আড্ডা-গান আর হৈ-হুল্লোড়ে সারা বছরই মেতে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র-টিএসসি। দেশের শিল্প-সাহিত্যের এই প্রাণকেন্দ্র বছরজুড়েই কর্মচঞ্চল থাকে কোন না কোন উৎসবের আমেজে। তবে সিয়াম সাধনার মাস রমজান টিএসসির চিরচেনা এই দৃশ্যে নতুন মাত্রার যোগ করে।
বিকেল হতেই টিএসসির সবুুজ চত্বর ভরে যেতে থাকে নানান বয়সি মানুষের উপস্থিতিতে। খোলা আকাশের নিচে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি নগরের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা নানা পেশার মানুষ ভিড় জমাতে থাকেন। কেউ আসেন বন্ধুদের নিয়ে, কেউবা পরিবারের সাথে। হাতে নানান রঙ্গের ঠোঙ্গা, পানির বোতল আর পত্রিকা নিয়ে দলে দলে গোল হয়ে বসে পড়েন মাঠে।
ছোট বা বড় দল, সবার উদ্দেশ্যই এক। সারা দিনের সিয়াম সাধনার পরে প্রাণাধিক বন্ধু-বান্ধব বা পরিজনদের নিয়ে ইফতার করা। বাহারী আইটেমের ইফতার সামগ্রী কেনা হয় দলের সবার দেওয়া চাঁদা দিয়ে। এই আয়োজনে থাকে মুড়ি, ছোলা, খেজুর, জিলাপি, বেগুনি, চিকেন পাকোরা, বুরিন্দা, আলুর চপ ইত্যাদি। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা যত ঘনিয়ে আসে মানুষের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের ছাত্রছাত্রীর এই মিলনকেন্দ্র। জায়গা ধরে রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তারা। কেউ কেউ মাঠে জায়গা না পেয়ে বসে পড়েন টিএসসির ভেতরে-বাহিরের করিডোরে। ইফতার আয়োজনের পাশাপাশি চলতে থাকে আড্ডাবাজি। আবার অনেকে ছাত্রী হল থেকে রান্না করে নিয়ে আসেন বন্ধু-বান্ধুবদের খাওয়াতে। ইফতার শেষেও চলে চুটিয়ে আড্ডা-গল্প। বন্ধুদের সাথে খোলা আকাশের নিচে ইফতারের এ আয়োজন যেন তাদের আড্ডার আনন্দকে বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে। বিকেল থেকে ইফতারের আয়োজন নিয়ে টিএসসিতে বসে আড্ড দিচ্ছিলেন তিন বন্ধু, সাইফ, লিমা, মাহবুব।
এদের কেউই বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকেন না। কথা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে পড়ুয়া সাইফের সাথে। তিনি বলেন, ‘আমি হলে থাকি না কিন্তু বন্ধুবান্ধবদের সাথে ইফতারের আনন্দ উপভোগ করতে টিএসসিতে এসেছি। বন্ধুদের ছাড়া ইফতার আড্ডা কোনটাই জমে না।’
ঢাকার নামকরা বহুজাতিক তিন কোম্পানিতে কর্মরত আছেন ইফতেখার আলম, হুসাইন আহমেদ আর মিথুন চৌধুরী। তারা তিনজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। কাজের ফাঁকে সময় মিলতেই তিন বন্ধু এসেছেন একসাথে ইফতার করতে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক জায়গা থেকে ইফতারের জন্য তারা বেছে নিয়েছেন টিএসসিকে। মিথুন চৌধুরী জানালেন, ‘এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি জায়গার সাথে আমাদের স্মৃতি মিশে আছে। তবে টিএসসির প্রতি আমাদের আবেগটা একটু বেশিই। তাই সময় পেলেই ছুটে আসি টিএসসিতে। আজ যেমন এসেছি বন্ধুদের সাথে ইফতারের আনন্দ ভাগাভাগি করতে।’ অনেক দিন পর বন্ধুদের সাথে দেখা সাক্ষাতের সুযোগ মেলাও টিএসসিতে ইফতার করতে আসার অন্যতম কারণ বলেও জানালেন তিনি।
এদিকে, টিএসসির এই ইফতারের মিলনমেলাকে কেন্দ্র করে টিএসসি সড়ক দ্বীপ, মিলন চত্বর, হাকিম চত্বর, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেট, শামসুন্নাহার হলের সামনের প্রাঙ্গণসহ আশপাশের এলাকায় গড়ে ওঠেছে প্রায় ২০-২৫টি অস্থায়ী দোকান। বিকেল গড়াতেই ইফতার সামগ্রীর পসরা সাজিয়ে বসেন দোকানিরা। সন্ধ্যা যত ঘনিয়ে আসে তাদের ততো দম ফেলার সুযোগ থাকে না। ইফতার সামগ্রী কিনতে দোকানগুলোতে ভিড় জমান অসংখ্য ক্রেতা।
তবে, এর আগের বছরগুলোদে ইফতারের পর উচ্ছিষ্ট আবর্জনায় ময়লা হয়ে যেত পুরো টিএসসি। এতে এক ধরনের অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের সৃষ্টি হত। এই অসুবিধা দূর করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাংস্কৃতিক সম্পাদক আসিফ তালুকদারের উদ্যোগে টিএসসির মাঠে স্থাপন করা হয়েছে বেশকিছু ডাস্টবিনের। এই উদ্যোগ প্রশংশিত হয়েছে সবার মাঝে।
বিষয়টি নিয়ে আসিফ তালুকদার বলেন, প্রতিবছরই রমযানে ইফতারকে করে টিএসসি মিলনমেলায় পরিণত হয়। তবে একটু সচেতনতার অভাবে ইফতার আয়োজনের পর ময়লা রেখে যাওয়ায় টিএসসি আবর্জনায় ভরে যেত। সন্ধ্যার আগের সুন্দর জায়গাটা রীতিমতো ডাস্টবিনে পরিণত হতো।
তাই এবার পর্যাপ্তসংখ্যক ডাস্টবিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। টিএসসিকে পরিচ্ছন্ন রাখতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবাইকে আহ্বান জানানো হচ্ছে। এ বিষয়ে সবার মনোভাব ইতিবাচক বলেই মন্তব্য তাঁর। সকলের সহযোগিতায় আরও সুন্দর টিএসসি গড়ে তোলা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন