১১তম বিশ্বকাপের আসর বসে আর্জেন্টিনায়। ১৯৭৮ সালের সে বিশ্বকাপে জিকো, ক্যাম্পেস এবং প্যাসারেলাদের ঘিরেই ছিল আলোচনার ঝড়। তবে এসব তারকাদের ভিড়েই ২২ বছরের এক ইতালিয়ান তরুণ তিনটা গোল করে ফুটবলবোদ্ধাদের নজর কেড়ে নিলেন। এক বাক্যে সবাই সায় দিলেন, এ ছেলে একদিন মহাতারকা হবেই। বাদ সাধলো জুয়ার আসর। ইতালিতে তখন 'টটোনেরো' জ্বর। ফুটবলারদের ম্যাচ বিক্রি করে দেওয়াকেই 'টটোনেরো' বলে অভিহিত করেছিলেন আলভারো ট্রিঙ্কা ও ম্যাসিমো ক্রুসিয়ানি। সে সময় এসি মিলান, লেজিও, বলগনার মতো ক্লাবগুলো দিব্যি জুয়া খেলছিল ফুটবল নিয়ে। ফেঁসে গেলেন ভবিষ্যতের মহাতারকা। ১৯৮০ সালে তিন বছরের জন্য ফুটবলে নিষিদ্ধ হলেন তিনি। বিশেষ বিবেচনায় সেই শাস্তি কমানো হলো এক বছর। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে যখন মাঠে ফিরলেন, ১৯৮২ বিশ্বকাপ দোর গোড়ায়। তবে দুই বছরের বন্দি জীবন কাটিয়ে মাঠে ফেরা পাওলো রোসি দেখালেন, তিনি ফুরিয়ে যাননি। ইতালিকে দুর্দান্ত সব ম্যাচ উপহার দিয়ে ছিনিয়ে আনলেন বিশ্বকাপের সোনার ট্রফি। কয়েদি থেকে বনে গেলেন নায়ক।
পাওলো রোসি এমন তিন জন ফুটবল তারকাদের এক জন যারা একটা বিশ্বকাপেই নিজেদের মেলে ধরেছেন পূর্ণ রূপে। জয় করেছেন সম্ভাব্য সবকিছুই। ১৯৬২ বিশ্বকাপে ব্রাজিলিয়ান তারকা গারিঞ্চা বিশ্বকাপ শিরোপার পাশাপাশি জয় করেছিলেন গোল্ডেন বুট (বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা ৪ গোল) এবং গোল্ডেন বল (বিশ্বকাপের সেরা তারকা)। ১৯৭৮ বিশ্বকাপে একই কৃতিত্ব গড়েন মারিও ক্যাম্পেস। বিশ্বকাপের পাশাপাশি সর্বোচ্চ গোল (৬টি) স্কোরার (গোল্ডেন বুট) ও সেরা খেলোয়াড়ের (গোল্ডেন বল) পুরস্কার জয় করেন ক্যাম্পেস। ১৯৮২ সালে গারিঞ্চা ও ক্যাম্পেসের দলে যোগ দেন ইতালিয়ান তারকা পাওলো রোসি।
১৯৮২ বিশ্বকাপই পাওলো রোসির ফুটবল ক্যারিয়ারের সব কালিমা মুছে দেয়। বিশেষ করে দ্বিতীয় রাউন্ডে ব্রাজিলের বিপক্ষে 'বেসরকারি ফাইনাল' ম্যাচের পর তার অতীত ভুলে যায় ফুটবলভক্তরা। দ্বিতীয় রাউন্ডে সি গ্রুপে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার মুখোমুখি হয়েছিল ইতালি। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ২-১ গোলে জেতার পর শর্ত দাঁড়াল ব্রাজিলের বিপক্ষেও ম্যাচটা জিততে হবে সেমিফাইনাল খেলতে হলে। জিকো-সক্রেটিস-ফ্যালকাওদের ব্রাজিল ছিল সেবারের এক নম্বর ফেবারিট। তবে এক পাওলো রোসির কাছেই ব্রাজিল তার সব শ্রেষ্ঠত্ব বিলিয়েছিল সেদিন। রোসির হ্যাটট্রিকেই ব্রাজিলকে হারিয়ে (৩-২) দেয় ইতালিয়ানরা। সক্রেটিস আর ফ্যালকাওয়ের গোল ব্রাজিলকে রক্ষা করতে পারেনি সেদিন। এরপর সেমিফাইনালে পোল্যান্ডের বিপক্ষে ২ গোল এবং ফাইনালে পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে ১ গোল। সবমিলিয়ে ১৯৮২ বিশ্বকাপে পাওলো রোসি ৬টা গোল করেছিলেন ইতালির চরম প্রয়োজনের মুহূর্তে। সর্বোচ্চ স্কোরারের পাশাপাশি হয়েছিলেন বিশ্বকাপের সেরা তারকা। বিশ্বকাপ ছিল একটা মাধ্যম মাত্র। এরপর বহু বছরের জন্যই পাওলো রোসি বিশ্ব ফুটবলভক্তদের হৃদয়ে একটা স্থায়ী আসন পেতে নেন। ফিফার দৃষ্টিতে হয়ে উঠেন 'টপ ১২৫ গ্রেটেস্ট লিভিং ফুটবলার'দের একজন।
কিংবদন্তি হওয়ার জন্য যারা একটা মাত্র সুযোগকেই সফলভাবে লুফে নিয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম ইতালিয়ান স্ট্রাইকার পাওলো রোসি। জাতীয় দলের হয়ে ৪৮ ম্যাচে যার গোল সংখ্যা মাত্র ২০টি তার কিংবদন্তি হওয়ার আসলেই কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু কি দুর্দান্ত আত্দবিশ্বাসেই না তিনি সব বাধা অতিক্রম করেছিলেন! জেলখানার চৌহদ্দি পেরিয়ে কয়েদি রোসি হয়ে উঠেছিলেন নায়ক। ইতালির তৃতীয় বিশ্বকাপ জয়ের প্রধানতম তারকা।