ক্রিকেটবিশ্বে তখন একচ্ছত্র আধিপত্য ওয়েস্ট ইন্ডিজের। সাইক্লোন-টর্নেডোর তাণ্ডবে যেমন সাজানো গোছানো লোকালয়ও ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়ে যায় তেমনি ক্রিকেট মাঠে ক্যারিবীয় দলটিও প্রতিপক্ষের কাছে ছিল মূর্তিমান আতঙ্ক। প্রতিটি ম্যাচেই প্রতিপক্ষকে দুমড়ে-মুচড়ে দিত ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দলের ১১ ক্রিকেটারই শারীরিক গড়নে যেমন ছিলেন দৈত্যস্বরূপ তেমন পারফরম্যান্সে বিশ্বসেরা। কিন্তু এমন একটি দলের অধিনায়ক হয়েও ১৯৭৫ বিশ্বকাপে 'অস্বস্তিবোধ' করছিলেন ক্লাইভ লয়েড। প্রথম বিশ্বকাপ বলে কথা! 'প্রথম' শব্দটা সময়ই নার্ভাস করে দেয়!
বিশ্বকাপটা ওয়ানডে ফরম্যাটে বলেই খানিকটা ভয় কাজ করছিল লয়েডের মনে। কেননা নির্দিষ্ট দিনে খারাপ হতেই পারে পারফরম্যান্স। আর এক নকআউটে এক ম্যাচে ভালো করতে না পারলেই-স্বপ্নভঙ্গ। অবশ্য তখন ক্যারিবীয়দের যে দাপট ছিল, বিশ্বকাপটা ওয়ানডে না হয়ে টেস্ট হলে হয়তো টুর্নামেন্টের আগেই 'ট্রফি আমাদের' এমন একটা ঘোষণা দিতেন ক্লাইভ লয়েড! তাই ফাইনালে জয়ের আগ পর্যন্ত ক্যারিবীয় দলপতির মনে ভয় ছিল। কিন্তু শেষ ম্যাচে 'শ্বাসরুদ্ধকর' এক জয়ে ভয়কে চিরতরে কবর দিলেন-ই লয়েড। সাইক্লোন গতির এক সেঞ্চুরি করে নিজে হয়ে গেলেন প্রথম বিশ্বকাপের 'মহানায়ক'। জন্মভূমি ব্রিটিশ। গায়ানার মানুষদের কাছে লয়েডের নতুন পরিচয় 'দ্য লিজেন্ড'।
এক সেঞ্চুরি যে কিভাবে সব কিছু ওলটপালট করে দেয় তা ১৯৭৫ বিশ্বকাপের ফাইনালেই দেখেছিল ক্রিকেট দুনিয়া। দলের মহাবিপদের সময় ব্যাট হাতে ২২ গজে নেমে প্রতিপক্ষের আগুন ঝরা বোলিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে লয়েড ৮৫ বলে খেলেন ১০২ রানের ইনিংস। যে কারণে মাত্র ৫০ রানে তিন ব্যাটিং স্তম্ভ রয় ফ্রেডেরিকস, গর্ডন গ্রিনিজ এবং আলভিন কালীচরণ আউট হওয়ার পরও ২৯১ রানের বড় স্কোর পেয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ক্লাইভ লয়েডের ঝড়ো গতির সেঞ্চুরিটি এখনো ক্যারিবীয়দের কাছে 'মহাকাব্যিক সেঞ্চুরি' নামে পরিচিত। ১৯৭৫ বিশ্বকাপের ফাইনালে লর্ডসে করা লয়েডের সেই সেঞ্চুরিটি ক্রিকেট বিশ্বে এখনো 'ইউনিক'। যে সেঞ্চুরি ওয়েস্ট ইন্ডিজকে পরিয়ে দিয়েছিল প্রথম বিশ্বকাপের মুকুট।
৭৫'র বিশ্বকাপের প্রথম কয়েক ওভার খেলা দেখে ক্রিকেটভক্তরা ভেবেছিলেন সামর্থ্য থাকলেও ফাইনালে ভাগ্য বুঝি ক্যারিবীয়দের সহায় নেই। কিন্তু ভাগ্য যারা গড়তে জানে, তারা কি আর আরোপিত ভাগ্যে বিশ্বাস করে! লয়েড ব্যাট হাতে মাঠে নেমেই দাপুটে অসি বোলারদের তুলোধুনা করতে শুরু করেন। ১২টি বাউন্ডারি ও ২টি বিশাল ছক্কায় সেঞ্চুরি পূরণ করেন। বল হাতেও চমক দেখিয়েছেন ৬ ফুট ৪ ইঞ্চি উচ্চতার লয়েড। উইকেট মাত্র একটি পেলেও রান দেওয়ায় ভীষণ কিপটেপনা দেখিয়েছেন বলেই কিনা ১৭ রানে দারুণ এক জয় তুলে নিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। অলরাউন্ড পারফরম্যান্সের জন্য 'ম্যান অব ফাইনাল' হয়ে যান ক্যারিবীয় দলপতি।
প্রথম বিশ্বকাপে বিস্ময়কর সাফল্য পেয়েছেন অসি তারকা পেসার গেরি গিলমোরও। মাত্র দুই ম্যাচ খেলে ১১ উইকেট শিকার করে সিরিজের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি বোলারের পুরস্কার লাভ করেছিলেন। অথচ ডেনিশ লিলি, জেফ থমসন, ডগ ওয়াল্টারদের দলে প্রথমে জায়গাই হয়নি গিলমোরের। কিন্তু সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সুযোগ পেয়েই ৬ উইকেট নিয়ে সবাইকে অবাক করে দেন। ফাইনালেও তিনি নিয়েছিলেন ৫ উইকেট। ৩৩৩ রান করে প্রথম বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ব্যাটসম্যান হওয়ার গৌরব অর্জন করেন অস্ট্রেলিয়ার গ্লেন টার্নার। শেষ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার এই দুই তারকার সাফল্যও ম্লান হয়ে গিয়েছিল লয়েডের পারফরম্যান্সের কাছে। কেন না ব্যক্তিগত লড়াইয়ে ক্যারিশমা দেখানোর পাশাপাশি অধিনায়ক হিসেবে দলকে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন করা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়!