শুক্রবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

ত্রিআত্মা

রণজিৎ সরকার

ত্রিআত্মা

লঞ্চের ছাদে দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখছে আতিক। ওর শরীরে শীতের শিরশির বাতাস লাগছে। লঞ্চে উঠলে ধুলোবালি, সিসা, গ্যাসমুক্ত বিশুদ্ধ বায়ু গ্রহণ করা যায়, এতে দীর্ঘজীবী হওয়ার আশা বাড়ে। কিন্তু আজ আতিকের মনের গহিনে বেদনার বায়ু লঞ্চ চলাচলের মতোই প্রবহমান। তবুও আতিক চোখ বন্ধ করে দুই হাত দুই দিকে মেলে দিয়ে টাইটানিক জাহাজের লিওনার্ডো ডিক্যাপ্রিও ও কেট উইন্সলেটের দৃশ্যের কথা মনে করছে। লঞ্চের ছাদে দাঁড়িয়ে আতিকের একা চাঁদ দেখার কথা ছিল না। তার মনের সঙ্গী লঞ্চ ভ্রমণের সঙ্গী হবে, এ কথা অনেকবার বলেছিল। তার কথামতো স্বপ্ন বাস্তবায়নের অনেক চেষ্টা করেছিল কিন্তু স্বপ্ন অধরাই রয়ে যায়। সম্পর্ক খারাপ হওয়ার কারণেই তা আর বাস্তবায়ন হয়নি। পূর্ণিমা রাতে লঞ্চে করে চাঁদপুর যাওয়ার যৌথ ইচ্ছা পূরণ হয়নি। অনেক দিন পর সে সিদ্ধান্ত নিল একাই মন খারাপের মাঝে আকাশের নিচ আর জলের ওপর দিয়ে হৃদয়ের মাঝে হাহাকার প্রেম কাঙাল মন নিয়ে লঞ্চের ছাদে দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখতে দেখতে যাবে চাঁদপুর। ইচ্ছা পূরণ করে মন ভালো করার জন্য আজ চাঁদপুরে যাচ্ছে আতিক। মনের সঙ্গী লঞ্চের ক্যাবিনে না থাকলেও হৃদয়ক্যাবিনজুড়ে আছে। সুজানাকে খুবই মিস করেছে সে।

মেঘনা নদীর ঢেউ আর পানি দেখে হঠাৎ তার গ্রামের কাদামাটির পানি, ধানখেতের গাছের গোড়ার পানি আর মাঠে বন্যায় ঢোকা নতুন পানিতে ব্যাঙ ডাকের কথা মনে পড়ল। জেলেদের ইলিশ মাছ ধরতে দেখে বন্যার সময় বড়শি দিয়ে বোয়াল মাছ ধরার কথাও মনে পড়ল। এসব মনে করে সুজানাকে ভুলে থাকার চেষ্টা করছে আতিক। কিন্তু কোনোভাবেই ভুলতে পারছে না। নিচে তাকালে জলের ভিতর সুজনার ছায়া দেখে, আকাশের দিকে তাকালে চাঁদ আর তারার মাঝে দেখতে পায় তার মুখ। দূরে তাকালে মিটমিটি আলোর মাঝে দেখতে পায় তাকে। লঞ্চের হাজারো মানুষ দেখে মনে করে এই তো সামনে পড়বে সুজানা।

লঞ্চ কিছুদূরে যাওয়ার পর দেখে শ্মশানের ঊর্ধ্বমুখী আগুন। এই আগুন দেখে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল আতিকের। মৃত্যুচিন্তা ভেতরটা নাড়িয়ে দিল। এখনো তার আপন কেউ মারা যায়নি। শোক সইতে হয়নি। কিন্তু ক্লাসে একদিন হিসাববিজ্ঞানের মুকুল স্যার বলেছিলেন, ‘বাবা-মা ও নিকট-আত্মীয়স্বজন এমনকি নিজের মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকতে। তাহলে মনে ভয় কাজ করবে না, সব সময় স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে। বয়স অনুযায়ী বাবা-মায়ের মৃত্যু সন্তানের চেয়ে আগেই হয়। এটা প্রকৃতির নিয়ম কিন্তু আবার কখনো দুর্ঘটনার কবলে পড়ে বাবা-মায়ের আগে সন্তানের মৃত্যু হতে পারে, অসুস্থতার কারণেও। যে কোনো বিপদের জন্য প্রস্তুত থাকার মানসিকতা প্রয়োজন। এসব বিষয়ে মানসিক মনোবল রেখে সব সময় চলার চেষ্টা করি। সে জন্যই বাবা-মায়ের মৃত্যুতে তেমন কষ্ট পাইনি।’ ক্লাসে মুকুল স্যারের কথাগুলো যেদিন শুনেছে আতিক, সেদিন থেকেই ধীরে ধীরে মনোবল প্রস্তুত করেছে। মৃত্যুচিন্তা ভুলে থাকার জন্য নদীর পাড়ের দিকে চোখ পড়তেই মনে পড়ছে- নদীর একূল ভাঙে ওকূল গড়ে/এই তো নদীর খেলা/সকালবেলা আমির যেজন/ফকির সন্ধ্যাবেলা। তার হৃদয়ের একূল-ওকূল দুই কূল ভেঙে দিয়েছে। সে হৃদয় আর কি তীরে আসবে? হৃদয় পাড়ে এখন শুধু মরুভূমির চর পড়ে আছে। তুমি হয়তো আনন্দ অর্জনের ফানুস উড়াও অন্য কারও হৃদয়ের ছাদে। তার হৃদয় নদীতে নৌকা, লঞ্চ, জাহাজ চলছে সুখের বহর। তোমার সুখে থাকা মানেই কিন্তু আমার সুখে থাকা, তোমার সুখের নদীতে যদি চর পড়ে তাহলে আমি মত্ত নদীর আঘাতের মতো তলিয়ে যাব ভালোবাসার মাটির বাঁধ।

পূর্ণিমার পূর্ণ চাঁদ থেকে চোখটা সরিয়ে নিয়ে ডান দিকে তাকিয়ে দেখে তার হৃদয়ের চাঁদমুখ সুজানা অন্যের হাতে হাত রেখে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আতিকের হৃদয় নদীতে জলোচ্ছ্বাস শুরু হলো। যে লঞ্চে তার সঙ্গে ভ্রমণ করার কথা ছিল, সেখানে অন্য কেউ আজ তার সঙ্গী। ভুল দেখছে না তো। নাকি তার চেহারার মতো অন্য কেউ। নিশ্চয় অন্য কেউ। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না আতিক। সামনে গিয়ে কথা বলবে। নাকি দূর থেকে দেখে শিওর হবে। নাকি কল করে দেখবে সত্যি কি না। কল দিতে পারবে না। কারণ ব্লক করা আছে। অন্য নম্বর দিয়ে কল দেবে সেটাও সাহস পেল না। সামনে যাওয়াটা ভদ্রতার কাজ হবে না। আতিকের ফেসবুক আইডি সুজানা ব্লক করে রেখেছে। তাই সুজানাকে ফলো করার জন্য অন্য একটা আইডি খুলেছে সে। ওই আইডি দিয়ে দেখে সুজানা লঞ্চের ছবি পোস্ট করছে। কিন্তু তার ছবি দেয়নি। শুধু লঞ্চের ছবি। ছবি দেখে আতিক শিওর হলো সুজানাই। তখন আতিক ভিডিও করল। সুজনা ধরল না। 

তারপর ওদের সামনে না গিয়ে ভদ্রভাবে নিচে চলে এলো আতিক। কী করবে, ঠিক বুঝতে পারছে না। নিজের বিবেককে নিয়ন্ত্রণ করার খুবই চেষ্টা করছে। এই অবস্থায় কোনোভাবেই সে নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না। বেদনার বিষে ছটফট করছে। নদীর জল, আকাশের চাঁদ-তারা সবাই যেন আতিককে দোষারোপ করছে। তারা যেন বলছে, নিজের চেয়ে অন্যকে বেশি ভালোবাসে প্রচ- বোকারা। সুজানাকে সত্যি সত্যি নিজের চেয়ে বেশি ভালোবাসে আতিক। তার কোনো ক্ষতিও চায় না সে। সব সময় ভালোই চায়। তার সুখের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে। লঞ্চে এমন দৃশ্য দেখে চিতার আগুন যেন তার বুকের ভেতর জ¦লছে। মোমবাতি যখন জ¦লে তখন শরীর পুড়ে যাওয়া দেখে কিন্তু বেদনার আগুনে যখন মানুষের হৃদয় পোড়ে সেটা আমরা কেউ দেখতে পারি না। এই অবস্থায় মোমবাতির শরীর পুড়ে যাওয়ার মতো আতিকের হৃদয় পুড়ে যাচ্ছে। আর সেই আগুনে পোড়ার তাপে আতিক ফেসবুকে স্ট্যাস্টাস দিল-

মেঘনা নদীর বুকে লঞ্চে আগুন জ¦লে আমার বুকে।

আগুন জ¦ালিয়ে তুমি অন্যকে নিয়ে আছ মহাসুখে।

পোস্ট দেওয়ার কয়েক মিনিট পর হঠাৎ কালো মেঘ এসে চাঁদটাকে ঢেকে দিল। নদীর জলের দিকে তাকাল আতিক। জলের ভেতর থেকে মৎস্যকুমারী বলল, ‘তুমি সুজানাকে চিরতরে ভুলে থাকার জন্য আমার কাছে এসো।’

মৎস্যকুমারীর আহ্বানে নদীতে ঝাঁপ দিল আতিক। নদীতে পড়তে পড়তে চিৎকার করে বলল, ‘সুজানা, লঞ্চে আমিও ছিলাম, তুমি হয়তো জানো না।’

মুহূর্তের মধ্যে আকাশে মেঘের আড়ালে চাঁদ লুকিয়ে যাওয়ার মতো নদীর জলে ডুবে গেল আতিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর