আড়িয়াল বিল দেশের মধ্যাঞ্চলের সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন বিল। মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলা ও ঢাকার নবাবগঞ্জ এবং দোহার উপজেলার কিছু অংশ নিয়ে আড়িয়াল বিলের অবস্থান। পদ্মা ও ধলেশ্বরী নদীর মাঝখানে অবস্থিত ১ লাখ ৬৭ হাজার একর জমিজুড়ে এই জলাভূমি। বিশাল আয়তনের এ অবভূমির রয়েছে প্রাণিবৈচিত্র্য আর কৃষি অর্থনীতির ঐতিহ্যবাহী গুরুত্ব। বিভিন্ন মৌসুমে আমি অনেকবার গেছি আড়িয়াল বিলে। এই বিল দেশের কৃষিতে রেখে চলেছে গুরুত্বপূর্ণ এবং বৈচিত্র্যময় অবদান। বিলসংলগ্ন কৃষকদের সুবিধা-অসুবিধার কথা তুলে ধরেছি টেলিভিশনে। সাম্প্রতিক সময়ে আড়িয়াল বিলের পরিস্থিতি দেখার জন্য আবারও যাওয়ার সুযোগ হয়। খুব ভোরে রওনা করে ফজরের ওয়াক্তে পৌঁছে যাই মুন্সীগঞ্জের হাসাড়া মাছ বাজারে। ঐতিহ্যবাহী এ বাজারের সুখ্যাতি ছিল আড়িয়াল বিলের মাছের জন্য। কিন্তু এবার বাজারে তেমন বিলের মাছ দেখা গেল না। বরং চাষের মাছের বেচাকেনা চলছে। কথা বললাম স্থানীয় মাছ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। তারা বললেন, বিল থেকে যে পরিমাণ মাছ আসে তা দিয়ে বাণিজ্য ধরে রাখা যাবে না। ফলে বাধ্য হয়েই চাষের মাছের বাণিজ্য শুরু হয়েছে এই বাজারে। মনে পড়ল সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার মহিষলুটি বাজারের কথা। চলনবিলের দেশি মাছের বাজার ছিল মহিষলুটি। কিন্তু পুকুর খনন ও মাটি ভরাট করে চলনবিলের পরিবেশ নষ্ট করে ফেলায় প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত মাছ কমে এসেছে। ফলে মহিষলুটি বাজারে গিয়েও বিলের মাছের দেখা পাওয়া যায়নি। একই অবস্থা হতে চলেছে আড়িয়াল বিলেরও।
যাই হোক, আমরা পৌঁছালাম ইছামতী নদীর ঘাটে। সেখানকার ঘাটে রাখা ট্রলারে করে যাত্রা শুরু হলো আড়িয়াল বিলের উদ্দেশে। আমাদের সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় হাসাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সোলায়মান খান ও আরও কয়েকজন। তরুণ চেয়ারম্যান বেশ চৌকশ। অন্যদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম। পর পর দুই টার্মের চেয়ারম্যান। সততা এবং এলাকার জন্য কাজ করেন বলে স্বতন্ত্র নির্বাচন করে জয়লাভ করেছেন। তার জনপ্রিয়তাও বোঝা গেল। বছর আট-দশ আগে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের একটা প্রজেক্ট ছিল এলজিএসপি (লোকাল গভর্নেন্স সাপোর্ট প্রজেক্ট)। এর মূল কাজ ছিল স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালীকরণ। সেই প্রকল্পে কয়েক বছর কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। সেই থেকে আমি লক্ষ্য করছি, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বারের আগের যে সনাতনী আচার অবস্থা ছিল তা অনেকখানি পাল্টেছে। অনেক শিক্ষিত তরুণ এখন স্থানীয় প্রতিনিধি হয়ে বেশ ভালো কাজ করছেন। সোলায়মান খানকেও আমার তেমনই একজন তরুণ চেয়ারম্যান বলে মনে হলো। সকালের সূর্য তখন উঠতে শুরু করেছে। জেগেছে নদীতীরের মানুষ। বর্ষা শেষে শরতের এই সময়ে প্রকৃতি যেমনটা উজ্জ্বল ও সজীব থাকার কথা, যেমনটা দেখে এসেছি বিগত সময়ে, এখন আর তেমনটি নেই। নেই নদীর সেই টলটলে পানি, প্রকৃতিও যেন কেমন ধূসর!
আগেই বলেছি এক সময় আড়িয়াল বিলের মাছের সুনাম ছিল দেশজুড়ে। কিন্তু এখনকার জেলেরা বলছেন আগের মতো মাছ আর মিলছে না বিলের পানিতে। কথা হয় কয়েকজন জেলের সঙ্গে। তারা জানালেন, সারা রাত মাছ ধরেও তেমন বেশি পাওয়া যায় না। ঘরে ফিরতে হয় অল্প মাছ নিয়ে। অথচ আগে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। এমনকি নিষিদ্ধ কারেন্ট জালেও মাছ ধরা পড়ছে না। তার মানে বিলের মাছ কমে গেছে। অথচ এই আড়িয়াল বিল ছিল দেশি মাছের অভয়াশ্রম। এখান থেকেই মিটত দেশের মাছের পুষ্টি চাহিদার বড় একটা অংশ। পাশাপাশি এ এলাকার মানুষের জীবিকার প্রধানতম খাত ছিল বিলের মাছ। বিলসংলগ্ন এলাকার কৃষক বাঁশ, গাছের ডাল দিয়ে মাছের অভয়াশ্রম তৈরি করে। স্থানীয় ভাষায় এগুলোকে বলে ‘ডেঙ্গা’। ডেঙ্গা থেকে একেকজন কৃষক ১০-১৫ লাখ টাকার মাছ বিক্রি করতে পারত। আমি একাধিকবার মাছ ধরার এমন দৃশ্য ধারণ করেছি। মাছ আর মাছ। সেই মাছের সমৃদ্ধি এবার চোখে পড়ল না। বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্যের জোগান আসে এই আড়িয়াল বিল থেকে। এই বিলের অর্থনৈতিক উপাদান শুধু মাছ নয়। এখানকার প্রতিটি উপকরণই মানুষের বেঁচে থাকার অনন্য অনুষঙ্গ। প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো কচুরিপানার ধাপ তৈরি করে শুকনো মৌসুমে হয় সবজির চাষ। কয়েকজন মিলে নিচ্ছেন তার প্রস্তুতি। শুকনো মৌসুমে আড়িয়াল বিল হয়ে ওঠে কৃষি বৈচিত্র্যের এক বিশাল মাঠ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, ৭ হাজার ৯৭০ হেক্টর আবাদযোগ্য ভূমি রয়েছে আড়িয়াল বিলে। এখানে উৎপাদিত প্রধান খাদ্যশস্য ধান। এ ছাড়াও নানা রকমের সবজির আবাদ হয় এখানে। বিশেষ করে আড়িয়াল বিলের মিষ্টি কুমড়ার রয়েছে আলাদা খ্যাতি। এমন বড় আকারের মিষ্টি কুমড়া দেশের আর কোথাও হয় না। আড়িয়াল বিলের অন্যতম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হচ্ছে আদিগন্ত শাপলা। হাজার হাজার শাপলা ফুটে থাকে বিলে। শুধু শাপলার সৌন্দর্যই নয়, আছে এর অর্থনৈতিক গুরুত্বও। শত শত মানুষের জীবিকার ব্যবস্থা হচ্ছে বিলের এই শাপলা থেকে।
আড়িয়াল বিলের আশীর্বাদপুষ্ট মানুষ জানে এই বিলের মহিমা। প্রায় ১০ লক্ষাধিক মানুষ কোনো না কোনোভাবে এই বিলের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু সামগ্রিক দূষণের জটিল ক্ষয় থেকে সরল মানুষরা এই বিলকে রক্ষা করতে পারছেন না। বিলে দেখা মেলে মাটিভর্তি ট্রলারের সারি। বিলের মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে। কোথাও বিল ভরাট হচ্ছে। অন্যদিকে বড় বড় ট্রলারের বিকট শব্দ। সব মিলে নষ্ট হচ্ছে আড়িয়াল বিলের শত শত বছরের প্রাকৃতিক ভারসাম্য।
আড়িয়াল বিলের এই বিপর্যস্ততা প্রসঙ্গে জানতে চাই স্থানীয় হাসাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সোলায়মান খানের কাছে। তিনি জানালেন, শৈশবে যে আড়িয়াল বিল দেখে তিনি বড় হয়েছেন, সেই আড়িয়াল বিল আর নেই। ভূমি ভরাট, দখলবাজি সেখানে নতুন বাস্তবতা তৈরি করেছে। গত কয়েক বছর ধরে বিলের অনেক জায়গা ড্রেজার দিয়ে ভরে ফেলা হয়েছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য, পরিবেশ ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই বিলের অস্তিত্বের জন্য এটা বড় ধরনের হুমকি সৃষ্টি হয়েছে। জীববৈচিত্র্য, পরিবেশগত ও স্থানীয় জনসাধারণের জীবন-জীবিকার নিরাপত্তায় আড়িয়াল বিলের অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে। সবাই মিলে এগিয়ে না এলে এই আড়িয়াল বিলকে রক্ষা করা কঠিন হয়ে যাবে।
এক সময় দেশের খাল-বিলগুলো ছিল স্বাদু পানির মাছের অভয়াশ্রম। জলজপ্রাণী বৈচিত্র্য আর উদ্ভিদকুলের প্রাকৃতিক মিলনস্থল। যেখানে পারস্পরিক সাহচর্যে গড়ে ওঠা বাস্তুতন্ত্রে পরিবেশ তার ভারসাম্য বজায় রেখেছিল। কিন্তু মানুষ নানাভাবেই তা নষ্ট করে ফেলছে। যার ক্ষতিকর প্রভাব ইতোমধ্যে আমরা বুঝতে শুরু করেছি। গবেষকরা বলছেন, প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট করে উন্নয়ন কখনো টেকসই হয় না। আজকের কথা ভাবতে গিয়ে আগামী দিনের কথা ভুলে গেলে চলবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যের সঙ্গে মানুষের টিকে থাকার প্রশ্নও জড়িত। আড়িয়াল বিলের প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য আজ হারাতে বসেছে। সেই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের প্রকৃত সমৃদ্ধি। আড়িয়াল বিলসহ দেশের সব খাল-বিল জলাভূমিকে রক্ষায় প্রয়োজন সরকারের সুপরিকল্পিত নীতিমালা আর প্রায়োগিক কার্যক্রম। পাশাপাশি আমাদেরও হতে হবে সচেতন। নিজের আগামীর কথা ভেবেই প্রাকৃতিক সম্পদকে আগলে রাখতে হবে। তবেই নিজে ভালো থাকা যাবে, ভালো থাকবে ভবিষ্যৎ।
লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব