২০০ ছাত্র-জনতা হতাহত, মৌলভীবাজারে বিরোধী দলের ওপর সরকারি দলের হামলার ছবি ও ৩৫ জন হতাহতের খবর ছিল জনপ্রিয় আরেক ইংরেজি দৈনিকের প্রথম পাতাজুড়ে। সীতাকুন্ডে তুলার গুদামে দীর্ঘ সময় ধরে জ্বলতে থাকা আগুনের ছবি ও আগুন নেভাতে সেনা মোতায়েনের খবর ছিল আরও কিছু ইংরেজি দৈনিকের শিরোনাম। এভাবে একদিকে যখন বিনিয়োগ সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনের প্রস্তুতি চলছিল ঠিক তখনই সকাল বেলা গরম চায়ের পেয়ালা হাতে যে বিদেশি অতিথি ও বিনিয়োগকারীরা হোটেলে বসে ইংরেজি সংবাদপত্রগুলো পড়ছিলেন তারা এসব খবরই দেখতে পেয়েছেন। ১২ মার্চ রবিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে আরও পুড়েছে নারায়ণগঞ্জ শহরের মাসদাইর কবরস্থান এলাকায় খন্দকার ম্যানসন নামের একটি ১০ তলা ভবনের ষষ্ঠ তলার এক ফ্ল্যাট। রান্নাঘরে জমে থাকা গ্যাস থেকে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এ অগ্নিকান্ডের ২০ দিন আগে গুলশান-২ নম্বরের ১০৪ নম্বর রোডের ১২ তলা ভবনের সপ্তম তলায় আগুনের সূত্রপাত হয়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে এবং আগুনের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় ১৯টি ইউনিট রাত ১১টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে ২৬ ফেব্রুয়ারি রবিবার বিকাল ৪টা ৪০ মিনিটে। এ অগ্নিকান্ডের দুই সপ্তাহ পর (১৩ মার্চ) তেজগাঁওয়ের কুনিপাড়ার রোলিং মিল বস্তিতে লাগা আগুন জ্বলে সোয়া দুই ঘণ্টা। দেশের বিভিন্ন বনাঞ্চলে আগুন লাগিয়ে গাছ ধ্বংস ও জমি দখলের খবর প্রকাশিত হয় ইদানীং। ২৩ ফেব্রুয়ারি শর্টসার্কিট থেকে সিলেট পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। রাত ৮টার দিকে নগরের বন্দরবাজার এলাকায় পুলিশ সুপার কার্যালয়ের চতুর্থ তলার সম্মেলন কক্ষে এ ঘটনা ঘটে।

৬ মার্চ সন্ধ্যা ৭টার দিকে খুলনার রূপসা নদীর তীরে অবস্থিত বন্ধ থাকা দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরিতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। ম্যাচ ফ্যাক্টরির পরিত্যক্ত সালফার (ম্যাচে ব্যবহৃত বারুদ) গোডাউনে এ আগুন লাগে এবং আগুনের কারণে সৃষ্ট ধোঁয়ায় নগরীর লবণচরা, রূপসা, টুটপাড়া, দোলখোলা, সাউথ সেন্ট্রাল রোড, হাজী মুহসীন রোড, ডাকবাংলো মোড়সহ প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। তথ্যমতে অগ্নিকান্ডের সঙ্গে সঙ্গে আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে যায় এবং তিন থেকে পাঁচ কিলোমিটার এলাকার অনেকে বিষাক্ত ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। ফ্যাক্টরির ভিতরের পরিত্যক্ত একটি কক্ষের কেমিক্যাল থেকে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হয়। ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মো. নজরুল ইসলাম বলেন, দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরির একটি কক্ষে ম্যাচ তৈরির বারুদ, রেড ফসফরাস, ব্ল্যাক ফসফরাস সালফার, কার্বন সংরক্ষিত ছিল। সেখান থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। খবর পেয়ে টুটপাড়া ও বয়রা ফায়ার সার্ভিসের চারটি ইউনিট প্রায় ১ ঘণ্টা চেষ্টা করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ১৯৫৬ সালে গেওয়া কাঠের ওপর নির্ভর করে খুলনার রূপসা নদীর তীরে ১৮ একর জমির ওপর দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরির যাত্রা শুরু হয়। মিলটির মালিকানা ছিল পাকিস্তানি মালিকানাধীন দাদা গ্রুপ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে মিলটি জাতীয়করণ করে চালু করে সরকার। ১৯৯৩ সালে ভাইয়া গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ এ মিলের ৭০ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়। কিন্তু লোকসানের কারণে ২০১০ সালে উৎপাদন বন্ধ করে দেয় তারা। ২০১১ সালে সরকারি তত্ত্বাবধানে কারখানার মালামাল বুঝে নেওয়া হয়। সেই সময় থেকে মালামাল সংরক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয় জেলা প্রশাসনকে। পঞ্চগড়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের (কাদিয়ানি) সালানা জলসা বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করার সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। জুমার নামাজ শেষে ৩ মার্চ শুক্রবার বেলা ২টার পর পঞ্চগড় শহরের প্রাণকেন্দ্র চৌরঙ্গী মোড়ে এ সংঘর্ষ হয়। পরে ১০টি বাড়িঘর ও চারটি দোকানে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ট্রাফিক পুলিশের একটি কার্যালয়। এ ঘটনায় তিন পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন। সংঘর্ষ চলাকালে পঞ্চগড় শহরের পাশে আহম্মদনগর এলাকায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের লোকজনের ১০টি বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়েছে। পঞ্চগড় শহরের একটি বাজারের চারটি দোকানের মাল বের করে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

৫ মার্চ রবিবার বেলা পৌনে ১১টার দিকে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় অবস্থিত শিরিন ভবনে বিকট শব্দে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় তিন দোকান কর্মচারী নিহত ও ১৫ জন আহত হয়। বিস্ফোরণের ফলে শিরিন ভবনের নিকটস্থ অন্যান্য ভবনও কেঁপে ওঠে। ভূমিকম্প সন্দেহে অন্যান্য ভবনের লোকজন নিচে নেমে আসেন। বিস্ফোরণের পরই শিরিন ভবনে আগুন ধরে যায়। ১০টা ৫৫ মিনিটে খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। ফায়ার সার্ভিসের চারটি ইউনিট মিলে ১৮ মিনিটের মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে এনে উদ্ধার কাজ শুরু করে। প্রথমদিকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ (এসি) যন্ত্র বিস্ফোরিত হয়েছে ধারণা করে খবর ছড়িয়ে পড়ে। পরে পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে জমে থাকা গ্যাস থেকে বিস্ফোরণ হয়েছে বলে জানায়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সেখানে কোনো বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহারের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি বলে মন্তব্য করেন। তিন তলা ভবনে বিস্ফোরণে দেয়ালের ইট, দরজা, জানালা ও আসবাব ছিন্নভিন্ন হয়ে রাস্তায় এসে পড়ে এবং দেয়াল ধসে যায়। ভবনের ভিতর থেকে নিহত তিনজনের দেহ এবং আহত আরও ১৫ জনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়।

কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার বালুখালীতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভয়াবহ আগুন লেগেছে ৫ মার্চ রবিবার বিকাল পৌনে ৩টার দিকে। আগুনে দুই হাজারের বেশি ঘরবাড়ি ও কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুড়ে গেছে। ১১ নম্বর ক্যাম্প থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। পরে তা দ্রুত ১০ ও ১২ নম্বর ক্যাম্পে ছড়িয়ে পড়ে। এতে আতঙ্কে ঘরবাড়ি ছেড়ে ক্যাম্প থেকে পালাতে থাকেন রোহিঙ্গারা। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের ১০টি ইউনিট ঘটনাস্থলে যায় এবং বিকাল সোয়া ৫টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুনের ঘটনা ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে পরিকল্পিত ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত নাশকতা’ বলে প্রমাণ পেয়েছে সরকারি তদন্ত কমিটি। প্রাপ্ত তথ্যমতে রোহিঙ্গারা আগুন নেভাতে গেলে তাদের কৌশলে নিষেধ করা হয় এবং আগুন নেভানোর চেয়ে জীবন বাঁচানো জরুরি বলে প্রচার করা হয়। ১৭ মার্চ শুক্রবার জাতির পিতার জন্মদিনে সাভারের ভাকুর্তা ইউনিয়নের লুটেরচর এলাকায় একটি প্লাস্টিক গোডাউনে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। ওই এলাকায় বাউন্ডারি দিয়ে ঘেরা একটি গোডাউনে পুরনো প্লাস্টিকের বোতল সংরক্ষণ করে সেগুলো প্রক্রিয়াজাত করত। সেখানে অগ্নিকান্ডের খবর পেয়ে দুপুর দেড়টার দিকে সাভার ট্যানারি ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। কিন্তু আগুনের তীব্রতা বেশি হওয়ায় মোহাম্মদপুর ফায়ার সার্ভিসের আরও তিনটি ইউনিটসহ কেরানীগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। মোট সাতটি ইউনিটের দেড় ঘণ্টা চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।

প্রিয় পাঠক আসুন এ স্বাধীনতার মাসে বহু ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির মানচিত্রটা মনে মনে ভাবী। সম্ভব হলে মানচিত্রটা সামনে রাখি। এবার আগুন লাগা ও বিস্ফোরণ ঘটা স্থানগুলো চিহ্নিত করি। দেখব আগুন জ্বলেছে পুবের সিলেটে, পশ্চিমের রাজশাহীতে, উত্তরের পঞ্চগড়ে এবং দক্ষিণের কক্সবাজারে ও খুলনায়। বিস্ফোরণে প্রকম্পিত হয়েছে মধ্যাঞ্চল তথা রাজধানী ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। অর্থাৎ ২৫ দিনের মধ্যে বিশেষত বিনিয়োগ সম্মেলন চলাকালে এবং এর আগে বাংলাদেশের সর্বত্র আগুন ও বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে ক্রমাগত সংবাদ প্রচারিত হয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে এসব কিছুকে নিছক দুর্ঘটনা, বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা কাকতালীয় ঘটনা বলা যেতেই পারে। তবে জনগণের সুরক্ষা ও জাতীয় নিরাপত্তার কষ্টিপাথরে যাচাই করলে এসব ঘটনাকে হালকাভাবে নেওয়ার কোনোই সুযোগ নেই। কারণ প্রতিটি কল্যাণকামী রাষ্ট্রের প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো- রাষ্ট্রীয় ভূখন্ডে বসবাসকারী সব মানুষ, এমনকি লোকালয়ের পশু-পাখি কিংবা জঙ্গলের জীবজন্তুরও জীবনের নিরাপত্তা বিধান।

অথচ আজ পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায় দেশের বিভিন্ন স্থাপনা বিশেষত খোদ রাজধানী যেন অব্যবস্থাপনাজনিত কারণে মৃত্যু-ঝুঁকিতে রয়েছে। সুষ্ঠু ও বৈধ ব্যবহারের বদলে গ্যাস সংযোগ ও সঞ্চালন অবৈধ এবং চোরাই পথে অপব্যবহারের অভিযোগ ওঠে বারবার। এর ফলে বিভিন্ন স্থানে অবৈধ গ্যাস ধীরে ধীরে জমা হয় এবং এক সময় বিস্ফোরণ ঘটায়। আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকায় একেকটি গুদাম ও মাটির নিচের পার্কিং এলাকার (বেসমেন্ট) নানা ধরনের অবৈধ ব্যবহারজনিত কারণে সংকটময় আমাদের নিরাপদ আবাসন। জনস্বাস্থ্যের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে শাকসবজিতে কীটনাশক, মাছে হরমোন, পচনশীল দ্রব্যে ফরমালিন, পোলট্রিতে ট্যানারি বজ্য, তৈরি খাবারে বিষাক্ত রং প্রভৃতির পাশাপাশি চিকিৎসকদের ধর্মঘটও আমাদের মেনে নিতে হয় নীরবে। সরকারের দায়িত্বে থাকা ম্যাচ ফ্যাক্টরির গুদাম কিংবা পুলিশের বড় কর্মকর্তার অফিসে বিস্ফোরণের জন্য দায়িত্ব সরকারি বেতনভোগীদেরই নিতে হবে। অথচ এ জন্য কাউকে দায়িত্বশীল কথা বলতে দেখা যায় না।

জাতীয় নিরাপত্তার বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্বের মধ্যে অন্যতম হলো আইনের শাসন, দেশের সার্বভৌমত্ব, জাতিগত ঐক্য, আঞ্চলিক ও ভৌগোলিক অখন্ডতা, জনকল্যাণ, টেকসই অর্থনীতি, সামাজিক সুরক্ষা ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থ সংরক্ষণ নিশ্চিত করা।

আইনের শাসন থাকলে আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকায় এত রাসায়নিক গুদাম, ঝুঁকিপূর্ণ অক্সিজেন প্লান্ট কিংবা নকল খাবার ও ওষুধ কারখানা থাকার কথা নয়। সার্বভৌম এ দেশের রাজনীতি নিয়ে সরব বিদেশিরা। আমরা এক দেশ- এক জাতিতে বিশ্বাসী। অথচ দলের আমলে লীগের আর লীগের আমলে দলের সরকারি চাকরি হয় না। এতটুকু ভূখন্ডে কে ‘গোপালী’ আর কে ‘বগুড়ার ছোল’ তা খোঁজা হয়। মুখে মুখে জনকল্যাণের কথা বললেও বাস্তবে ডাক্তাররাও ধর্মঘট করে। জনগণের হাজার কোটি টাকার ব্যাংক আমানত তুলে নেয় ভুয়া ঠিকানার পান দোকানি। আশ্রয়ণ প্রকল্পে গৃহহীনদের ঠাঁই দেওয়া হলেও ঢাকার বস্তিতে পুড়ে নদীভাঙা মানুষের শেষ সম্বল। ছাত্ররা জ্বালায় রেললাইন, বাড়িঘর ও দোকান আর ছাত্রী নেত্রীরা করে আরেক ছাত্রীর বস্ত্র হরণ। এসব দেখে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর একটা কথা খুব মনে পড়ে। তিনি বলেছিলেন, কৃষক-শ্রমিক, চাষা-ভূষারা ঘুষ খায় না, ঘুষ খায় শিক্ষিত লোকেরা। আসলেই তো তাই। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ যেসব ব্যাংকের টাকা হঠাৎ হাওয়া হয়ে যায় কিংবা লুট হওয়া ও পরে উদ্ধারকৃত টাকা যেখানে হাওয়া হয়ে যায় সেখানে কোনো অশিক্ষিত লোক নেই। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী এবং তাদের শিক্ষাগুরুরা সবাই উচ্চশিক্ষিত। মিল-ফ্যাক্টরি, অক্সিজেন প্লান্ট- এসব কিছু পরিচালনার দায়িত্বে আছেন এক শিক্ষিত সমাজ।

চিকিৎসায় অবহেলার দায়ে যারা চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের আঘাত করে আর এ জন্য যারা চিকিৎসা বন্ধ করে দেন তারা সবাই শিক্ষিত। আর অতি শিক্ষিতদের বিচরণ ছিল সাভারে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে, যেখানে নির্মাণাধীন একটি ভবনের ছাদ ধসে ১৫ জন আহত হয়। মনের অজান্তে তাই প্রশ্ন জাগে- আসলে কী শিখেছি আমরা।

যে শিক্ষা বিবেককে জাগ্রত করে না, দেশের সম্পদ ও জনগণের জানমাল সুরক্ষার পথ দেখায় না, সে শিক্ষা তো সার্টিফিকেট দিয়ে দানব তৈরির শিক্ষা। এমন দানবের হাত থেকে সুরক্ষিত থাকুক আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশ। কারণ আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশ তথা আগামীর বিশ্ব পরিচালনায় প্রয়োজন হবে সত্যিকারের শিক্ষিত, মানবিক ও স্মার্ট নাগরিক, সার্টিফিকেটধারী কোনো ডিজিটাল দানব নয়।

লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।

mail: [email protected]

সর্বশেষ খবর