ফুটবলে এক বাক্যে পর্তুগালের পরিচয় দিতে বললে, যে কেউ তার উত্তর খুব সহজেই দিতে পারবে। 'আ ওয়ার্ল্ড ক্লাস টিম উইদাউট ট্রফি' বললে তো পর্তুগিজ ফুটবলারদের চিরচেনা মুখগুলোই ভেসে উঠবে! ইউসেবিও, লুইস ফিগো, রুই কস্তা, পলেতা এবং ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মতো বিশ্ব তারকার জন্ম যে দেশে তাদের ঝুলিতে নেই ফুটবলের সম্মানজনক কোনো শিরোপা! বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ তৃতীয় স্থান। ১৯৬৬ বিশ্বকাপে ইউসেবিওর দল সোভিয়েত ইউনিয়নকে হারিয়ে তৃতীয় হয়েছিল। এরপর ২০০৬ সালে লুইস ফিগোর পর্তুগাল খেলেছিল সেমিফাইনাল। বিশ্বকাপ বলতে এতটুকুই। ইউরোপীয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে পর্তুগিজদের সর্বোচ্চ অর্জন রানার্সআপ (২০০৪)। সেবার গ্রিসের মতো দলের কাছে হেরে শিরোপাবঞ্চিত থাকতে হয়েছিল ফিগোর পর্তুগালকে। ইতিহাস বলছে, শিরোপা ভাগ্য পর্তুগিজদের খুবই খারাপ।
মাঝে মধ্যে ইতিহাস তার দিক বদলায়। যে স্প্যানিশরা বিশ্বকাপের ফাইনালও খেলেনি কোনোদিন, কে ভেবেছিল তারা চ্যাম্পিয়ন হবে দক্ষিণ আফ্রিকায়! ফেবারিট হলেও ইতিহাস তো তাদের পক্ষে ছিল না ২০১০ বিশ্বকাপে! পর্তুগালের পক্ষে ইতিহাস নেই ব্রাজিল বিশ্বকাপে। কিন্তু বাস্তবতা যে বলছে ভিন্ন কথা! এক রোনালদো বদলে দিয়েছেন পর্তুগালকে ঘিরে চাওয়া-পাওয়ার হিসেব। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানি, স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি ও উরুগুয়ের মতো ফেবারিট দলগুলোর ঠিক সমান্তরালেই স্থান দিতে হবে পর্তুগালকেও। রোনালদোর মতো তারকা যে দলে তাকে ফেবারিটের তকমা না দিয়ে উপায় কি! তার উপর রোনালদো আছেন ক্যারিয়ারের মধ্য গগনে! যার আলোয় ফুটবল দুনিয়া প্রতি নিয়ত হেসে উঠছে।
রিয়াল মাদ্রিদের লা ডেসিমা ফুটবলে অনেক হিসেবই বদলে দিয়েছে। লিসবনের দ্যা লুইজ স্টেডিয়ামে পুরো পর্তুগালই রোনালদোর উদযাপনকে নিজেদের উদযাপন বলে মেনে নিয়েছিল। শনিবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে রিয়ালের রঙে রঙিন হয়েছিল তারা। পর্তুগিজদের এ উচ্ছ্বাস বিশ্বকাপের পরও তো থাকতে পারে! উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের দশম শিরোপা রিয়াল মাদ্রিদের অনেক তারকার জন্যই অনুপ্রেরণার অফুরান আঁধার। বিশেষ করে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর জন্য। যিনি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের এক মৌসুমে সর্বোচ্চ গোল (১৭টি) করে মেসির রেকর্ড (১৪ গোল) ভেঙ্গেছেন। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে মোট গোলের হিসেবেও ছাড়িয়ে গেছেন মেসিকে। ৬৮ গোল নিয়ে রোনালদো এখন দ্বিতীয় স্থানে। শীর্ষে আছেন স্পেনের রাউল গঞ্জালেস (৭১ গোল)। লিওনেল মেসি ৬৭ গোল নিয়ে তৃতীয় স্থানে। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো সদ্য শেষ হওয়া মৌসুমে জয় করেছেন কোপা দেল রে এবং চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। ব্যক্তিগত অর্জনের তালিকায় আছে ইউরোপীয়ান গোল্ডেন বুট। লা লিগায় সর্বোচ্চ ৩১ গোল করেছেন তিনি। সবমিলিয়ে মৌসুমে ৪৭ ম্যাচে ৫১ গোল। এমন দুর্দান্ত ফর্মে থাকা রোনালদো তো বিশ্বকাপটাও এনে দিতে পারেন পর্তুগিজদের! রোনালদোর জন্যই তো এবারের বিশ্বকাপে এল পর্তুগাল। বাছাই পর্বের শেষ ম্যাচে সুইডিশদের বিপক্ষে রোনালদোর হ্যাটট্রিকেই সব বাধা পেরিয়ে এসেছিল তারা।
রোনালদো রিয়াল মাদ্রিদের সঙ্গে চমৎকার একটা মৌসুম কাটিয়েছেন। বলা যায়, তার ক্যারিয়ারের সেরা মৌসুম ছিল এটা। তবে তার শ্রেষ্ঠত্বের বড় একটা পরীক্ষা হবে বিশ্বকাপে। যেখানে গ্রুপ পর্বেই তার জন্য অপেক্ষা করছে জার্মানি ও আফ্রিকার 'ব্ল্যাক স্টারস' ঘানার চ্যালেঞ্জ। গ্রুপ পর্ব পাড়ি দিলে দ্বিতীয় রাউন্ড পর্তুগিজদের জন্য সহজই হবে। তবে কোয়ার্টার ফাইনালেই পর্তুগিজদের দেখা হতে পারে লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা অথবা ফ্র্যাঙ্ক রিবেরির ফ্রান্সের সঙ্গে। বাধা অনেক। তবে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়েই তো এভারেস্টের চূড়া স্পর্শ করতে হয়। উজ্জীবীত এই রোনালদো কি পারবেন সব বাধা অতিক্রম করে বিশ্বকাপের সোনার ট্রফিতে চুমু খেতে! পর্তুগিজদের বহু দিনের আক্ষেপ দূর করতে!