কখনো স্ট্রাইকার, কখনো আক্রমণাত্দক মিডফিল্ডার, কখনো বা পুরাদস্তুর প্লে-মেকার। রবার্তো ব্যাজিও একাই তিন ভূমিকায় খেলতেন। তিন পজিশনেই ছিলেন বিশ্বসেরা। তবে ফ্রি-কিক এবং প্লে-মেকার হিসেবে ব্যাজিও ছিলেন সর্বকালের সেরা! ১৯৯৩ সালে ফিফা বর্ষসেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন। ২০০৪ সালে পেয়েছেন ইউরোপের সেরা ফুটবলারের পুরস্কার 'ব্যালন ডি'অর। বিশ্বকাপের মহাতারকাদের নিয়ে ফিফা যে স্বপ্নের দল গঠন করেছিল সে দলেও ছিলেন ব্যাজিও। ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি পেলের দৃষ্টিতে সর্বকালের সেরা ১০০ জন খেলোয়াড়ের মধ্যে আজ্জুরি তারকার নাম ছিল প্রথম দিকেই। ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত ফিফার শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড়ের তালিকায় ছিলেন চার নম্বরে। বিশ্বকাপ না জিতেও ফুটবলের 'মহানায়ক' রবার্তো ব্যাজিও।
চমৎকার ড্রিবলিং এবং দুর্দান্ত ফিনিশিংয়ের কারণে ব্যাজিও তার সমসাময়িক ফুটবলারদের চেয়ে এগিয়ে থাকতেন সবসময়। কখনো পায়ে বল আটকে রাখতেন না। কিংবা তার কাছ থেকে কখনো প্রতিপক্ষের খেলোয়াড় বল কেড়ে নিতেও পারত না। বল পাস দিয়ে দ্রুত নিজের পজিশনে চলে যেতেন। ব্যাজিও তার ফুটবল শৈলীর অনন্য প্রদর্শীয় দেখিয়েছেন ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপে। যদিও সেবার দুর্ভাগ্যবশত ফাইনালে ব্রাজিলের কাছে টাইব্রেকারে হেরে যায় ইতালি। কিন্তু পায়ের জাদু দেখিয়ে বিশ্ববাসীর মন কেড়ে নেন এই আজ্জুরি তারকা। ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপে ব্যাজিও একাই আজ্জুরিদের টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন ফাইনালে। শেষ ম্যাচে গায়ে ভীষণ জ্বর নিয়েও মাঠে নেমেছিলেন। বেশ কয়েক সহজ সুযোগ নষ্ট করায় শূন্য হাতে সেবার যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরতে হয়। অথচ নক আউট পর্বে কি চমকই না দেখিয়েছিলেন ব্যাজিও। খোঁড়াতে খোঁড়াতে ইতালি রানার্স আপ হয়ে প্রথম রাউন্ডের গণ্ডি পার হয়েছিল। নক আউট পর্বে ব্যাজিও অসাধারণ পারফরম্যান্স দেখিয়ে ৫ গোল করেন। ওয়াশিংটনে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটি হারতেই বসেছিল ইতালি। খেলা শেষ হওয়ার মাত্র দুই মিনিট আগে দারুণ এক গোলে সমতা ফেরান। তারপর নিজের গোল্ডেন গোল করে কোয়ার্টার ফাইনালে নিয়ে যান আজ্জুরিদের। শেষ আটের লড়াইয়ে স্পেনের ম্যাচেও খেলা শেষ হওয়ার তিন মিনিট আগে জয়সূচক গোলটি আসে তার পা থেকেই। সেমিফাইনালে তো অপ্রতিরোধ্য ব্যাজিও। একাই দুই গোল করে ইতালিকে ফাইনালে নিয়ে যান। কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারেননি। অসুস্থতার কারণে টাইব্রেকারে গোল করতে ব্যর্থ হন ব্যাজিও। হেরে যায় ইতালি। ১৯৯০ ও ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপেও ইতালির জার্সিতে খেলেছেন তিনি। ৯০-এ তাকে বেশির ভাগ ম্যাচেই নামতে হয়েছে বদলি খেলোয়াড় হিসেবে। ইতালি তৃতীয় স্থান লাভ করে। কিন্তু চেকোস্লোভাকিয়ার বিরুদ্ধে তার গোলটি 'গোল অব দ্য টুর্নামেন্ট' নির্বাচিত হয়। ৯৮-এর বিশ্বকাপে ভালো খেলেও দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছেন। ব্যাজিও দলকে কোয়ার্টার ফাইনালে নিয়ে গেলেও 'টাইব্রেকার' নামক বিড়ম্বনার ফাঁদে পড়েন। রবার্তো ব্যাজিও পাওলো রশির মতো আজ্জুরিদের বিশ্বকাপের শিরোপা এনে দিতে পারেননি। কিংবা শিলচ্চির মতো বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলদাতাও হননি। তারপরেও ব্যাজিও ছিলেন ইতালির সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুটবলার। ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে এক জরিপে দেখা যায়, রাজনৈতিক নেতাদের পেছনে ফেলে এক নম্বর জায়গাটি দখল করে নেন এই আজ্জুরি তারকা।
১৯৬৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি উত্তর ইতালির ভিচেনজার নিকটবর্তী কালদেনো শহরে রবার্তো ব্যাজিওর জন্ম। শৈশব থেকেই ফুটবল ছিল ধ্যান-জ্ঞান। মাত্র ৯ বছর বয়সেই স্থানীয় এক ক্লাবের যুবদলে খেলেন। এক ম্যাচে ৬ গোল করার পর আন্তোনিও মোরা তাকে ভিচেনজা ক্লাবে খেলার প্রস্তাব দেন। ১৯৮২ সালে ভিচেনজার হয়ে পেশাদার ফুটবল শুরু। এরপর একে একে ফিওরেন্টিনা, জুভেন্টাস, এসি মিলান, বোলগনা, ইন্টারমিলান ও ব্রেসিয়ার হয়ে খেলেছেন। ক্লাব ফুটবলে ব্যাজিও ৪৮৮ ম্যাচে ২২১ গোল করেছেন। ইতালির জার্সিতে খেলেছেন ৫৬ ম্যাচ, করেছেন ২৭ গোল। ব্যাজিও ছিলেন পেনাল্টি স্পেশালিস্ট। ফুটবল ক্যারিয়ারে ১২২টি পেনাল্টির মধ্যে তিনি ১০৬টি গোল করেন। বিশ্বকাপের মূল পর্বে ১৬ ম্যাচে অংশ নিয়ে ৯ গোল করেছেন। তাই ইতালির ফুটবল ইতিহাসে এক অনন্য রেকর্ড। ফুটবল ক্যারিয়ারে ব্যাজিও একমাত্র অতৃপ্তি বিশ্বকাপ জিততে না পারা। আর এই কষ্ট নিয়েই ২০০৪ সালে ফুটবলকে চিরতরে বিদায় জানান ফুটবলের 'মহানায়ক'।