বৃহস্পতিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

স্বাস্থ্য সেবা ও সুরক্ষা আইনে কার সুরক্ষা?

আবুল হাসনাৎ মিল্টন ও এ বি এম কামরুল হাসান

‘স্বাস্থ্য সেবা ও সুরক্ষা আইন-২০২৩’-এর খসড়াটি বারবার পড়লাম। কিন্তু কাকে সেবা দেওয়া হচ্ছে আর কার সুরক্ষা করা হচ্ছে, তা ঠিকমতো বুঝতে পারলাম না। প্রতিটি আইনের একটা লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে। কিন্তু এ আইনের শুরুতে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কোনো বিশদ বিবরণ না থাকায় শিরোনাম দেখে যা বোঝার তা-ই বুঝতে হচ্ছে। প্রস্তাবিত এ আইনের খসড়ার শিরোনামে ব্যবহৃত ‘স্বাস্থ্য সেবা’ শব্দদ্বয় বিভ্রান্তিকর। স্বাস্থ্য সেবার পরিধি অনেক বড়। সেখানে যেমন রোগপ্রতিরোধের ব্যাপারটা অন্তর্ভুক্ত, তেমনি রয়েছে চিকিৎসা সেবাসহ অনেক কিছু। অথচ আইনটিতে ‘স্বাস্থ্য সেবা’র সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘রোগীর রোগ নিরাময়ের লক্ষ্যে চিকিৎসক কর্তৃক প্রদত্ত সকল ধরনের সেবা’। স্বাস্থ্য সেবার নামে এ আইনে সম্ভবত চিকিৎসা সেবার কথা বলা হয়েছে, যেটাও অসম্পূর্ণ। চিকিৎসা সেবা বলতে বুঝি জনগণের স্বাস্থ্য খারাপ হলে যোগ্য কারও দ্বারা প্রদত্ত সেবা। কারা সেবা দেয়? তিনি চিকিৎসক হতে পারেন। হতে পারেন মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট, প্যারামেডিক বা মিডওয়াইফ বা নার্স। অথচ এ আইনে সব দায় কেবল চিকিৎসকের।

উন্নত দেশে যখন কোনো মহিলা গর্ভবতী হন, তখন প্রথম দিন তাঁকে দেখেন একজন মিডওয়াইফ। ডায়াবেটিস হলে প্রথম দিন তাঁকে দেখেন নার্স এডুকেটর। তার মানে, ওই প্রসূতি প্রথম দিন কোনো স্বাস্থ্য সেবা পেলেন না? ওই ডায়াবেটিসের রোগী প্রথম দিন কোনো স্বাস্থ্য (চিকিৎসা) সেবা পেলেন না? ‘স্বাস্থ্য সেবা গ্রহীতা’র সংজ্ঞায় বলে হয়েছে, স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণের জন্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন ব্যক্তি। তার মানে দাঁড়াল, চিকিৎসক ছাড়া কেউ স্বাস্থ্য সেবা দিতে পারে না। এখানে তো গোড়াতেই গলদ। যিনি বা যাঁরা খসড়াটি লিখেছেন, তাঁরা হয়তো বিষয়টি এভাবে বিবেচনা করেননি।

কার সুরক্ষা হয়েছে এ খসড়া আইনে? রোগীর সুরক্ষা হয়েছে কি? হাসপাতালে গেলেই একজন রোগী যে একটি বিছানা পাবেনই, সেই সুরক্ষা কি এ আইনে আছে? সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর ওষুধ কিনতে সামনের ফার্মেসিতে যেতে হবে না, সে কথা এ আইনের কোথাও বলা হয়েছে? একজন চিকিৎসকের কাছে গেলে রোগী তাঁর সঙ্গে ন্যূনতম ১০ মিনিট বা ১৫ মিনিট রোগ নিয়ে কথা বলতে পারবেন, সেই সুরক্ষা এ আইনে কোথায় রয়েছে? রোগীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে রোগীপ্রতি বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে ন্যূনতম ১৫ মিনিট ও জেনারেল প্র্যাকটিশনার পর্যায়ে ন্যূনতম ১০ মিনিট নির্ধারণ করলে রোগীদের স্বাস্থ্য সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত হতো, সুরক্ষা নিশ্চিত হতো। ঘণ্টায় একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সর্বোচ্চ চারজন রোগী দেখতে পারবেন। ২০ জন রোগী দেখতে হলে ওই চিকিৎসককে ৫ ঘণ্টা রোগী দেখতে হবে। এ ধরনের আইন করা গেলে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে রোগীদের সময় প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়, রোগীদের অধিকার সুরক্ষা হয়।

স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা হয়েছে? এক কথায়, না, হয়নি। স্বাস্থ্যকর্মীদের আবাসন, পরিবহনের উল্লেখ নেই কোথাও। কর্মস্থলের সুরক্ষা নেই। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আবাসন ও পরিবহনের অপরিহার্যতা উপেক্ষা করার কোনো অবকাশ নেই। স্বাস্থ্যকর্মী কর্মস্থলে নিগৃহীত হলে সেই অপরাধকে জামিনযোগ্য ও আপসযোগ্য করা হয়েছে। স্বাস্থ্যকর্মী নিগৃহীত হলে এতদিন এলাকার ‘বড় ভাইয়েরা’ ‘হ্যান্ডশেকের’ ব্যবস্থা করে দিতেন। এখন সেটা আইনি ভিত্তি পাচ্ছে। এ আইনের মাধ্যমে ‘বড় ভাইদের’ অধিকার সুরক্ষা পাবে। সন্ত্রাসীরা সুরক্ষা পাবে। অথচ আমরা তো চাই চিকিৎসা সেবা প্রদানের প্রতিটি স্থানে, হোক তা হাসপাতাল-ক্লিনিক বা চিকিৎসকের ব্যক্তিগত চেম্বার- সবখানেই সন্ত্রাসের প্রতি শূন্য সহিষ্ণুতা ঘোষণা করা হোক। সে কথা চিকিৎসা সেবাদান কেন্দ্রে স্পষ্ট অক্ষরে লেখা থাক। যারা সন্ত্রাস করবে, তাকে আইনত শাস্তি পেতে হবে। আইনে অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী শাস্তির বিধান থাকতে হবে। প্রস্তাবিত আইনে যেভাবে শাস্তির কথা বলা হয়েছে, তা পর্যাপ্ত নয়। এটি আরও কঠোর ও সুনির্দিষ্টভাবে বর্ণিত হতে হবে।

খসড়া আইনটির অবতরণিকায় একটি যুগোপযোগী আইন প্রণয়নের অত্যাবশ্যকীয়তার কথা বলা হয়েছে। স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার এ আইনটি যুগোপযোগী হয়েছে কি না তা জানতে বর্তমান যুগে আমাদের আশপাশের দেশের দিকে তাকানো প্রয়োজন। কারণে অকারণে আমরা মেডিকেল ট্যুরিজমের নামে সিঙ্গাপুর বা নিদেনপক্ষে ভারত যাচ্ছি। যাঁরা সিঙ্গাপুরে চিকিৎসার জন্য যান, তাঁরা দেখে থাকবেন সে দেশের হাসপাতালের সব ওয়ার্ডে একটি বড় পোস্টার টাঙানো রয়েছে। সেখানে লেখা রয়েছে, ‘আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে অসদাচরণ করবেন না। রোগীকে উত্তম সেবা প্রদানের জন্য আমাদের একটি নিরাপদ পরিবেশ দিন। হয়রানি থেকে সুরক্ষা আইন-২০১৪-এর ৬ ধারার অধীনে, স্বাস্থ্য সেবা কর্মীদের নির্যাতন করা একটি অপরাধ।’ হয়রানি থেকে সুরক্ষা আইনের ওই ধারায় বলা হয়েছে, কোনো অশ্লীলতা, হুমকি, আপত্তিজনক বা অপমানজনক শব্দ বা আচরণ করলে বা যোগাযোগ তৈরি করলে সেটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। শাস্তির পরিমাণ বাংলাদেশি টাকায় ৪ লক্ষাধিক। সেখানে কিন্তু কোনো আপস বা হ্যান্ডশেক করে কোমল পানীয় বা চা-মিষ্টি খাওয়ানো হয় না। গেল বছর সে দেশে এক রোগী একজন নার্সকে লাথি মারেন। ওই রোগীকে সাত সপ্তাহের জেল খাটতে হয়েছিল। স্বাস্থ্যকর্মী মার খেলে আপস হওয়ার সুযোগ থাকা অবস্থায় কার সুরক্ষা হচ্ছে তা আমাদের বোধগম্য নয়।

মেডিকেল ট্যুরিজমে আমাদের আরেকটি দেশ হচ্ছে ভারত। সে দেশের মধ্যে দক্ষিণ ভারতের চিকিৎসা আমাদের পছন্দ। দক্ষিণ ভারতের কেরালার কথাই ধরা যাক। সেখানে কথার মাধ্যমে আক্রমণ করলে সেটি অজামিনযোগ্য ও অ-আপসযোগ্য অপরাধ। অপরাধীকে ন্যূনতম ৫০ হাজার রুপি জরিমানা গুনতে হয়, অথবা সর্বোচ্চ দুই বছরের জেল। আর যদি স্বাস্থ্যকর্মীকে মারাত্মকভাবে জখম করা হয়, তার শাস্তি ১ লাখ থেকে ৫ লাখ রুপি জরিমানা অথবা সর্বোচ্চ সাত বছরের জেল। থানায় এফআইআর করার জন্য গেলে এক ঘণ্টার মধ্যে তা গ্রহণ করতে হবে। যদি কোনো পুলিশ অফিসার তা না করেন তবে তিনি শাস্তি পাবেন। এ ধরনের অপরাধে সর্বোচ্চ এক বছরের মধ্যে বিচার পর্ব শেষ করার জন্য কেরালার প্রাদেশিক সরকার একটি অধ্যাদেশ জারি করেছে গত মে মাসে। ওই অধ্যাদেশে এও বলা হয়েছে, স্বাস্থ্যকর্মী নিগৃহীত হলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মামলা রুজু করবে।

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পদক্ষেপের কথাই ধরা যাক। স্বাস্থ্যকর্মীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা সেখানে একটি ফৌজদারি অপরাধ। ভারত সরকার ২০২০ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর এ-সংক্রান্ত আইনটির সংশোধন এনেছে। স্বাস্থ্য সেবা কর্মীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা এখন সেখানে আমলযোগ্য এবং অজামিনযোগ্য অপরাধ। এ ধরনের সহিংস কাজ করার জন্য বা প্ররোচনা দিলে তিন মাস থেকে পাঁচ বছরের কারাদন্ড এবং ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ রুপি জরিমানা হবে। গুরুতর আঘাতের ক্ষেত্রে ছয় মাস থেকে সাত বছরের কারাদন্ড এবং ১ লাখ থেকে ৫ লাখ রুপি জরিমানা হবে। উপরন্তু অপরাধী ক্ষতিপূরণ এবং সম্পত্তির ক্ষতির জন্য ন্যায্য বাজারমূল্যের দ্বিগুণ দায়বদ্ধ থাকবেন।

পাশের দেশ নেপালে গত বছর একটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। স্বাস্থ্যকর্মীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা সে দেশে ফৌজদারি অজামিনযোগ্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। লঘু অপরাধে ২৫ থেকে ৫০ হাজার রুপি ও মারাত্মক অপরাধে ২ লাখ থেকে ৫ লাখ রুপি জরিমানা এবং দুই থেকে পাঁচ বছর জেলের বিধান রাখা হয়েছে।

বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর সহিংসতা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে পাশের দেশ থেকে শুরু করে বিশ্বের অন্যান্য দেশ স্বাস্থ্যকর্মী সুরক্ষার আইনগুলো যুগোপযোগী করেছে গত তিন থেকে চার বছরে। প্রস্তাবিত আইনটি আদৌ যুগোপযোগী তো নয়ই, বরং আইনটি পাঠকালে আমাদের কাছে মনে হয়েছে এটি নিদেনপক্ষে পাঁচ থেকে ১০ বছর আগে প্রণয়ন করা হয়েছে। বর্তমান যুগের কোনো ছাপ এখানে পড়েনি, যুগোপযোগী নয়।

রোগীর সুরক্ষা নেই। স্বাস্থ্যকর্মীর সুরক্ষা নেই। তবে কি সরকারের সুরক্ষা রয়েছে? বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলে। স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলছে। কোথাও নেই এসব কথাবার্তা। পুরো খসড়াটি তন্ন তন্ন করে একটি মাত্র ‘ডিজিটাল’ শব্দ খুঁজে পেয়েছি। ডিজিটাল রেজিস্টারের কথা বলা হয়েছে। ব্যস। শেষ। স্বাস্থ্য সেবায় একটি ডিজিটাল রেজিস্টারই কি ডিজিটাল বাংলাদেশ? একটি ডিজিটাল রেজিস্টারই কি স্মার্ট বাংলাদেশ? পেপারলেস হাসপাতাল, অ্যাপসভিত্তিক স্বাস্থ্য সেবা, টেলিমেডিসিন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কলমবিহীন চিকিৎসক- এসবের কোনো বালাই নেই এ প্রস্তাবে। এসব ধ্যান-ধারণা আগামীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এক ভিন্নমাত্রা যোগ করার সক্ষমতা রাখে, সেটিও চরমভাবে উপেক্ষিত হয়েছে প্রস্তাবে। আপনাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে, বর্তমানে আমরা বিদেশে স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকালে আমাদের কোনো কলম ব্যবহার করতে হয় না। এর ব্যবহার শুধু ব্যক্তিগত আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করতে প্রয়োজন হয়, সেটিও অদূর ভবিষ্যতে আর লাগবে না। বর্তমান সরকার বারবার অটিস্টিক বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের চিকিৎসা বা সামাজিকীকরণের কথা বলছে। তাদের কথা কোথাও নেই এ প্রস্তাবে?

খসড়া আইনটিতে সরকারকে বিপাকে ফেলার উপকরণও রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ একজন রোগীর জন্য ন্যূনতম ১০০ বর্গফুট জায়গা নিশ্চিতকরণের বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে। এ আইন পাসের সঙ্গে সঙ্গে দেশের প্রায় সব হাসপাতাল বন্ধ করে দিতে হবে বা আইন অমান্য করে পরিচালিত হতে হবে। একজন রোগীর জন্য কত বর্গফুট জায়গা বরাদ্দ করতে হবে তার কোনো বিশ্বস্বীকৃত বিধান নেই। তবে ‘রুল অব থাম্ব’ (প্রচলিত নিয়ম) বলে একটা কথা রয়েছে। তাতে বলা হচ্ছে, ৭৫ থেকে ১০০ বর্গফুট। ঢালাওভাবে ১০০ বর্গফুটের বিধান না করে অঞ্চলভিত্তিক বিন্যাস করা যায়। একটি উপজেলা পর্যায়ে ১০০ বর্গফুট স্থানসহ হাসপাতাল করলে সেখানে চিকিৎসা খরচ বেড়ে যাবে। এখানেও রোগীর সুরক্ষা নেই।

তাহলে স্বাস্থ্য সেবা ও সুরক্ষা আইনে সুরক্ষা হচ্ছে কার? ইতোমধ্যে চিকিৎসকদের অনলাইনভিত্তিক সংগঠন ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি, রাইটস অ্যান্ড রেসপনসিবিলিটিজ (এফডিএসআর) প্রস্তাবিত স্বাস্থ্য সেবা ও সুরক্ষা আইন-২০২৩ (খসড়া) বাতিলপূর্বক জনবান্ধব আধুনিক যুগোপযোগী আইন দাবি করেছে। এফডিএসআরের পক্ষ থেকে প্রস্তাবিত এ আইনটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে ইতোমধ্যে দেখানো হয়েছে, এ আইনটি কতটা গণবিরোধী ও এর মাধ্যমে চিকিৎসক দমনের অবকাশ রয়েছে। এখানে মফস্বল শহরে গড়ে ওঠা ক্লিনিকগুলোর বাস্তবতা আদৌ বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। এ আইনের বাস্তবায়ন হলে দেশের বড় হাসপাতালগুলোও আইন মেনে টিকে থাকবে কি না সন্দেহ! এর মধ্য দিয়ে বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতকে নিরুৎসাহ করা হয়েছে। নবীন চিকিৎসকদের জন্য চেম্বার প্র্যাকটিস দুরূহ করে তোলা হয়েছে।

অনেক গুরুত্বহীন, অপ্রয়োজনীয় বিষয়ও এই প্রস্তাবিত খসড়া আইনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। যেমন অফিস চলাকালে কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিতি কিংবা সরকারি হাসপাতালে ডিউটিরত অবস্থায় বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করতে যাওয়া। এটা তো নিঃসন্দেহে অনাকাক্সিক্ষত এবং অনুচিত কাজ। কিন্তু এর জন্য তো নতুন করে আলাদা আইন করার দরকার নেই। বিদ্যমান চাকরি আইনেই এটা অন্যায়। তার পরও যদি এটা ঘটে এবং এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, সেটা তো ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা। সামগ্রিকভাবেই স্বাস্থ্য খাতে ব্যবস্থাপনার সংকট রয়েছে, সেটি যথাযথভাবেই সমাধান করা উচিত।

প্রস্তাবিত এ আইনের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ের অনুমতিক্রমে বিদেশি চিকিৎসকরা বাংলাদেশে চিকিৎসা সেবা প্রদান করতে পারবেন। এর মাধ্যমে বিদেশের যে কোনো মানের চিকিৎসকের অবাধ অনুপ্রবেশের আশঙ্কা তৈরি হবে। অথচ বাংলাদেশের কোনো ডাক্তার চাইলেই কি বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা সেবা দিতে পারবেন? সেসব দেশে রোগী দেখতে হলে সুনির্দিষ্ট পরীক্ষায় পাস করতে হয়, কিংবা স্বীকৃত ডিগ্রিধারীরা বিশেষ বিবেচনায় সীমিত পরিসরে রোগী দেখতে পারেন। বিদেশি ডাক্তারের চিকিৎসা প্রদানের অনুমোদন দেবে বিএমডিসি, এটা তো মন্ত্রণালয়ের কোনো কাজ হতে পারে না।

চিকিৎসা সেবা প্রদানের মাধ্যমে কোনো ডাক্তারই ইচ্ছাকৃতভাবে রোগীর ক্ষতিসাধন করতে চান না। অনেক সময় চিকিৎসকের চেষ্টা সত্ত্বেও রোগীর অসুখের কাক্সিক্ষত নিরাময় হয় না। আবার অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসকের অবহেলা থাকতে পারে, অনিচ্ছাকৃত ভুল হতে পারে। কাজ করতে গিয়ে কখনো কখনো কারও ক্ষেত্রে আবার পেশাগত অসদাচরণও লক্ষ করা যায়। বিএমডিসির মাধ্যমেই এসবের প্রতিকার পাওয়া যায়। বিএমডিসিই নির্ধারণ করবে কোনটা অনিচ্ছাকৃত ভুল, কোনটা অবহেলা আর কোনটা পেশাগত অসদাচরণ। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনে মামলা হতে পারে।

চিকিৎসা করতে গিয়ে রোগীর মৃত্যু হলে অমনি ভুল চিকিৎসা বলে চিকিৎসককে গ্রেফতার করা তো প্রত্যাশিত নয়। চিকিৎসা করা তো ফৌজদারি অপরাধ হতে পারে না। এ আইনে মোবাইল কোর্টকেও শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে, যা মেনে নেওয়া যায় না। কোনো বেসরকারি ক্লিনিক বা হাসপাতাল ঠিকমতো কাজ করছে কি না তার জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট বিভাগ এবং সিভিল সার্জনদের কার্যালয় রয়েছে। তারাই এসব দেখভাল করবে। প্রয়োজনে বিএমডিসিসহ সংশ্লিষ্ট সবার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। প্রস্তাবিত আইনের খসড়াটি দেখে একজন আইনজীবী বললেন, ‘এ আইনে জনগণ এবং ডাক্তার ছাড়া বাকি সবাই উপকৃত হবে। ডাক্তার পেটানো আপসযোগ্য হওয়ায় এলাকার সন্ত্রাসীদের পোয়াবারো। এটা আদৌ সুলিখিত কোনো আইন নয়।’ বাস্তবতা হলো, স্বাস্থ্য সেবা আইনের সঙ্গে স্বাস্থ্যকর্মী সুরক্ষা আইন গুলিয়ে ফেলে লাভ নেই। এতে বরং একটা হযবরল পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। বরং জনগণের চিকিৎসার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করবার লক্ষ্যে আলাদাভাবে স্বাস্থ্যকর্মী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা হোক। স্বাস্থ্য সেবা, চিকিৎসা সেবা এবং বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক পরিচালনার জন্য বরং স্বতন্ত্র আইন হোক। আর যোগ্য, অভিজ্ঞ লোকদের দিয়েই এ আইনটি প্রণয়ন করা হোক। এতে দেশ, জাতি এবং সরকারই লাভবান হবে।

দেড় থেকে দুই দশকের প্রবাসজীবনে আমরা এর আগে নবীন চিকিৎসকের কাছ থেকে বিদেশে চলে যাওয়ার ব্যাপারে এত আগ্রহ কখনো দেখিনি। দেশের বর্তমান অবস্থায় তরুণ ডাক্তাররা নিরাপদ বোধ করছেন না। তারা যে কোনো উপায়েই দেশ ছাড়তে চান। এটা ভালো লক্ষণ নয়। এ লেখাটি যখন লিখছি, তখন এক নবীন চিকিৎসক ফোন করে বললেন, ‘ভাই, চিকিৎসক দমনের লক্ষ্যে তৈরি করা প্রস্তাবিত এ আইনটি পারলে ঠেকান।’ আমরা রসিকতা করে বললাম, ‘কেন, ভালোই তো হইছে, আইন পাস হলে আপনারা সুরক্ষা পাবেন।’ উত্তরে ছোট ভাইটি বলল, ‘ভাই, ভিক্ষা চাই না কুত্তা ঠেকান।’

♦ লেখক : আবুল হাসনাৎ মিল্টন, চেয়ারম্যান, এফডিএসআর, অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী চিকিৎসক। এ বি এম কামরুল হাসান, ব্রুনাইপ্রবাসী চিকিৎসক

 

 

সর্বশেষ খবর