লাল-সাদা ডোরা কাটা জার্সিধারীদের গগনবিদারী চিৎকারে লিসবনের দ্য লুইজ স্টেডিয়ামে তখন কান পাতা দায়! ৪০ বছরের দুঃসহ স্মৃতিকে পাথর চাপা দিয়ে ইউরোপ সেরা ক্লাবে পরিণত হওয়ার অপেক্ষায় অ্যাটলেটিক মাদ্রিদের সমর্থকরা মেতে উঠেছেন বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে। চিৎকার করছেন, উৎসাহ যোগাচ্ছেন দিয়াগো গডিন, ডেভিড ভিয়াদের। তাদের উচ্ছ্বাসে রসদ ঢালছেন কোচ দিয়াগো সিমিওনে, দুই হাত উঁচিয়ে সমর্থকদের বলছেন মাতোয়ারা হও, আনন্দ কর! সমর্থকরাও আনন্দের আতিশয্যে আলিঙ্গন করছেন একে অপরকে। কারণ একটাই, উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা। ৯৩ মিনিট পর্যন্ত ম্যাচের চিত্র এমনই। এক মিনিট বাকি রেফারির শেষ বাঁশির। এমন মুহূর্তে শিরোপা উৎসবের ঢালি সাজিয়ে বাঁধনহারা আনন্দে মেতে উঠাই স্বাভাবিক লা রোজিব্ল্যাঙ্কোস সমর্থকদের। তারা যখন উৎসবে উৎসবে রঙিন, তখনই ভোজবাজির মতো কোথা থেকে উড়ে আসলেন সার্জিও রামোস। করলেন এক হেড, ফিরিয়ে দিলেন অল গ্যালাকটিকোদের প্রাণ। চুপসে দিলেন রেড অ্যান্ড হোয়াইটদের। এরপর সব ইতিহাস। দীর্ঘ ১২ বছরের ক্ষরা কাটিয়ে ইউরোপ সেরা ক্লাবের খেতাব জিতে নিলেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, সার্জিও রামোস, গ্যারেথ বেল, অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়ারা। দুর্দান্ত, চোখ ধাঁধানো, শৈল্পিক ফুটবল খেলে মাদ্রিদ ডার্বির ১২০ মিনিটের ফাইনালকে এক পেশে করে ৪-১ গোলে জিতল রিয়াল মাদ্রিদ।
দীর্ঘ একটা ম্যাচের সমাপ্তি ঘটতে চলেছে। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো তখনো গোল শূন্য। উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ইতিহাসে এক মৌসুমে সর্বোচ্চ গোলদাতা (১৬ গোল) রোনালদো আলো ছড়ালেন শেষ মুহূর্তে। ডি বঙ্ েফাউলের শিকার হয়ে প্রাপ্য পেনাল্টি শট থেকে গোল করলেন। এরপরের দৃশ্যটা ফুটবলভক্তরা দীর্ঘদিন ভুলবে না। নিষিদ্ধ কাজটাই করলেন রোনালদো। জার্সি খুলে ছুড়ে ফেললেন পিছনে। সিংহের গর্জন বেরিয়ে এল কণ্ঠ চিড়ে। ১৭ গোল করে রেকর্ডটা বহুদূর নিয়ে গেলেন রোনালদো। এই শেষের দৃশ্যটার মতো আরও অনেক দৃশ্যই ছিল শনিবার রাতে। উরুগুইয়ান তারকা দিয়েগো গডিনের ৩৬ মিনিটের গোলে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ যখন প্রথম উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের আনন্দে মেতে উঠার অপেক্ষায় তখনই আঘাত হানেন সার্জিও রামোস। অতিরিক্ত মিনিটেরও শেষ মুহূর্তে দুর্দান্ত এক হেডে গোল করেন তিনি। ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত ৩০ মিনিটে। ১১০ মিনিটে অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া অসাধারণ এক আক্রমণে বাম প্রান্তের সব বাধা ভেঙে ডি বক্সে ঢুকে পড়েন। তার পাসে বল পেয়ে সহজ গোল করেন গেরেথ বেলে। ১১৮ মিনিটে গোল করেন ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্ডার মার্সেলো। অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের পিছু ছাড়ল না দুর্ভাগ্য। ১৯৭৪ সালে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ (ইউরোপীয়ান কাপ) ফাইনালে প্রথম ম্যাচে শেষ মিনিটের গোলেই বায়ার্ন মিউনিখ সমতায় ফিরেছিল অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের সঙ্গে। প্রথম ম্যাচ ১-১ গোলে ড্র হওয়ায় দ্বিতীয় ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। সেই ম্যাচে গার্ড মুলারদের বায়ার্ন মিউনিখ ৪-০ গোলে হারিয়েছিল লুইস আরাগোনসদের অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদকে। সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর সেন্টার ফিল্ডে আক্রমণে মেতেছেন রোনালদো-বেলেরা। কীভাবে সম্ভব! চারটা বিশাল জায়ান্ট স্ক্রিনে বার্নাব্যুর দর্শকরা দেখছিলেন লিসবনে অনুষ্ঠিত রিয়াল মাদ্রিদ-অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ ফাইনাল ম্যাচ। মাঠ থেকেই তারা জড়ো হন মাদ্রিদের ঐতিহাসিক সিবেলিজ স্কয়ারে। চ্যাম্পিয়নদের স্বাগত জানান এখানেই। পর্তুগালের রাজধানী থেকে ফিরে ভক্তদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করেই বিশ্রামে যান রোনালদো-বেলেরা।
২০০২ সালে রিয়াল মাদ্রিদের নবম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা জয়ের সাক্ষী ছিলেন ইকার ক্যাসিয়াস। এক যুগ পর ডেসিমা পূরণ করে বললেন, 'আমার কাছে এটা বিশ্বকাপ জয়ের মতোই আনন্দদায়ক। চার বছর আগে স্পেনের হয়ে বিশ্বকাপ জিতে যেমন আনন্দ পেয়েছিলাম দশম ডেসিমা জিতে তার চেয়েও বেশি আনন্দ পাচ্ছি।' বেলে বললেন, এই স্মৃতি আমার সঙ্গে থাকবে সারা জীবন। আর তিনটা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ী কার্লো আনসেলত্তি শিষ্যদের প্রশংসা করেই শেষ করলেন বক্তব্য। লিভারপুলের সাবেক কোচ বব পেইসলির পর তিনিই তিনটা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের গৌরব অর্জন করলেন। পেইসলি লিভারপুলের কোচ হিসেবে ১৯৭৬-৭৭, ১৯৭৭-৭৮ ও ১৯৮০-৮১ মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের (ইউরোপীয়ান কাপ) শিরোপা জয় করেন। আনসেলত্তি এর আগে এসি মিলানের কোচ হিসেবে ২০০২-০৩ ও ২০০৬-০৭ মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয় করেছেন। পরাজিত কোচ দিয়েগো সাইমান দুঃখ পেলেও সব ভুলে সামনে চলার উপদেশ দিয়েছেন শিষ্যদের। রিয়াল মাদ্রিদ লা ডেসিমা অর্জনের জন্য কতকিছুই না করল। রোনালদো এবং মরিনহো জুটি দিয়ে চেষ্টা করেছে তারা। বহু তারকার সমাগম করেছে বার্নাব্যুতে। গত কয়েকটা মৌসুমে সব বৃথাই গেছে। গত মৌসুমে রেকর্ড মূল্যে বেলেকে দলে টেনে সমালোচনার মুখে পড়েছিল তারা। তবে প্রমাণ হলো রোনালদো-বেলে জুটি গড়ার প্রয়োজন ছিল। এই জুটিই তো রিয়াল মাদ্রিদকে এনে দিল লা ডেসিমা। উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ১০ম শিরোপা।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগে রিয়াল মাদ্রিদ
চ্যাম্পিয়ন : (১০ বার) ১৯৫৬, ১৯৫৭, ১৯৫৮, ১৯৫৯, ১৯৬০, ১৯৬৬, ১৯৯৮, ২০০০, ২০০২ ও ২০১৪। রানার্সআপ : (৩ বার) ১৯৬২, ১৯৬৪ ও ১৯৮১।