রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বর্বরতা অব্যাহত থাকায় দেশটির কঠোর সমালোচনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ফ্রাঞ্চ, সুইডেন, নেদারল্যান্ড, পল্যান্ড, বলিভিয়াসহ ১২টি দেশ।
গতকাল মঙ্গলবার সকাল সোয়া ১০টা থেকে বেলা দেড়টা পর্যন্ত নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদের উম্মুক্ত আলোচনায় এ সমালোচনা করেন দেশগুলোর স্থায়ী প্রতিনিধিরা।
মিয়ানমার সরকার অস্বীকার করলেও প্রাণ বাঁচাতে এখনও রোহিঙ্গারা পালিয়ে বাংলাদেশে আসছেন বলে উল্লেখ করেন সকলেই। সভাপতিত্ব করেন কুয়েতের রাষ্ট্রদূত শেখ সাবাহ খালিদ আল হামাদ।
এ আলোচনার সূচনা ঘটান জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক হাই কমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্দি সুইজারল্যান্ডের জেনেভা থেকে ভিডিও কনফারেন্সে মিয়ানমারে রাখাইন সম্প্রদায়ের নিরাপদ জীবনযাপনের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রতিধ্বনি ঘটিয়ে ফিলিপ্পো গ্র্যান্দি বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে সৃষ্ট এ সংকটের সমাধান মিয়ানমারকেই করতে হবে’। এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে গ্র্যান্দি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি ঘটালেন। গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের বক্তব্যে শেখ হাসিনা এ কথা বলেছিলেন।
গত ৬ মাসে ৬ লাখ ৮৮ হাজারেরও অধিক রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ আশ্রয় দেয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে গ্র্যান্দি বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, শরণার্থীদের নিরাপদে নিজ আবাস ভূমিতে প্রত্যাবর্তনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আন্তরিক অর্থে সোচ্চার হওয়া দরকার।
জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক সহকারি মহাসচিব মিরোস্ল্যাভ জেনকা ৩টি পয়েন্ট উল্লেখ করেছেন।
১. রাখাইন প্রদেশে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের অবসান ঘটিয়ে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে হবে।
২. রাখাইনের বর্তমান অবস্থা কি তা জাতিসংঘের পক্ষে এখনও জানা সম্ভব হয়নি। কারণ, সেই প্রদেশে জাতিসংঘের লোকজন, মিডিয়া এবং স্বেচ্ছাসেবকরা এখনও অবাধে ঢুকতে পারছেন না। এমন অবস্থার অবসান দরকার।
এবং ৩. নিজ আবাসস্থলে নিরাপদে ফিরে স্বাভাবিক জীবন-যাপনের গ্যারান্টি দিতে হবে মিয়ানমারকে।
মিরোস্ল্যাভ বলেন, ইতিমধ্যেই ঘটে যাওয়া নৃশংসতার অনেক ঘটনাই ধামাচাপা দেয়ার অপচেষ্টা করা হচ্ছে। এখনো যারা পৈত্রিক ভিটেমাটি আঁকড়ে রাখার চেষ্টায় রয়েছেন, সেই রোহিঙ্গারা কী ধরনের হুমকি-ধামকি সহ্য করছেন, সেটিও খতিয়ে দেখার অবকাশ রয়েছে। কারণ, রাখাইন প্রদেশ থেকে এখনো রোহিঙ্গারা ভিটে-মাটির মায়া ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছেন বাঁচার প্রয়োজনে।
যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি নিকি হ্যালি, যুক্তরাজ্যের প্রতিনিধি মার্ক ফিল্ড, রাশিয়া ফেডারেশনের সার্জেই লেভরব, পোল্যান্ডের এন্ড্রেজেজ ডুডা, কাজাকিস্তানের নূরসুলতান নজরবায়েভ, সুইডেন, ফ্রাঞ্চের স্থায়ী প্রতিনিধিরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুধাবন করে দ্রুত এর অবসান ঘটাতে সকলকে আন্তরিক অর্থে কাজ করতে হবে।
নিকি হ্যালি অত্যন্ত জোরালোভাবে গ্রেফতারকৃত দুই সাংবাদিকের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানান এবং মিয়ানমারে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। সাংবাদিকরা স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ না পাওয়া পর্যন্ত রাখাইন প্রদেশের প্রকৃত চিত্র জানা কারো পক্ষেই সম্ভব হবে না বলে মন্তব্য করেন নিকি হ্যালির সাথে বৃটেনের প্রতিনিধিও।
সকলেই কফি আনান কমিশনের পূর্ণ বাস্তবায়ন চান। এছাড়াও হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের লোকজনকে সরেজমিনে অবাধে প্রবেশাধিকার দেয়ার কথা বলেন সকলে। উল্লেখ্য, সামনের মাসেই এই কাউন্সিল রাখাইন পরিস্থিতির আলোকে একটি রিপোর্ট দেবে জাতিসংঘে।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন বলেছেন, মিয়ানমার সরকার দুটি অভ্যর্থনা কেন্দ্র খুলেছে এবং শিবিরও স্থাপন করেছে। কিন্তু কার্যত কিছুই রোহিঙ্গাদের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হচ্ছে না। রোহিঙ্গারা নাগরিক অধিকারসহ নিরাপদে নিজ পৈত্রিক আবাসে ফিরে চাষাবাদ করতে চায়। অবাধে চলাফেরা ও সভা-সমিতি করার অধিকার চায়। এগুলো মৌলিক অধিকার বিধায় বিশ্বসভাকে তা বিবেচনা করতে হবে। রাষ্ট্রদূত মাসুদ বলেন, নিরাপত্তা পরিষদ খুবই গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেই এ আলোচনার পর শুধুমাত্র সদস্যদের জন্য আরেকটি রুদ্ধদ্বার বৈঠক করছে। সেখান থেকেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত আসবে বলে আশা করছি।
বাংলাদেশ সবসময় নিকট প্রতিবেশী হিসেবে মিয়ানমারের সাথে বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্ক অব্যাহত রাখতে বদ্ধ পরিকর বলে উল্লেখ করেন রাষ্ট্রদূত মাসুদ।
রয়টার্সের দুই সাংবাদিকের মুক্তির প্রসঙ্গ প্রায় সকলের বক্তব্যে এলেও মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত কিয়াও টিন সে তথ্য অস্বীকার করে বলেন, কোন সাংবাদিক অপহৃত হওয়ার তথ্য মিয়ানমার সরকারের জানা নেই। মিয়ানমার রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বলেও দাবি করেন এই রাষ্ট্রদূত।
জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসনের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা পরিষদ অব্যাহত ভূমিকা পালন করবে বলে বাংলাদেশ আশা প্রকাশ করেছে।
যুক্তরাজ্যসহ বেশ কিছু সদস্য রাষ্ট্রের অনুরোধে নিরাপত্তা পরিষদে কুয়েতের সভাপতিত্বে মিয়ানমারের উপর এ বছরের প্রথম উন্মুক্ত সভা ১৩ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার সকালে অনুষ্ঠিত হয়।
রাষ্ট্রদূত মাসুদ রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত বিভিন্ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরেন।
এ সময় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য উদ্ধৃত করে রাষ্ট্রদূত মাসুদও বলেন, “এই সংকটের শিকড় মিয়ানমারে এবং এর সমাধানও মিয়ানমারে নিহিত”।
দুঃস্থ রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতার বিষয়টি স্মরণ করেন বাংলাদেশের এই কূটনীতিক। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, জাতিসংঘ মহাসচিবের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত শিগগিরই নিয়োগ করা হবে এবং তাঁর মাধ্যমে মিয়ানমার সরকারের সাথে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতার ক্ষেত্র আরও সম্প্রসারিত হবে।
সভায় নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্য রাষ্ট্রের সকলেই প্রায় ৭ লক্ষ বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের সাময়িক আশ্রয় দেবার জন্য বাংলাদেশ সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তারা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সম্প্রতি স্বাক্ষরিত দ্বি-পাক্ষিক চুক্তির বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন। এছাড়াও তারা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে মিয়ানমারে প্রয়োজনীয় সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টিতে মিয়ানমারকে সহযোগিতার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানান।
পরিষদের কতিপয় সদস্য কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে মিয়ানমারের অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দেন এবং রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয়াসহ অন্যান্য অঙ্গীকার বাস্তবায়নে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেবার জন্য মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানান।
উত্তর রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা গ্রামসমূহে গণ কবর উদ্ধার, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি তৈরির খবরে নিরাপত্তা পরিষদের বেশ কিছু সদস্য গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। এজন্য দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা ও দুর্গত রোহিঙ্গাদের কাছে নির্বিঘ্নে মানবিক সাহায্য পৌঁছানোর জন্য তারা মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানান।
বিডি-প্রতিদিন/১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮/মাহবুব