রবিবার, ৫ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

অন্তরের ব্যাধি ও তার নিরাময়

বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ নজরুল ইসলাম

অন্তরের ব্যাধি ও তার নিরাময়

সব প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য, তাঁরই প্রশংসা করছি এবং তারই সাহায্য কামনা করছি। আমরা নিজেদের আত্মার সাধন ও পাপকার্য থেকে দূরে থাকার জন্য আল্লাহর সাহায্য চাই। আল্লাহ যাকে পথ দেখান কেউ তাকে বিভ্রান্ত করতে পারে না এবং তিনি সহায় না হলে কেউ তাকে পথ দেখাতে পারে না। আমরা সবাই সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া আর কোনো সত্য মাবুদ নেই এবং আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর বান্দা ও রসুল। অসংখ্য দরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক নবী মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর পরিবার ও সাহাবিদের ওপর।

আল্লাহ বলেন, হে মুমিনগণ! তোমরা যথার্থভাবে আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং তোমরা মুসলিম না হয়ে কোনো অবস্থায় মৃত্যুবরণ কর না। (সুরা আলে ইমরান-১০২)।

নিশ্চয় মহান আল্লাহ মানুষকে সম্মানিত করেছেন; কেননা তিনি তাকে সুন্দরতম গঠনে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে সর্বোত্তম আকৃতি প্রদান করেছেন। সুতরাং মানুষ হলো সৃষ্টিজীবের মধ্যে দৈহিক কাঠামোর দিক থেকে সবচেয়ে অপরূপ, চেহারায় অনিন্দ্য সুন্দর এবং আকৃতিতে সর্বশ্রেষ্ঠ। মানুষকে বুদ্ধি-বিবেক দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে এবং ভালোমন্দের মাঝে বাছ-বিচারের ক্ষমতা দিয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কেননা আল্লাহতায়ালা মানুষকে দায়িত্ব প্রদান ও জমিনে তাদের প্রতিনিধি নিযুক্ত করা ছাড়াও কিছু মহান হিকমতের ইচ্ছা করেছেন; যে বিষয়ে শুধু তিনিই অবগত। মানুষ বাহ্যিক সৌন্দর্যের অনুপাতে একে অন্যের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করে থাকে, তবে তাদের রবের কাছে বাহ্যিক অবয়বের ভিত্তিতে তারা শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করে না; বরং শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করে তাকওয়ার ভিত্তিতে। বস্তুত আল্লাহর কাছে মর্যাদার তারতম্য অন্তরের নিষ্কলুষতার ভিত্তিতে হয়ে থাকে; যাকে মানুষ তাদের চর্মচক্ষু দ্বারা অবলোকন করতে পারে না। রসুল (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তোমাদের বাহ্যিক আকৃতি ও শরীরের দিকে দৃষ্টিপাত করেন না; বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও আমলের দিকে দৃষ্টিপাত করেন। হিলয়াতুল আউলিয়া। আল্লাহর বান্দা হিসেবে আমাদের ভাবতে হবে অন্তর হলো সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বাদশাহ আর সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তার সৈন্যসামন্ত। অন্তরের নির্দেশ তারা পালন করে এবং তার ভালো বা মন্দ প্রকাশ করে। কাজেই অন্তর যদি ভালো হয় তাহলে তার সৈন্যসামন্তরা যাবতীয় সৎ ও কল্যাণকর কাজে সাড়া দেয়। আর যদি তা নষ্ট হয় তাহলে যাবতীয় খারাপ ও অনিষ্টকর কাজে সাড়া দেয়। এর দলিল হলো সত্যবাদী রসুল (সা.) এর বাণী : জেনে রাখ, শরীরের মধ্যে একটি মাংসের টুকরা আছে, তা যখন ঠিক হয়ে যায়, গোটা শরীরই তখন ঠিক হয়ে যায়। আর তা যখন খারাপ হয়ে যায়, গোটা শরীরই তখন খারাপ হয়ে যায়। জেনে রাখ, সেই মাংসের টুকরাটি হলো কলব। (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)।

বান্দা আল্লাহর দিকে ধাবমান হওয়ার পথ অতিক্রম করে কেবল তার অন্তর দিয়ে, শরীর দিয়ে নয়। কেননা আল্লাহর কাছে পৌঁছে দেয় এমন মৌলিক ইবাদতগুলোর স্থান হলো অন্তর এবং তা সেগুলোর উৎস। যেমন- আল্লাহ ও তাঁর রসুলের প্রতি ভালোবাসা, আল্লাহর কাছে কোনো কিছুর আশা ও তাঁকে ভয় করা, তাঁকে সম্মান করা ও তাঁর ওপর ভরসা করা এবং তাঁর প্রতি একনিষ্ঠ হওয়া ও তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন এবং সৎ আমলগুলোর মধ্যে ফজিলতের তারতম্য ও সেগুলোর সওয়াব শুধু তার বাহ্যিক আকার, আধিক্যতা ও তাতে পরিশ্রমের ওপর নির্ভর করে না; বরং আমল করার সময় অন্তরে সেগুলোর প্রতি ইমান, ইখলাস ও সওয়াব কামনার হাকিকতের ওপর নির্ভর করে। সুতরাং যে ব্যক্তির অন্তর সংশোধন হয়ে যায় তার সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংশোধন ও যাবতীয় আমল সঠিক হয়ে যায়। মানুষের এ অঙ্গের যেহেতু এমন গুরুত্ব রয়েছে, তাই বান্দার জন্য বাঞ্ছনীয় হলো অন্তরকে দেখাশোনা, পরিচর্যা ও সংশোধন করা এবং তা থেকে এক মুহূর্তও অন্যমনস্ক না হওয়া। সুতরাং প্রকৃত নূর হলো অন্তরের নূর, বাস্তবিক দূরদৃষ্টি হলো হৃদয়ের দূরদৃষ্টি এবং তার সংশোধনই প্রকৃত সংশোধন। মহান আল্লাহ বলেন, বস্তুত চোখ তো অন্ধ নয়, বরং অন্ধ হচ্ছে বুকের মধ্যে অবস্থিত অন্তর। (সুরা আল-হজ : ৪৬)। এজন্য রসুলদের সরদার মুহাম্মদ (সা.)-এর অন্যতম দোয়া ছিল : হে আল্লাহ! আপনি আমার হৃদয়ে নূর দান করুন। সহিহ বুখারি। তাই বান্দার অন্তরের সুস্থতা ও তার নিষ্কলুষতা রক্ষা করা তার শরীর ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সুস্থতা রক্ষার চেয়ে বেশি জরুরি। কেননা শরীরের অসুস্থতার সর্বোচ্চ পরিণতি আখেরাতে অপমান ও লাঞ্ছনাকে অবধারিত করে। আল্লাহতায়ালা আমাদের এ থেকে রক্ষা করুন।

কেয়ামত দিবসে লাঞ্ছনা থেকে মুক্তি পাবে কেবল সেই ব্যক্তি যে শিরকমুক্ত হৃদয় নিয়ে আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে। নিষ্ঠাবানদের ইমাম ইবরাহিম খলিল (আ.)-এর জবানে মহান আল্লাহ যেমনটি বলেন, আর আমাকে লাঞ্ছিত করবেন না পুনরুত্থানের দিনে। যেদিন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোনো কাজে আসবে না। সেদিন উপকৃত হবে শুধু সে, যে আল্লাহর কাছে আসবে বিশুদ্ধ অন্তঃকরণ নিয়ে। সুরা আশ-শুআ’রা : ৮৭-৮৯। মুত্তাকিদের ইমাম, আমাদের নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর অন্যতম দোয়া হলো- হে আল্লাহ! আর আপনার কাছে বিশুদ্ধ অন্তর প্রার্থনা করছি। সুনানে তিরমিজি। আর বিশুদ্ধ অন্তর হলো সুস্থ এবং শিরক, বিদআত ও সংশয়মুক্ত অন্তর। বস্তুত এমন অন্তর চাই তাওহিদবাদী মুমিন ব্যক্তির অন্তর। কেননা কাফের ও মুনাফিক ব্যক্তির অন্তর অসুস্থ। যেমনটি বলেছেন মহান আল্লাহ, তাদের অন্তরে রয়েছে ব্যাধি। সুরা আল-বাকারা ১০।

লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক

সর্বশেষ খবর