ভারতের বিরুদ্ধে সিরিজের প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ দলে হঠাৎ চার পেসার-বিস্ময়কর সিদ্ধান্ত! একাদশ দেখে সমালোচনায় মুখর হননি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। মাশরাফি, তাসকিন, রুবেল থাকার পরও কেন বাড়তি আরেক পেসার নেওয়া হলো- এ নিয়ে খেলা শুরুর পর মুহূর্তের মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোচ-অধিনায়ক-টিম ম্যানেজমেন্টকে ব্যঙ্গ করে দেওয়া হয়েছিল হাজারও স্ট্যাটাস। কিন্তু দ্রুতই সবার ভুলটা ভেঙে গিয়েছিল- বোলিংয়ে মুস্তাফিজুর রহমান আসার পর। অভিষেকেই ৫০ রানে ৫ উইকেট নেন কাটার মাস্টার। ম্যাচ সেরাও হন সাতক্ষীরার সুপারম্যান। মুস্তাফিজ বুঝিয়ে দেন তাকে দলের নেওয়ার সিদ্ধান্তটা মোটেও ভুল ছিল না।
তবে স্পিননির্ভর এক দলে হঠাৎ চার পেসার খেলানোর মতো সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়া মোটেও সহজ সিদ্ধান্ত ছিল না। পরে জানা যায়, মুস্তাফিজকে দলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত মোটেও হঠাৎ করে নেওয়া হয়নি। অনেক দিন থেকেই কোচ নজরে রেখেছিলেন মুস্তাফিজকে। তাছাড়া হিথ স্ট্রিকের কোচিংয়ে বদলে যাওয়া পেস আক্রমণকে নিয়ে পরীক্ষার একটা সুযোগ খুঁজছিলেন হাতুরাসিংহে। ভারতের বিরুদ্ধেই তা কাজে লাগিয়েছেন।
ওই সিরিজের তিন ম্যাচে ১৩ উইকেট নিয়ে বিশ্ব রেকর্ডের মালিকও হয়েছিলেন মুস্তাফিজ। ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা বুঝতেই পারেননি মুস্তাফিজকে। বোলিংয়ে গতি খুব বেশি নেই। কিন্তু মাঝেমধ্যে বিস্ময়কর এমন সব 'কাটার' দিয়েছেন-সম্পূর্ণ পরাস্ত হয়েছে ভারতের ব্যাটসম্যানরা। এক মুস্তাফিজের কাছেই ওয়ানডে সিরিজটা হারিয়ে বসে ভারত।
শুধু মুস্তাফিজ কেন, তাসকিন-রুবেল-মাশরাফিই-বা কম কিসে! এক সময় নিয়মিত ১৪০ কিমির বেশি গতিতে বোলিং করতেন মাশরাফি। কিন্তু এখন গতি কমিয়ে দিয়ে মনোযোগী হয়েছেন লাইনলেন্থে। টাইগার দলপতি মাঠে নামার আগেই প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যান সম্পর্কে ধারণা নেন কোন ব্যাটসম্যানের দুর্বলতা কোথায়! ব্যাটসম্যানকে খুব একটা সুযোগ দেন না। আর হিসেবি বোলিং করেই সফল হচ্ছেন নড়াইল এঙ্প্রেস। তবে বোলিংয়ের চেয়েও নেতৃত্ব গুণের কারণে মাশরাফি বাংলাদেশ দলের জন্য অপরিহার্য।
নিয়মিত ১৪০ কিমির বেশি গতি বল করে থাকেন তাসকিন আহমেদ ও রুবেল হোসেন। তাসকিনের গতি যেকোনো ব্যাটসম্যানকে ভড়কে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। বিশেষ করে তার ইনসুইং বল যে কাউকে বোমা বানানোর জন্য যথেষ্ট। আর রুবেলের প্রধান অস্ত্রো গতির সঙ্গে 'লেট সুইং'। বল বুঝতে না পেরে ব্যাটসম্যান আগেই ব্যাট চালান, পরে দেখা যায় সরাসরি বোল্ড। বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচে শেষ স্পেলে তার ক্যারিশম্যাটিক বোলিংয়ের জন্যই তো কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের।
২০১৫ সালটা দেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে এক স্বর্ণালি অধ্যায় হয়ে থাকবে। বিশ্বকাপে সাফল্য দিয়ে শুরু। তারপর ঘরের মাঠে একে একে পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে সিরিজ জয়। টাইগারদের এই সাফল্যে বড় অবদান পেসারদেরই।
দলীয় সাফল্য এনে দেওয়ায় পেসারদের ব্যক্তিগত সাফল্যের গ্রাফটাও হয়েছে ঊধ্বমুখী। ২০১৫ সালে এ পর্যন্ত ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি ৩০ বোলারের মধ্যে বাংলাদেশেরই পাঁচজন। এর মধ্যে একমাত্র সাকিব আল হাসান ছাড়া বাকি চার জন্যই পেসার-মুস্তাফিজুর রহমান, রুবেল হোসেন, মাশরাফি মর্তুজা ও তাসকিন আহমেদ। মুস্তাফিজুর রহমান মাত্র ৬ ম্যাচ থেকে নিয়েছেন ১৮ উইকেট। বছরে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারির তালিকায় তিনি রয়েছেন ১৫তম স্থানে। রুবেল হোসেনও নিয়েছেন ১৮ উইকেট, কিন্তু তিনি খেলেছেন ১৪ ম্যাচ। ১৩ ম্যাচে মাশরাফি মর্তুজার শিকার ১৭ উইকেট। ইনজুরির কারণে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে সিরিজে খেলতে না পারা তাসকিন ১১ ম্যাচে নিয়েছেন ১৪ উইকেট। ২০১৫ সালে ওয়ানডে বোলারদের এক তালিকায় সবার উপরে মুস্তাফিজের নাম, সবচেয়ে বেশি ম্যাচে পাঁচের বেশি উইকেট শিকার। দুই ম্যাচে এমন কৃতিত্ব রয়েছে কাটার মাস্টারের। চলতি বছরে দুই ম্যাচে এমন কৃতিত্ব অস্ট্রেলিয়ার মিচেল স্টার্ক ও ইংলিশ বোলার স্টিভেন ফিনেরও। কিন্তু তাদের চেয়ে স্ট্রাইকরেট কম থাকায় তালিকায় শীর্ষে রয়েছেন মুস্তাফিজ।
মাশরাফি, মুস্তাফিজ, তাসকিন, রুবেল -একসঙ্গে দলে চার চারজন বিশ্বমানের পেসার। মজার ব্যাপার হচ্ছে, চারজনের বোলিংয়ের ধরনই ভিন্ন ভিন্ন। মুস্তাফিজের প্রধান অস্ত্রো 'কাটার', মাশরাফির নিখুঁত লাইনলেন্থ, তাসকিনের 'ইনসুইং' এবং রুবেলের 'লেট সুইং'। এর আগে কখনো বাংলাদেশ দলে এমন বৈচিত্র্যময় পেস আক্রমণ দেখা যায়নি। ২০১৫ সালে পেস বোলিংয়ে যেন উন্মোচিত হয়েছে নতুন দিগন্ত।