কুমিল্লার বাসিন্দা বা কুমিল্লায় বাড়ি না হয়েও কুমিল্লার মানুষের কাছে একটি ধিক্কৃত নাম মেজর ডালিম। পুরো নাম, লে. কর্ণেল অব. শরিফুল হক ডালিম। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনি মেজর ডালিম মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত। বর্তমানে পলাতক রয়েছে।
১৯৭৪ সালের ২৮ এপ্রিল আইনশৃংখলা পুন:প্রতিষ্ঠার অভিযানের সুযোগ নিয়ে কুমিল্লা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ও সম্মানিত নেতাদের গ্রেফতার ও নির্যাতন করে সমালোচিত ও ধিক্কৃত হয়েছিলো মেজর ডালিম। কুমিল্লার ঐ বিতর্কিত অভিযানের কারণে ১৯৭৪ এর জুলাই মাসে তাকে সেনাবাহিনী থেকে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছিলো। মূলত: ছাত্রজীবনের একটি ঘটনার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে সে ঐ অভিযানকে করে তুলেছিলো বিতর্কিত। পরবর্তীতে মেজর ডালিম বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্র করে এবং এই হত্যায় অংশ নেয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মেজর ডালিমের পিতা কুমিল্লার মৎস্য কর্মকর্তা হিসেবে চাকুরিরত ছিলেন। তারা থাকতেন কুমিল্লা শহরের অশোকতলায় চৌমুহনীর দোতলা বাড়িটিতে। কুমিল্লায় থাকাকালে মেজর ডালিম কুমিল্লা জিলা স্কুলে এবং কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়াশুনা করেছে। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়াশুনার সময় এনএসএফ করা এবং মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার ঘটনায় তৎকালীন ছাত্রনেতা আফজল খানের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে। মেয়েদের উত্ত্যক্ত করায় ছাত্রদের হাতে মারও খেয়েছিলো সে। এটা ছিলো ষাটের দশকের ঘটনা। ১৯৬৪ সালে সে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যোগ দেয়। ১৯৬৫ সালে বিমান বাহিনী থেকে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়।
১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের পর কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে চাকুরিরত ছিলো মেজর ডালিম। ১৯৭৪ সালের ২৮ এপ্রিল দেশব্যাপি আইনশৃংখলা পুন:প্রতিষ্ঠা ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে মেজর ডালিম ছিলো কুমিল্লার দায়িত্বে। কর্ণেল হুদা ছিলেন কুমিল্লা অঞ্চলের প্রধান (কুমিল্লা-নোয়াখালী-সিলেট)। অভিযানের সুযোগে মেজর ডালিম কুমিল্লার শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার ও নির্যাতন শুরু করে। একে একে গ্রেফতার করে জেলা আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল আজিজ খান, অধ্যক্ষ আবদুর রউফ, জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ আফজল খান, আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট রুস্তম আলী, মাঈনুল হুদা দুলাল, কমান্ডার ইকবাল আহমেদ বাচ্চু, নাজমুল হাসান পাখির ভাই বাবু, মাঈনুল হুদা দুলালের ভাই বদরুল হুদা জেনুসহ এ বাড়ির বেশ কয়েকজন এবং আরো বেশ ক'জন প্রভাবশালী ব্যক্তিকে। তাদেরকে গ্রেফতার করার পর নেয়া হয় শহরের শাকতলাস্থ ওয়াপদা রেস্ট হাউসে। সেখানে চালানো হয় নির্মম নির্যাতন।
আবদুল আজিজ খানের মতো সম্মানিত নেতাকে শহরের রাজগঞ্জ সড়কে ক্রোলিং করানো, নির্যাতন করা এবং কোন অপরাধ না থাকায় অধ্যক্ষ আফজল খানকে গ্রেফতারের ঘটনা ব্যাপক সমালোচিত হয়। তাছাড়া অনেকেরই কোন অভিযোগ না থাকার পরও গ্রেফতার ও নির্যাতনের ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আওয়ামী লীগ নেতৃবন্দকে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার ঘটনা শীর্ষ নেতৃবৃন্দকেও ক্ষুব্ধ করে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে তৎকালীণ সেনা কর্মকর্তা জেনারেল জিয়াউর রহমান (পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি) হেলিকপ্টারে করে এসে কুমিল্লা সেনানিবাসের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার হুদা, মেজর ডালিমকে সাথে নিয়ে ঢাকায় যান। ঢাকা সেনানিবাস থেকে সেনা প্রধান জেনারেল শফিউল্লাহ ব্রিগেডিয়ার হুদা ও মেজর ডালিম যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে। সেখানে বঙ্গবন্ধু কুমিল্লার নেতাদের গ্রেফতার ও নির্যাতনের ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সে সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এসময় বেশ কয়েকজন সেনাকর্মকর্তাকে শাস্তি দেয়ার কথা বলেন এবং গ্রেফতারকৃতদের ছেড়ে দিতে নির্দেশ দেন।
পরের দিন সেনাপ্রধান কুমিল্লার গ্রেফতারকৃতদের ছেড়ে দেয়ার আদেশ দেন। ব্রিগেডিয়ার হুদা হেলিকপ্টারে কুমিল্লায় এসে গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি দেন। অনেককে ছেড়ে দিলেও ছাত্রজীবনে মারের প্রতিশোধ নিতে অধ্যক্ষ আফজল খানকে জেল হাজতে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। প্রায় দেড়মাস জেলে থেকে মু্ক্তি পান অধ্যক্ষ আফজল খান। এ ঘটনার কিছুদিন পরই জুলাইয়ের শেষ দিকে সেনা বাহিনীর চাকুরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় মেজর ডামিলকে সেই সাথে মেজর নূরকে। চাকরিচ্যুতির পর কুমিল্লায় আসতে পারেনি মেজর ডালিম। সেনা প্রহরায় তার স্ত্রী নিম্মীকে কুমিল্লা থেকে বিমানে করে ঢাকায় নেয়া হয়।
ছাত্রজীবন থেকে বখাটে প্রকৃতির শরিফুল হক ডালিম বঙ্গবন্ধু পরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠ এবং স্নেহভাজন হয়েও বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় এবং হত্যাকান্ডে অংশ নেয়।
১৯৭৪ সালের ২৮ এপ্রিল বিতর্কিত অভিযান চালিয়ে কুমিল্লার মানুষের কাছে দারুণ সমালোচিত এবং বঙ্গবন্ধু হত্যায় জড়িত হয়ে হয় ধিক্কৃত। মেজর ডালিম তার লেখা 'যা দেখেছি, যা বুঝেছি, যা করেছি' বইয়ে সেসব ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে অকপটে। স্বীকার করে লিখেছে কিভাবে সে বঙ্গবন্ধু হত্যায় অংশ নেয়। সে তার বইতে লিখেছে ১৯৭৪ সালের ২৮ এপ্রিলের বিতর্কিত অভিযানের কথাও।
বিডি-প্রতিদিন/১৫ আগস্ট, ২০১৫/ এস আহমেদ