বৃহস্পতিবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

বিমানবন্দরে আটকে পড়াদের গল্প

আবদুল কাদের

বিমানবন্দরে আটকে পড়াদের গল্প

বিমানবন্দর কোনো আদর্শ্ব বাড়ি নয়। তবুও দুর্ভাগ্যবশত কিছু মানুষকে এখানে বাস করতে হয়েছিল দীর্ঘদিন। যদিও তারা কেউই বিমানবন্দরের কর্মী ছিলেন না। তবুও ভাগ্যের ফেরে বিমানবন্দরে কাটাতে হয়েছে দিনের পর দিন। প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের অভাবে হতে হয়েছিল ভোগান্তির শিকার। এমন কিছু মানুষের  আটকে পড়ার গল্প সম্পর্কে জানা যাক...

 

১৮ বছর কাটিয়ে দেন ১ নম্বর টার্মিনালে

দীর্ঘ ১৮ বছর, চার্লস ডি গল বিমানবন্দরের আগত যাত্রীরা প্রায়শই একটি দৃশ্য দেখতে পেতেন। এক নম্বর টার্মিনালে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন ইরানি এক ব্যক্তি। নাম মেহরান কারিমি নাসেরি। যিনি স্যার আলফ্রেড মেহরান নামেই সর্বাধিক পরিচিত। তার নিজের লেখা আত্মজীবনীমূলক বই ‘দ্য টার্মিনাল ম্যান’ প্রকাশের পর তিনি উঠে আসেন আলোচনায়। কেননা ২০০৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত, স্টিভেন স্পিলবার্গ পরিচালিত ১২৮ মিনিটের ‘দ্য টার্মিনাল’ সিনেমাটি তাকে নিয়েই নির্মিত। সিনেমায় অভিনয় করেছেন টম হ্যাঙ্কস। নাসেরি যুগোস্লাভ স্টাডিজ বিষয়ে পড়াশোনার জন্য ইউনিভার্সিটি অব ব্র্যাডফোর্ডে ভর্তি হন এবং তিন বছর যুক্তরাজ্যে বাস করেন। পড়াশোনা শেষে তিনি আবার নিজ দেশ ইরানে ফিরে আসেন। কিন্তু সে সময় ইরানে শাহদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলছিল এবং নাসেরিও সেই আন্দোলনে যোগদান করেন। ফলে ক্ষমতাসীনদের দাপটে নির্বাসিত হন নাসেরি। নির্বাসিত হয়ে বেশ কিছু দেশে আশ্রয়ের আবেদনও করেছিলেন তিনি। অধিকাংশ দেশের সরকার তাকে প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি বেলজিয়ামের ‘ইউনাইটেড নেশনস হাইকমিশনার ফর রিফিউজিস’ কর্তৃক শরণার্থীর মর্যাদা লাভ করেন। এর ফলে নাসেরি বেশ কিছু ইউরোপীয় রাষ্ট্রে বসবাসের যোগ্যতা অর্জন করেন। তাই তিনি যুক্তরাজ্যে বসবাসের জন্য মনস্থির করেন এবং ১৯৮৮ সালে যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। বিমানটি ফ্রান্স হয়ে যুক্তরাজ্যে পৌঁছাবে। কিন্তু পথিমধ্যে তিনি তার কাগজপত্র হারিয়ে ফেলেন, আর তার ব্রিফকেসও চুরি যায়। নাসেরি বিমানবন্দরে পৌঁছালে ব্রিটিশ ইমিগ্রেশন তাকে ফ্রান্সে ফেরত পাঠায়। কিন্তু ফ্রান্সে গিয়েও বৈধ কাগজপত্র দেখাতে ব্যর্থ হয়ে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। এমতাবস্থায় নিজ দেশ ইরানে ফিরে যাওয়ারও কোনো রাস্তা খোলা ছিল না, তাই তার থাকার মতো স্রেফ একটি জায়গাই অবশিষ্ট ছিল। সেটি হলো টার্মিনাল-১-এর ডিপার্চার লাউঞ্জ! এরপর বছরের পর বছর চলে যায়, নাসেরি স্থায়ীভাবে টার্মিনাল ১-এর ডিপার্চার লাউঞ্জে বসবাস করতে থাকেন। বিমানবন্দরে থাকাকালীন সময়গুলো তিনি নষ্ট করেননি। প্রতিদিন বই কিংবা সংবাদপত্র পড়ে সময় কাটাতেন, অর্থনীতি বিষয়ে অধ্যায়ন করে, ডায়েরি লিখে, বিমানবন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। এই বন্ধুরাই তাকে খাবার এবং অর্থ সরবরাহ করতেন। ২০০৬ সালে নাসেরি অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে। হাসপাতালে থাকাকালীন রেডক্রসের সদস্যরা তার সঙ্গে দেখা করেন।  পরে তাকে আর বিমানবন্দরে কাটাতে হয়নি।

 

অবৈধ কাজে অনীহা জানান হিরোশি নোহারা

২০০৮ সালে এনবিসি নিউজের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, রোগা চেহারা, এক গোছা দাড়ি আর ছিপছিপে গড়নের একটি লোক দীর্ঘদিন ধরে মেক্সিকোর বেনিতো জুয়ারেজ বিমানবন্দরের লেভওয়ারে বসবাস করছেন। জাপানিজ এই নাগরিকের নাম হিরোশি নোহারা। তিন মাস ধরে বেনিতো জুয়ারেজ বিমানবন্দরের ১ নম্বর টার্মিনালে খাচ্ছেন-দাচ্ছেন, ঘুমাচ্ছেন এমনকি গোসলটাও সেরে নিচ্ছেন। যদিও এর কোনো সঠিক কারণ দেখাতে পারেননি। বিমানবন্দরের ফাস্টফুড এবং যাত্রীদের দেওয়া খাবার খেয়ে জীবনধারণ করছিলেন এই ব্যক্তি। ২০০৮ সালে মেক্সিকো ভ্রমণের উদ্দেশ্যে একটি ফ্লাইটে চেপে বসেন। তাকে বহনকারী বিমানটি বিরতির উদ্দেশে মেক্সিকো শহরের বেনিতো জুয়ারেজ বিমানবন্দরে অবস্থান করে। সে সময় নোহারা বিমানবন্দরের আশপাশে ঘোরাফেরা করছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত নোহারাকে বহনকারী ফ্লাইটটি তাকে রেখে চলে যায়। হেঁয়ালিপনার কারণে তিনি ফ্লাইট ধরতে ব্যর্থ হন। তখন তার হাতে খুব বেশি টাকাকড়ি ছিল না। ছিল না বাড়ি ফেরার রিটার্ন টিকিটের খরচ। অগত্যা নোহারা বিমানবন্দরে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ তাকে স্থান ত্যাগের অনুরোধ জানালে তিনি টার্মিনাল ছেড়ে যেতে অস্বীকৃতি জানান। জাপানি ও মেক্সিকান দুই দেশের কর্মকর্তারাই তাকে বিমানবন্দর ত্যাগের অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু নোহারা বিমানবন্দর থেকে একচুলও নড়লেন না। নোহারা কোনো অবৈধ কাজ করতে নারাজ। অন্যদিকে অপরিচিত স্থান বলে নোহারা বেশ আতঙ্কিত ছিলেন, তবে বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা তাকে অভয় দেন। তারা তাকে খাবার এবং পানি দিয়ে সাহায্য করতেন। খবর ছড়িয়ে পড়লে হিরোশি নোহারা স্থানীয় সেলিব্রেটি বনে যান। পর্যটকরা তার সঙ্গে ছবি তোলেন। স্থানীয় চ্যানেলগুলো তার সাক্ষাৎকার নেয়।  তিন মাস পর ওয়াকি টুক নামের এক মহিলা তাকে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করলে তিনি বিমানবন্দর ত্যাগ করেন।

 

বিমানবন্দরে বিপাকে পড়ে আহমাদ পরিবার

সিরিয়া ও ইরাক যুদ্ধে পালিয়ে আসা একটি পরিবারের জন্য মস্কোর শেরেমেতিয়েভো বিমানবন্দরের টার্মিনাল ওয়েটিং লাউঞ্জ ছিল না, এটি তাদের বাড়িতে পরিণত হয়েছিল। হাসান আবদুল আহমাদ ও তার পরিবার দুই মাস ধরে বিমানবন্দরটির যাত্রীদের ওয়েটিং লাউঞ্জ এবং ধূমপানের স্থানে বসবাস করেছিলেন। বিপদে পড়েই ২০১৫ সালে দেশান্তরীর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন হাসান আবদুল আহমাদ পরিবার। তাই মস্কোর শেরেমেতিয়েভো বিমানবন্দরে চার সন্তান নিয়ে মানবেতর জীবন পার করেছিলেন আহমাদ ও তার স্ত্রী। আহমাদ তার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে সিরিয়ায় বসবাস করতেন। তাদের শহরে একাধিক আত্মঘাতী বোমা হামলায় গোটা শহরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরিবারটির চার সদস্যের ইরাকি পাসপোর্ট থাকলেও নতুন দুই সদস্যের ছিল না। আহমাদের সিরিয়ার নাগরিকত্বের সুবাদে তার পরিবারও সিরিয়ার নাগরিকত্ব পেয়েছিল। কিন্তু তারা রাশিয়ায় পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কেননা, আহমেদের স্ত্রী গুলিস্তান আহমাদের বোন রাশিয়ায় বসবাস করতেন। তাই তারা বোনের কাছে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। পরিবারটি রাশিয়ার ভিসা সংগ্রহ এবং রাশিয়ান ফ্লাইটে গন্তব্যে পৌঁছান। তারা ভেবেছিলেন ভিনদেশি শরণার্থী হওয়ার কারণে তারা বাড়তি সুবিধা পাবেন। কিন্তু বিমানটি রাশিয়ায় অবতরণের পরই বাধে বিপত্তি। রাশিয়ার বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ পরিবারটির সব সদস্যের ভিসা জাল বলে জানায়। রাশিয়ার মস্কো বিমানবন্দরেই আটকা পড়ে আহমাদ পরিবার। অবৈধভাবে রাশিয়ার সীমানা অতিক্রম করার অপরাধে পরিবারটির বিরুদ্ধে মামলাও হয়। আর রাশিয়া তাদের আশ্রয় দিতে অস্বীকৃতি জানায়। যদি তারা বিমানবন্দরের ট্রানজিট জোন অতিক্রম করেন তাহলে তাদের গ্রেফতার করা হতে পারে। এমনকি ছয় বছরের কারাদ-ও হতে পারে। এমতাবস্থায় পরিবারটি রাশিয়ায় থাকতেও পারছে না এবং অন্য কোনো দেশে ফিরেও যেতে পারছে না। তারা থাকার জন্য মস্কোর শেরেমেতিয়েভো বিমানবন্দরের যাত্রীদের ধূমপানের লাউঞ্জটি বেছে নেয়। এর পাশেই ছিল যাত্রীদের ওয়েটিং লাউঞ্জ। কাচের লাউঞ্জের ভিতরে তাদের পার করতে হয়েছিল দিনের পর দিন। অপরিচিত দেশ অপরিচিত অঞ্চল। বেঁচে থাকার জন্য কুর্দি পরিবারটিকে অপরিচিত লোকদের ওপর নির্ভর করতে হয়েছিল। বিমানবন্দরে আগত যাত্রীরা তাদের খাবার, পানি, টাকা ও ছোট ছোট সন্তাদের জন্য খেলনা সামগ্রী উপহার দিয়ে যেত। এখানে তাদের জীবনযাত্রার মান দিন দিন খারাপ হতে লাগল। আহমাদের স্ত্রী গুলিস্তান অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। দুজন পুলিশ সদস্য হাসপাতালের কেবিনে সব সময় তাদের নজরবন্দি করে রাখত। পরিবারটির প্রতি এক দয়ালু লোক সাহায্যের হাত বাড়ান। কাছাকাছি হোটেলে তাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। এদিকে সিরিয়া থেকে আহমাদ পারিবারের পাসপোর্ট বৈধ বলে জানায়। পরে রাশিয়া পরিবারটিকে শরণার্থী হিসেবে তাদের দেশে প্রবেশের অনুমতি দেয়। ৪৫ দিন বিমানবন্দরে থাকার  পর পরিবারটি অবমুক্ত হয়।

 

১৩ মাস পর ব্রিটিশ নাগরিকত্ব পেয়েছিলেন সঞ্জয়

সঞ্জয় শাহ, কেনিয়ার প্রাক্তন নাগরিক। তা সত্ত্বেও সঞ্জয় ১৩ মাসেরও বেশি সময় নাইরেবির জোমো কেনিয়াত্তা বিমানবন্দরে বসবাস করেছিলেন। ২০০৪ সালে সঞ্জয় কেনিয়ান পাসপোর্ট ছেড়ে যুক্তরাজ্যে বসবাসের উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন। যদিও তিনি আশা করেছিলেন ব্রিটিশ সরকার তাকে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমোদন দেবে। কিন্তু তা হয়নি, যুক্তরাজ্য কর্তৃপক্ষ তাকে অস্থায়ীভাবে প্রবেশের অনুমতি দেয়। আর সেই অস্থায়ী মেয়াদ শেষে যুক্তরাজ্য কর্তৃপক্ষ তাকে কেনিয়ায় ফেরত পাঠিয়ে দেয়। কেনিয়ার নাইরেবি বিমানবন্দরে সঞ্জয় প্রায় ৪০০ দিন অতিবাহিত করেন এবং সেখানে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য বিক্ষোভ করেছিলেন। যদিও সঞ্জয় সে সময় ভিনদেশি নাগরিক হিসেবে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব (পাসপোর্ট) পাওয়ার যোগ্য ছিলেন। কেননা তার জন্মের সময় কেনিয়া রাষ্ট্র ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীন ছিল। সে সুবাদে সঞ্জয়ও সম্পূর্ণ ব্রিটিশ নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেছিলেন। কিন্তু তিনি তার একটি ভুলের কারণে বাধে বিপত্তি। ভেস্তে যায় ব্রিটিশ নাগরিকত্বের স্বপ্ন। ২০০৪ সালে সঞ্জয় যুক্তরাজ্য ছাড়ার আগে ব্রিটিশ নাগরিকত্বের প্রয়োজনীয় কাগজপত্রগুলো ঠিকঠাক পূরণ করেননি। শুধু তাই নয়, কোনো প্রকার রিটার্ন টিকিট ছাড়াই তিনি কেনিয়ায় প্রবেশ করেছিলেন। সে সময় তার হাতে সামান্য কিছু টাকা অবশিষ্ট ছিল। তিনি ভেবেছিলেন যুক্তরাজ্যে ফিরতে পারবেন কিন্তু তা আর হলো না। অন্যদিকে কেনিয়া সরকারও ইতিমধ্যে তার নাগরিকত্ব বাতিল করেছিল। কারণ কেনিয়ার সরকার একসঙ্গে দুই দেশের নাগরিকত্ব দিতে নারাজ। তাই সঞ্জয় দেশ ছাড়ার আগে তার কেনিয়ান পাসপোর্ট কেনিয়া সরকারের কাছে সমর্পণ করেছিলেন। তিনি কেনিয়ার নাইরেবির জোমো কেনিয়াত্তা বিমানবন্দরে প্রবেশ করলে তাকে বিমানবন্দর থেকে বের হতে দেওয়া হয়নি। বিমানবন্দরের আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন লাউঞ্জই ছিল তার আশ্রয়স্থল। এখানেই খাওয়া-দাওয়া, এখানেই ঘুম। গোসল সেরে নিতেন যাত্রীদের ব্যবহৃত শৌচাগারে। সঞ্জয় বিমানবন্দরে আটকে থাকার সময় ক্যাফে ও শৌচাগার পরিষ্কারের কাজ করেছিলেন। ক্যাফে আর যাত্রীদের দেওয়া খাবার খেয়ে থাকতেন তিনি। ২০০৫ সালে ব্রিটিশ সরকার সঞ্জয় শাহকে নাগরিকত্ব দেয়, তারপর ব্রিটিশ পাসপোর্টসহ তিনি স্থায়ী বসবাসের জন্য যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান।

 

স্বামীর মৃত্যুর আদেশ শুনে দেশান্তরী হন জাহরা

২০০৪ সাল, ইরানে তখন চলছিল সরকারবিরোধী বিক্ষোভ। সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন জাহরা কামালফার ও তার স্বামী। পুলিশ তাদের দুজনকে গ্রেফতার করে। দুই বছর পর পরিবারের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পান জাহরা কামালফার। এর কিছু দিন পর ছাড়াও পেয়েছিলেন এই নারী। কিন্তু ইরান সরকার তার স্বামীকে ফাঁসির আদেশ দেয়। এই সংবাদে জাহরা দুই সন্তানকে নিয়ে দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। জাহরা কামালফার জাল পাসপোর্ট নিয়েই কানাডার উদ্দেশে রওনা করেন। সেখানে তার ভাই তার জন্য অপেক্ষা করছিল। জাহরা ও তার সন্তানদের বহন করা ফ্লাইটটি রাশিয়া ও জার্মানি হয়ে কানাডা পৌঁছাবে। জাল পাসপোর্ট দিয়ে রাশিয়ার বিমানবন্দর পার হলেও জার্মানির বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের আটকে দেয়। জার্মান কর্তৃপক্ষ জাহরা ও তার সন্তানদের রাশিয়ায় ফেরত পাঠায়। রাশিয়াও তাদের ইরানে ফেরত পাঠিয়ে দিতে চাইলে জাহরা অস্বীকৃতি জানান। পরে রাশিয়ার বিমানবন্দর কর্মকর্তারা জাহরা ও তার সন্তানদের বিমানবন্দরের টার্মিনালে অবস্থানের অনুমতি দেয়। এখানে তাদের জীবন ছিল বেশ কঠিন। মেঝেতে ঘুমানো, যাত্রীদের ব্যবহৃত শৌচাগারে গোসল আর প্রয়োজনীয় কাপড় বদল। যাত্রীদের দেওয়া খাবারই ছিল শেষ সম্বল। অনেক সময় খাবারের অভাবে শুধু পানি পান করেই থাকতে হয়েছিল দিনের পর দিন। এমনি কঠিন দিন যাপনের পর জাহরা ‘ইউনাইটেড নেশনস হাই কমিশনার ফর রিফিউজিস’-এ শরণার্থী হওয়ার জন্য আবেদন করেন। দীর্ঘ ১০ মাস বিমানবন্দরে মানবেতর জীবযাপনের পর জাহরা ও তার সন্তান জাতিসংঘের শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি পান। পরে কানাডায় চলে যান।

 

জোরপূর্বক আটকে রাখা হয়েছিল ডি জ্যাকসকে

ডি জ্যাকস, ২০১২ সালে মরোক্কোতে শরণার্থী হিসেবে বসবাসের সুযোগ পান। সে সময় আইভরি কোস্টে অভ্যন্তরীণ সংকট চলছিল। বেশ কয়েক মাসের যাত্রা শেষে ডি জ্যাকস মরোক্কো এসে পৌঁছে ছিলেন। সেখানে তার দেশের পরিচিতরা ‘ইউনাইটেড নেশনস হাইকমিশনার ফর রিফিউজিস’-এ নিবন্ধনের জন্য উৎসাহিত করে। ডি জ্যাকসও শরণার্থী হিসেবে বসবাসের আবেদন করেন। ‘ইউনাইটেড নেশনস হাইকমিশনার ফর রিফিউজিস’ তার আবেদন মঞ্জুর করে। ডি জ্যাকস মরোক্কোয় বসবাস শুরু করেন। কিন্তু বছর দুয়েক না পেরোতেই তিনি মরোক্কো সরকারের কাছে দেশত্যাগের অনুমতি প্রার্থনা করেন যা মরোক্কোর সরকারও মঞ্জুর করেছিল। ডি জ্যাকস মাউরিটানিয়ায় চার দিনের ভ্রমণ শেষে যখন ফিরবেন, তখন মরোক্কোতে ফিরে যাওয়ার কোনো অনুমতি ছিল না ডি জ্যাকসের। ফলে মাউরিটানিয়া বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ তাকে ট্রানজিট জোন ত্যাগের অনুমতি দেয়নি। তার লাগেজও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ আটক করে রেখেছিল। ফলে বিমানবন্দরেই আটকা পড়েন ডি জ্যাকস। বিমানবন্দরের ট্রানজিট জোনে বসবাসে বাধ্য হন তিনি। তখন তার হাতে মাত্র ১০০ ওগুইয়া (টাকা) অবশিষ্ট ছিল, যা সপ্তাহ তিনেক না যেতেই শেষ হয়ে যায়। বিমানবন্দরের কর্মচারীরা ডি জ্যাকসকে খাবার আনা- নেওয়ার কাজ দেয়। সৌভাগ্যক্রমে ডি জ্যাকস একবার বিমানবন্দরের কম্পিউটার রুমে প্রবেশ করে এক নিকতাত্মীয়ের কাছে ম্যাসেজ পাঠান। তারপর আইনজীবী আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে তাকে মুক্ত করেন। ৪৩ দিন বন্দী থাকার পর মুক্তি পান ডি জ্যাকস।

 

বিমানবন্দরই অ্যান্থনির শেষ আশ্রয়স্থল

২০০৪ সালে অ্যান্থনি ডিলেন্সি শেফের চাকরি হারিয়ে গৃহহীন হয়ে পড়েন। বারবার চাকরির চেষ্টা করেও মেলাতে পারেননি কোনো কর্মসংস্থান। ৪৩ বছর বয়সী অ্যান্থনি গৃহহীন আর বেকারত্বের কারণে হতাশায় ভুগতে থাকেন। সরকারিভাবে ২৩৬ ইউরো ভাতা পেলেও বসবাসের স্থান না থাকায় গ্যাটইউক বিমানবন্দরের দক্ষিণ টার্মিনালে আশ্রয় নেন। সেখানে খাওয়া-দাওয়া করতেন, সেখানেই ঘুমাতেন। সারা দিন চাকরির সন্ধান করতেন, আর অন্ধকার নামলেই আশ্রয় নিতেন বিমানবন্দরে। এক বছর বিমানবন্দরে বসবাসের পর বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ তাকে বের করে দেয়। কিন্তু অ্যান্থনি নিষেধ অমান্য করে আবারও বিমানবন্দরে অবস্থান করলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। প্রথমবার আদালত অ্যান্থনিকে ছেড়ে দিলেও দ্বিতীয়বার আর রেহাই হয়নি। ২০০৬ সালে বিমানবন্দরের দোকান আর এক জাপানি যাত্রীর লাগেজ চুরির অভিযোগে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। আদালত তাকে ১৫ মাসের জেল দেয়। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর অ্যান্থনি আবার বিমানবন্দরে আশ্রয় নেন। কিছুদিন পর তৃতীয়বারের মতো আইন ভঙের অভিযোগে আদালত তাকে ৯৫ দিনের জেল দেয়। তবে সেবার জরিমানা দিয়ে পার পান অ্যান্থনি। চতৃর্থবারের মতো পুলিশ তাকে গ্রেফতার করলে, গ্যাটউইক বিমানবন্দরের আশপাশে দেখা গিয়েছিল বলে জানিয়েছিল রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী। সে যাত্রায় বাঁচার জন্য তাকে কাজের সন্ধান আর অন্য কোথাও বসবাসের প্রমাণ দেখাতে হয়েছিল। অ্যান্থনির আইনজীবী জানান, বেকারত্ব এবং গৃহহীনতার কারণে তিনি ‘দুষ্টচক্রের’ জালে আটকা পড়েন। তবে বিমানবন্দর থেকে দূরে ছিলেন।

 

বহুবার চেষ্টা করেও দেশে ফিরতে পারেননি ঝেংজুহ

চীনের নাগরিক ফেং ঝেংজুহ। একজন মানবাধিকার কর্মী হিসেবে ব্যাপক পরিচিত। শুধু তাই নয়, তিনি চীনের একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। এত সব পরিচয় থাকার পরও জাপানের বিমানবন্দরে আটকা পড়েছিলেন ফেং ঝেংজুহ। ২০০৯ সালে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে জাপানে পাড়ি দিয়েছিলেন তিনি। চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে আসতে চাইলে চীন সরকার তাকে দেশে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। চীন কর্তৃপক্ষ তাকে জাপানে ফেরত পাঠান। অগ্যতা মানবাধিকার কর্মীকে ফিরে যেতে হয় জাপান। কিন্তু সেখানেও তাকে বিমানবন্দরের লাউঞ্জ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করে জাপান কর্তৃপক্ষ। সেখান থেকে চীনের এই নাগরিক নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য একবার নয়, দুবার নয়, আটবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বারবারই চীন সরকার তাকে ফিরিয়ে নিতে অস্বীকৃতি জানায়।  ফেং ঝেংজুহকে চারবার নিজ দেশ চীন ফেরত পাঠায়। আর চারবার অন্য দেশগুলো তাকে ফেরত পাঠায়। শেষ চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ায় যত দিন পর্যন্ত না তাকে দেশে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয় তত দিন পর্যন্ত তিনি জাপানের বিমানবন্দরেই থাকবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। ফলে জাপানের বিমানবন্দরই ছিল ঝেংজুহের শেষ আশ্রয়স্থল। ঝেংজুহ বেশ কিছুদিন শুধু পানি খেয়ে দিন পার করেছিলেন। কারণ তার কাছে চীনা নোট ছাড়া কিছুই ছিল না। তাই জাপানিরা চীনা টাকায় খাবার দিতে নারাজ। তবে বিমানবন্দরে আগত অনেক যাত্রী তাকে খাবার দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন। যদিও ঘুমের জন্য স্টিলের বেঞ্চই ছিল একমাত্র ভরসা। খুব সামান্য সময়ই বিশ্রামের সুযোগ পেতেন ঝেংজুহ। কারণ বিমানবন্দরটি গুরুত্বপূর্ণ রুট হওয়ার কারণে ভীষণ ব্যস্ততম এলাকা ছিল সেটি। অবশেষে ৯২ দিন পর চীন সরকার তাকে দেশে ফেরার অনুমতি দেয়। আর ঝেংজুহ দেশে ফিরে আসেন।

 

প্রেমের টানে কাজাখস্তানে আটকা পড়েন আল-বাহিশ

প্রেমের টানে ভিনদেশে পাড়ি দেওয়ার অসংখ্য নজির রয়েছে। কিন্তু প্রেমের টানে ভিনদেশে গিয়ে আটকা পড়ার ঘটনা কয়টা রয়েছে! তেমনি একটি ঘটনার ভুক্তভোগী মোহাম্মেদ আল-বাহিশ। প্রেমের টানে কাজাখস্তানের বিমানবন্দরে চার মাসেরও বেশি সময় অবস্থান করেছিলেন। ২০১৩ সালে বাহিশের সঙ্গে কাজাখস্তানের একটি মেয়ের পরিচয় হয়। পরিচয় থেকে প্রেমে পড়া, আর সেই প্রেমের টানে কাজাখস্তান ছুটে যান আল বাহিশ। আর সেখানে গিয়ে সেই মেয়েকে বিয়েও করেছিলেন তিনি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আল-বাহিশ কাজাখস্তানে তার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র হারিয়ে ফেলেন। একই সঙ্গে কাজাখস্তান অ্যাম্বাসির দেওয়া ভিসার মেয়াদও শেষ হয়ে গিয়েছিল আল-বাহিশের। ভিসার মেয়াদ বাড়াতে তিনি তুরস্কে যেতে চান। কিন্তু তাকে সেখানে যেতে দেওয়া হয়নি। এদিকে ভিসা না থাকায় কাজাখস্তানেও ঢুকতে পারছিলেন না তিনি। আল-বাহিশ অন্য কোথাও যেতে না পেরে কাজাখস্তানের আলমাতি বিমানবন্দরেই দীর্ঘদিন আটকা পড়েছিলেন। কোনো উপায় না পেয়ে বিমানবন্দরে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন। বিমানবন্দরের ছোট্ট একটি রুমে তাকে থাকতে দেয় বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। ছোট্ট সেই রুমটিতে ছিল না কোনো জানালা, ছিল কেবল একটি বেড আর একটি সোফা। নিরাপত্তাকর্মীরা সারাক্ষণ তাকে নজরবন্দি করে রেখেছিলেন। খুব কম সময়ের জন্য আল-বাহিশ রুমের বাইরে বোরোনোর সুযোগ পেতেন। এমনিভাবে মানবেতর জীবনযাপনের পর চার মাস পর আল-বাহিশকে রোমানিয়ার টিমিসোয়ারাতে ‘ইউনাইটেড নেশনস হাইকমিশনার ফর রিফিউজিস’ শরণার্থী ট্র্যানজিট সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে ফিনল্যান্ড তাকে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয়ের প্রস্তাব দেয়। আল- বাহিশ সুযোগটি হাতছাড়া করতে চাননি। ফিনিশ ভাষা শিখে স্ত্রীসহ ফিনল্যান্ড পাড়ি জমান।

সর্বশেষ খবর