শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা
পিছনে ফেলে আসি

প্রফুল্ল রায় ও কেয়াপাতার নৌকো

ইমদাদুল হক মিলন

প্রফুল্ল রায় ও কেয়াপাতার নৌকো

নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। সেবারের পুজো সংখ্যা ‘বর্তমান’ পত্রিকায় আমি একটা বড় গল্প লিখেছি। গল্পের নাম ‘মেয়েটির কোনো অপরাধ ছিল না’। কলকাতার ওই পত্রিকাটির স্লোগান হচ্ছে- ‘যে কাগজ ভগবান ছাড়া কাউকে ভয় করে না’। পত্রিকার সম্পাদক বিখ্যাত সাংবাদিক বরুণ সেনগুপ্ত। আর পত্রিকাটির বিভিন্ন বিভাগে কাজ করেন বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত সব লেখকের ছেলেমেয়েরা। যেমন বিমল করের মেয়ে অনুভা কর, সন্তোষকুমার ঘোষের মেয়ে কাকলী চক্রবর্তী, চক্রবর্তী পদবিটা কাকলী নিয়েছেন তাঁর স্বামীর কাছ থেকে। স্বামী কবি নিরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ছেলে। গৌরকিশোর ঘোষের মেয়ে সাহানা নাগচৌধুরী। পুজো সংখ্যা বেরিয়ে যাওয়ার কিছুদিন পর কলকাতা থেকে এক ভদ্রলোক আমাকে ফোন করলেন। প্রথমেই বললেন, তোমার গল্পটা আমার এতই পছন্দ হয়েছে, বর্তমান পত্রিকা থেকে তোমার টেলিফোন নম্বর জোগাড় করে ফোন করলাম। বিক্রমপুর অঞ্চলের পটভূমিতে লেখা গল্প। এজন্য হয়তো আরও বেশি আগ্রহী হয়েছি তোমার সঙ্গে কথা বলতে। আমার বাড়িও একসময় ছিল পূর্ব বাংলার বিক্রমপুরে। আমিও লেখালেখি করি। আমার নাম প্রফুল্ল রায়।

প্রফুল্ল রায় নামটা শুনে আমি এমন দিশাহারা হলাম, কথা প্রায় বলতেই পারছিলাম না। প্রফুল্ল রায় মানে ‘কেয়াপাতার নৌকো’র লেখক। কী ভীষণ আগ্রহ নিয়ে তাঁর এই উপন্যাসটা আমি পড়েছি। দেশভাগের পটভূমিতে লেখা ‘কেয়াপাতার নৌকো’ এক অসামান্য উপন্যাস। বিক্রমপুর অঞ্চলের রাজদিয়া গ্রামের পটভূমিতে লেখা। রাজদিয়াতেই প্রফুল্ল রায়ের জন্ম। ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ সাল। দেশভাগের সময় তাঁর বয়স ১৩ বছর। সেই বয়সে উদ্বাস্তু হয়ে চলে গেলেন কলকাতায়। কিন্তু দেশভাগের বেদনা তাঁকে কখনো ছাড়েনি। অসামান্য কিছু গল্প লিখেছিলেন দেশভাগ নিয়ে। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে তাঁর ‘রাজা যায় রাজা আসে’ গল্পটির কথা। তাঁর প্রথম গল্প ‘মাঝি’ আর প্রথম উপন্যাসের নাম ‘পূর্ব-পার্বতী’। ঘুরে বেড়িয়েছেন সারা ভারতবর্ষ। আন্দামান-নিকোবর দ্বীপ, বিহারের বিভিন্ন অঞ্চল, উপজাতীয়দের জীবন লক্ষ্য করেছেন ঘনিষ্ঠভাবে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষকে নিয়ে একের পর এক গল্প-উপন্যাস লিখেছেন। তাঁর ‘চরাচর’ গল্পটির চলচ্চিত্রায়ণ করেছেন একালের বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। কয়েক বছর আগে ভারতীয় এক বিখ্যাত চ্যানেলে বহুপর্বে প্রচারিত হলো তাঁর ‘কেয়াপাতার নৌকো’ উপন্যাসের সিরিয়াল। অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল সিরিয়ালটি। কত কত লেখা প্রফুল্ল রায়ের। ভাতের গন্ধ, আমাকে দেখুন, মানুষের যুদ্ধ, অন্ধকারে ফুলের গন্ধ, প্রস্তুতি পর্ব, আকাশের নিচে মানুষ...। তাঁর লেখা ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়ও হয়েছে।

সেই যে টেলিফোনে পরিচয় হলো তারপর কলকাতা গেলেই তাঁর বাড়িতে যাই। দীর্ঘক্ষণ বসে তাঁর সঙ্গে গল্প করি। অত্যন্ত চুপচাপ ধরনের মানুষ। নিজের মধ্যবিত্ত ফ্ল্যাটে থাকেন। লেখালেখির বাইরে কোনো চিন্তাভাবনা নেই। ২০১২ সালে বাংলাদেশের এবং ভারতের তিনজন লেখককে দিল্লির আইআইপিএম সংস্থাটি ‘সুরমা চৌধুরী আন্তর্জাতিক সাহিত্য পুরস্কার’-এ সম্মানিত করল। আর্থিক মূল্যে পুরস্কারটি বিশাল, কলকাতা থেকে এ পুরস্কার পেলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘সেই সময়’ উপন্যাসের জন্য, প্রফুল্ল রায় পেলেন তাঁর ‘কেয়াপাতার নৌকো’র জন্য, সমরেশ মজুমদার পেলেন ‘কালবেলা’ উপন্যাসের জন্য। বাংলাদেশ থেকে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস পেলেন ‘খোয়াবনামা’র জন্য, সেলিনা হোসেন পেলেন ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’র জন্য, আর আমাকে এ পুরস্কার দেওয়া হলো ‘নূরজাহান’ উপন্যাসের জন্য। আমাদের হাতে পুরস্কার তুলে দিলেন বাংলা সাহিত্যের এক মহিরুহ রমাপদ চৌধুরী।

কথায় কথায় প্রফুল্ল রায় একদিন আমাকে তাঁর বাড়িতে বসে ‘কেয়াপাতার নৌকো’ লেখার পিছনের ঘটনা বলেছিলেন। এই উপন্যাস লিখতে তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। তিনিও পূর্ব বাংলার লোক। দেশভাগের পটভূমিতে কয়েকটি গল্প লিখেছেন কিন্তু কোনো উপন্যাস লেখেননি। প্রফুল্ল রায়কে খুবই ভালোবাসতেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। প্রফুল্ল রায় তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন দেশভাগের পটভূমিতে বড় উপন্যাস লেখার জন্য। এ প্রসঙ্গে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় অসাধারণ একটা কথা বলেছিলেন- ‘দেশভাগ আমার স্মৃতিতে আছে, অনুভবে নেই। সুতরাং আমার পক্ষে এই বিষয়ে বড় উপন্যাস লেখা সম্ভব নয়। অনুভবে না থাকলে শুধু স্মৃতি দিয়ে বড় কাজ করা যায় না। বরং আমি লক্ষ্য করেছি তোমার স্মৃতি এবং অনুভবে অনেক বড়ভাবে আছে দেশভাগ। তুমি শুরু কর।’

এই অনুপ্রেরণাতেই ‘কেয়াপাতার নৌকো’ লিখতে শুরু করলেন প্রফুল্ল রায়। প্রথম পর্ব লিখছেন। খবর পেলেন ‘সাপ্তাহিক অমৃত’ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক কবি মনীন্দ্র রায়। প্রফুল্ল রায়কে অনুরোধ করলেন দ্রুত লেখা শেষ করে দিতে। তিনি অমৃত পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ছাপবেন। ১৯৬৮-৬৯ সালে অমৃত পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ছাপা হলো ‘কেয়াপাতার নৌকো’। প্রথম এবং দ্বিতীয় পর্ব। তারও ত্রিশ-বত্রিশ বছর পর ‘বর্তমান’ পত্রিকার পরপর দুবারের পুজো সংখ্যায় দুই ভাগে ছাপা হলো ‘কেয়াপাতার নৌকো’র তৃতীয় পর্ব। তারপর করুণা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হলো ‘কেয়াপাতার নৌকো’র অখ  সংস্করণ। প্রথম পর্ব উৎসর্গ করা হয়েছিল সন্তোষকুমার ঘোষকে, দ্বিতীয় পর্ব বিমল করকে, তৃতীয় পর্ব কাকলী চক্রবর্তী ও সাহানা নাগচৌধুরীকে। প্রফুল্ল রায় আমাকে বলেছিলেন, ‘কেয়াপাতার নৌকো’র পরবর্তী আরও কয়েকটি পর্ব তিনি লিখবেন। কয়েক বছর আগে দেখা হলো তাঁর সঙ্গে কলকাতায়। সাত-আট শ পৃষ্ঠার একটি বই দিলেন আমাকে। বইয়ের নাম ‘শতধারায় বয়ে যায়’। বললেন, এটা কেয়াপাতার নৌকোর পরবর্তী পর্ব। এখন তাঁর বয়স ৮৫ বছর। এখনো তিনি সচল। এখনো প্রতিদিন বাজার করেন, প্রতিদিন নিয়ম করে লিখতে বসেন। আশা করি তিনি আরও কিছু বছর বাঁচবেন এবং তাঁর পরিকল্পিত পরবর্তী পর্বগুলো লিখে যাবেন। আমি তার দীর্ঘজীবন কামনা করছি।

সর্বশেষ খবর