চীনা সামগ্রীর মতোই বন্ধুত্বও বেশি দিন টেকে না। তাই শ্রীলঙ্কার সঙ্গে শুরু স্বার্থ-সংঘাত। দুই দেশের মধুচন্দ্রিমার দিন বোধহয় শেষ। শ্রীলঙ্কা বুঝতে পেরেছে, চীনের বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) আসলে ঋণের ফাঁস। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার রপ্তানিকৃত জৈব রাসয়নিক সারকে নিম্নমানের তকমা লাগিয়ে চীনা সংস্থা বাতিল করে দেওয়াতেও ক্ষিপ্ত কলম্বো।
অন্যদিকে, চীন রাসায়নিক সার রপ্তানিতে রাজি হচ্ছে না। সম্পর্কের টানাপোড়েনে কলম্বোকে ঋণ পরিশোধের জন্য চাপ দিতে শুরু করেছে বেইজিং। দ্বীপ রাষ্ট্রটি চরম অর্থসঙ্কটে ভুগলেও চীন নিরব। কারণ চীনা সংস্থাগুলো শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারির দাবি তুলেছে।
যে দেশগুলো আন্তর্জাতিক দুনিয়ার চোখে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে কলঙ্কিত, আসলে চীন সব সময়ই নিজেদের লাভের জন্য তাদের দিকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। মিয়ানমারের জুন্তা সরকার বা তালেবানদের দখল করা আফগানিস্তানে তাদের সক্রিয়তা উদাহরণ মাত্র। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী গণতান্ত্রিক সরকারকে ফেলে দিয়ে সাধারণ মানুষের ওপর বর্বরতা বা আফগানিস্তানে নারীদের স্বাধীনতা হরণ করে তালেবানদের নৃশংসতাতেও তাই বেইজিং অন্ধ। তারা ব্যস্ত নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিতে। দুর্বল দেশগুলোর প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠন কমিউনিস্ট শাসিত চীনা পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি। বহু দেশকে ঋণের ফাঁদে জড়িয়েছে। ইসলামিক দুনিয়াতেও নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে সচেষ্ট চীন। অথচ চীনে উইঘুর মুসলিমরা গণহত্যার শিকার।
লিবারেশন অফ তামিল টাইগার ইলম (এলটিটিই)-এর বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর নামে ব্যাপক হারে মানবাধাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে শ্রীলঙ্কা যখন আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় এক ঘরে, তখনই জেগে ওঠে তাদের কলম্বো-প্রেম। জাতিসংঘ বা পশ্চিমা দুনিয়ার সমালোচনাকে তোয়াক্কা না করে তারা অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা দিয়ে শ্রীলঙ্কার ঘাতক সরকারের পাশে দাঁড়ায়।
অন্যদিকে, চীন যুদ্ধবিমান থেকে শুরু করে বিভিন্ন অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রের পাশাপাশি ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দিয়ে সাহায্য করে শ্রীলঙ্কাকে।
আসলে ভারত মহাসাগরের বুকে শ্রীলঙ্কার অবস্থানগত কারণে সেখানে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় মরিয়া চীন। শ্রীলঙ্কায় পারিবারিক শাসনকালেই কৌশলগত স্বার্থে সেখানে ভাগ বসাতে শুরু করে বেইজিং। আজও একই কৌশল চীনের। নিজের দেশের নিরীহ মানুষদের হত্যায় চীনের সহায়তা পেলেও এখন স্বার্থে আঘাত লাগাতেই বেঁকে বসছে শ্রীলঙ্কা। তাছাড়া সেখানকার সাধারণ মানুষও চাইছে না চীনের দখলদারি। তাই চীনা-ফাঁদ থেকে বার হতে চাইছে শ্রীলঙ্কা।
শ্রীলঙ্কা তাদের নৌ-বাহিনীকে দিয়ে চীনের তৈরি হাম্বানটোটা নৌ-বন্দরে নজরদারিতে নজরদারি শুরু করেছে। ২০১৮ সালে রয়টারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের আশঙ্কাকে গুরুত্ব দিয়ে গালে থেকে হাম্বানটোটায় শ্রীলঙ্কা নৌ-সেনার ঘাঁটি ফিরিয়ে এনেছে। তাদের সতর্কবার্তা ছিল, এশিয়া ও ইউরোপের সঙ্গে যোগাযোগের মূল নৌপথে হাম্বানটোটায় চীন নৌ-সেনার ঘাঁটি গড়ে তুললে হাম্বানটোটার নিয়ন্ত্রণ নাও থাকতে পারে শ্রীলঙ্কার।
২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক স্তরে প্রায় একঘরে শ্রীলঙ্কা সফরে যান চীনা রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং। তার সফরকালেই প্রচুর চীনা ঋণ এবং বিনিয়োগের সূচনা হয়। হাম্বানটোটা বন্দরের উন্নয়নে চীনা বরাতের বিষয়টিও চূড়ান্ত হয় তখনই। ৯৯ বছরের লিজ নিশ্চিত করে ঋণের ফাঁদে ফেলে হাম্বানটোটায় নিজেদের দখলদারি মজবুত করে চীন। ১.২ বিলিয়ন ডলারের ঋণ অদলবদল চুক্তির সমালোচনায় সরব শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক নেতা ও অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। কারণ বিপুল ঋণের বোঝা শ্রীলঙ্কার মতো ছোট অর্থনীতির দেশের পক্ষে পরিশোধ করা সম্ভবই নয়। শ্রীলঙ্কার নাগরিকরাও বুঝেছেন, পরিকাঠামো বানানোর নামে নিজেদের দখলদারি মজবুত করতে চাওয়াটাই চীনাদের উদ্দেশ্য। ফাটল ধরে সম্পর্কে।
এবছর জানুয়ারির মাঝামাঝি চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই শ্রীলঙ্কার সঙ্গে সম্পর্কে মেরামতির উদ্দেশে কলম্বো গিয়েছিলেন। শ্রীলঙ্কার সরকারিভাবে জানিয়েছে, বৈঠকে রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপক্ষ বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটিয়ে উঠতে বৈদেশিক ঋণ পুনঃনির্ধারণের বিষয়টি তোলেন। কিন্তু ওয়াং বিষয়টি এড়িয়ে যান। চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রকের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন বলেছেন, শ্রীলঙ্কার আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে সাধ্যমতো চেষ্টা চলছে। ভবিষ্যতেও সেই প্রক্রিয়া চলবে। তবে বর্তমান অর্থনৈতিক সঙ্কটমোচনে জরুরি সাহায্যের বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছেন।
শ্রীলঙ্কাকে অবিলম্বে ২ বিলিয়ন ডলার চীনকে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। আন্তর্জাতিক দুনিয়া নিশ্চিত, ঋণশোধের ক্ষমতা তাদের নেই। গত ডিসেম্বরে শ্রীলঙ্কার বিদেশী মুদ্রা মজুদ ছিল মাত্র ১ বিলিয়ন ডলার। আন্তর্জাতিক সংস্থা ফিচ শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে 'সিসিসি' থেকে 'সিসি'তে নামিয়ে এনেছে। বিদেশি মুদ্রার অভাবে ব্যাপক সঙ্কট দেখা দিয়েছে দ্বীপরাষ্ট্রটিতে। আমদানির অভাবে রান্নার গ্যাসের পাশাপাশি বিদ্যুত সঙ্কটেও জর্জরিত তারা।
চীনা সংস্থা গুলির শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার দাবি মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাসয়নিক সার না নেওয়ায় শ্রীলঙ্কার চা আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি চইছে চীনের বায়োটেক কোম্পানি। শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ন্যাশনাল প্ল্যান্ট কোয়ারেন্টাইন সার্ভিসের সুপারিশে ২০ হাজার টন সার আমদানি বাতিল করে শ্রীলঙ্কা। বিবিসি-র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আলু বা গাজর চাষের পক্ষে সর্বনাশা ব্যাক্টেরিয়া মিলেছে সেই সারের নমূনায়। শ্রীলঙ্কা ৬.৭ মিলিয়ন ডলার ফেরত দিতে চেয়েছিল। তবু শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধা চাইছে চীনা সংস্থাগুলি।
সমুদ্রের পারে নতুন নগরী গড়ার নামেআসলে ভারত মহাসাগরে চীন নিজেদের নিয়ন্ত্রণ আরও বাড়িয়ে তুলতে চাইছে। শ্রীলঙ্কার স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে চীনের এই প্রচেষ্টার তাই শুরু হয়েছে কঠোর বিরোধিতা। চীনও মরিয়া ঋণের দায়ে জর্জরিত শ্রীলঙ্কায় নিজেদের আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ বিস্তারে। ফলে দেখা দিয়েছে স্বার্থের সংঘাত। আর তাতেই চৌচির বন্ধুত্ব।