লন্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়াম। ৯৮ হাজার দর্শকের গর্জন শুনছেন ববি মুর এবং উবে সিলাররা। ১৯৬৬ বিশ্বকাপ ফাইনালের নির্ধারিত সময় শেষ। ইংল্যান্ড-পশ্চিম জার্মানির অবস্থান ২-২ সমান্তরালে। একটা যুদ্ধ লড়ে ক্লান্ত-শ্রান্ত দুই দলের তারকারা নেতিয়ে পড়েছেন। কয়েক মিনিটের বিরতি শেষে আবার ফিরতে হবে রণাঙ্গনে। এই ফাঁকে শিষ্যদের সামনে এসে ইংলিশ কোচ আলফ্রেড রামসি বললেন, তোমরা তো বিশ্বকাপ জিতেই গেছ। আবার জিততে হবে। ওদের দিকে তাকাও। দেখ, ওরা কেমন ক্লান্ত। জার্মানরা শেষ হয়ে গেছে।
'জার্মানরা শেষ হয়ে গেছে' আলফ্রেড রামসির ওই একটা কথাই জিওফ হার্স্টদের উজ্জীবিত করে তুলেছিল। অতিরিক্ত ৩০ মিনিট ইংলিশরা খেলল। ইংলিশরা বলতে নবাগত জিওফ হার্স্ট খেললেন। নির্ধারিত সময়ে তার গোলেই প্রথমবার সমতায় ফিরেছিল ১৯৬৬ বিশ্বকাপের 'ওয়ান্ডারটিম'। এরপর হার্স্ট কি করলেন! আন্তর্জাতিক ফুটবলে যার ঝুলিতে কেবল চারটা ম্যাচ ছিল বিশ্বকাপের আগে। কালে-ভদ্রে বদলি খেলতে নামতেন। সেই হার্স্টই কিনা জিমি গ্রিভসের মতো তারকার স্থানটা দখল করে নিলেন! ফাইনালে গ্রিভসকে বসিয়ে রেখে রামসি নামিয়ে দিলেন হার্স্টকেই। হেলমুট হ্যালারের গোলে ম্যাচের ১২ মিনিটেই পশ্চিম জার্মানি এগিয়ে যাওয়ার পর হার্স্টই সমতা এনে দেন ইংলিশদের (১৮ মিনিটে)। এরপর মার্টিন পিটার্সের গোল (৭৮ মিনিট) ইংলিশদের এগিয়ে দিলেও ওয়েবারের গোলে জার্মানরা সমতায় চলে আসে ম্যাচে ৮৯ মিনিটে। ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত মিনিটে। কোচ রামসির জ্বালাময়ী ভাষণের পর জিওফ হার্স্টরা খেললেন, মাঠের অপর প্রান্তে জার্মানদের দর্শক বানিয়ে! ১০১ মিনিটে একটা বিতর্কিত গোল করেন জিওফ হার্স্ট। জার্মানরা বলে 'ইজ ইট আ গোল'? তবে ইংলিশ স্ট্রাইকার রজার হান্ট পাশে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট দেখলেন গোল লাইন অতিক্রম করেছে বল। দুই হাত আকাশে ছুড়ে তখনই তিনি রেফারির দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। 'গোল, গোল' বলে চিৎকার করলেন। সুইস রেফারি গটফ্রেড ছুটে গেলেন সোভিয়েত লাইন্সম্যান বাখরামভের কাছে। তিনিও বললেন, গোল। জার্মানদের আপত্তি টিকল না। এরপরের কাণ্ডটাই জিওফ হার্স্টকে বিশ্বকাপের ইতিহাসে অমর করে দিল। তিনি এমন এক গৌরবের মালিক হলেন, যার কোনো অংশীদার নেই। ১২০ মিনিটে ববি মুরের লম্বা পাস থেকে বল পেয়ে কৌশলী হার্স্ট গোল করতে কোনো কসুর করেননি। জিওফ হার্স্টই একমাত্র ফুটবলার বিশ্বকাপের ফাইনালে যার তিনটা গোল রয়েছে। হ্যাটট্রিক করেছেন তিনি বিশ্বকাপের ফাইনালে। ওই একটা হ্যাটট্রিকই জিওফ হার্স্টকে অমর করে দিয়েছে ফুটবলে। জার্মানরা বহুদিন ভিডিও চিত্র দেখিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে জিওফ হার্স্টের দ্বিতীয় গোলটা হয়নি। ওটা গোল লাইনই অতিক্রম করেনি। জার্মানদের দাবি কতটা যৌক্তিক এ নিয়ে তেমন করে কেউ কোনোদিন আর ভেবে দেখেনি। ততোদিনে ফুটবল ইতিহাসে অমর হয়ে গেছেন জিওফ হার্স্ট।
ওয়েস্ট হ্যামের আপটন পার্কের সামনে 'ওয়ার্ল্ড কাপ স্কালপচার' নামের একটা ভাস্কর্য আছে। ববি মুরের হাতে বিশ্বকাপ ট্রফি। তাকে কাঁধে তুলে নিয়েছেন জিওফ হার্স্ট ও রে উইলসন। হার্স্টের কাঁধে হাত রেখে পাশে দাঁড়িয়ে আছেন মার্টিন পিটার্স। ওই ছবিটা ইংল্যান্ডের ১৯৬৬ বিশ্বকাপ জয়ের প্রতীক। ওরাই তো ইংল্যান্ডকে এনে দিয়েছিলেন সোনার ট্রফি। ৬৬'র ইংলিশ মিডফিল্ডার নবি স্টাইলস অবশ্য ম্যাচ শেষে ড্রেসিং রুমেই রামসিকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, আপনি, আপনিই ইংল্যান্ডকে বিশ্বকাপ এনে দিলেন। আপনাকে ছাড়া এই সাফল্য অসম্ভব ছিল। ইংল্যান্ডের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বিশ্বাস করে, জিওফ হার্স্টকে ছাড়াও এই সাফল্য অসম্ভব ছিল। জাতীয় দলের হয়ে ৪৭ ম্যাচে মাত্র ২৪টা গোল করেও তিনি ইংলিশ ফুটবলে কিংবদন্তির আসন নিয়ে বসে আছেন।